চুক্তি অনুযায়ী অ্যাসাঞ্জকে আর যুক্তরাষ্ট্রের হেফাজতে যেতে হচ্ছে না; তিনি ফিরে যাচ্ছেন নিজের দেশ অস্ট্রেলিয়ায়।
Published : 25 Jun 2024, 09:35 AM
মার্কিন ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ আইন লঙ্ঘনের দায় স্বীকার করে নেওয়ার চুক্তিতে যুক্তরাজ্যের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, যার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ এড়াতে তার দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের অবসান হল।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘জাতীয় প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত তথ্য ফাঁসের ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ আনা হয়েছিল ৫২ বছর বয়সী অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্র বলে আসছে, ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের নথি ফাঁস করে বহু মানুষের জীবনকে হুমকিতে ফেলেছে উইকিলিকস।
গত পাঁচ বছর ধরে ব্রিটেনের কারাগার বন্দি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে আসছিলেন অ্যাসাঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপস রফায় পৌঁছানোর পর তিনি মুক্ত হয়ে যুক্তরাজ্য ছেড়েছেন বলে উইকিলিকস জানিয়েছে।
সিবিএসের বরাত দিয়ে বিবিসি লিখেছে, চুক্তি অনুযায়ী অ্যাসাঞ্জকে আর যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে যেতে হবে না। যুক্তরাষ্ট্রে যে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল, সেই অপরাধ তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন বলে ধরা হবে এবং যুক্তরাজ্যে কারাবন্দি থাকার সময়কে সাজা খাটা হিসেবে গণ্য করা হবে।
যুক্তরাজ্যের কারাগার থেকে মুক্ত অ্যাসাঞ্জ তার জন্মস্থান অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাবেন বলে মার্কিন বিচার বিভাগের এক চিঠিতে জানানো হয়েছে।
এক্স পোস্টে উইকিলিকস লিখেছে, লন্ডনের বেলমার্শ কারাগারের ছোট্ট কক্ষে ১৯০১ দিন কাটানোর পর অ্যাসাঞ্জ সোমবার মুক্তি পান। বিকালেই স্ট্যানস্টিড বিমানবন্দর থেকে একটি ফ্লাইটে তিনি যুক্তরাজ্য ছাড়েন।
অ্যাসাঞ্জের একটি ভিডিও এক্সে প্রকাশ করেছে উইকিলিকস। সেখানে দেখা যায়, জিনস ও নীল শার্ট পরা অ্যাসাঞ্জ বিমানবন্দরের পথে রয়েছেন।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের স্ত্রী স্টেলা মরিস অ্যাসাঞ্জ এক্স পোস্টে সমর্থকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, বছরের পর বছর ধরে তারা অ্যাসাঞ্জের পক্ষে সমর্থন যুগিয়ে গেছেন, যা তার মুক্তির দিনটিকে বাস্তবে পরিণত করেছে।
বিবিসি লিখেছে, অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে মামলায় যে ১৮টি অভিযোগ আনা হয়েছিল, চুক্তি অনুযায়ী তার একটিতে দোষ স্বীকার করে নেবেন উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতা। বুধবার সেই আইনি প্রক্রিয়া সারা হবে নর্দার্ন মারিয়ানা আইল্যান্ডসের একটি আদালতে।
যুক্তরাষ্ট্রের কমনওয়েলথের অন্তর্ভু্ক্ত প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ নর্দার্ন মারিয়ানা আইল্যান্ডসের ভৌগলিক অবস্থান মার্কিন ভূখণ্ডের অংশ হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের তুলনায় অস্ট্রেলিয়ার কাছাকাছি।
অস্ট্রেলিয়া সরকারের একজন মুখপাত্র বলেছেন, এই মামলাকে অনেক দূর টেনে নেওয়া হয়েছে। তবে অ্যাসাঞ্জের মার্কিন আইনজীবী রিচার্ড মিলার কোনো মন্তব্য করতে চাননি। অবশ্য মার্কিন সরকারের এই মামলাকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে আসছিলেন তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত এপ্রিলে বলেছিলেন, অ্যাসাঞ্জের বিচার বন্ধে অস্ট্রেলিয়া সরকারের একটি অনুরোধ তিনি বিবেচনা করছেন। তবে পরের মাসেই যুক্তরাজ্যের হাই কোর্টের রায়ে যুক্তরাষ্ট্রে হস্তান্তরের বিরুদ্ধে আপিলের অধিকার পান অ্যাসাঞ্জ।
অ্যাসাঞ্জের প্রতিষ্ঠিত উইকিলিকস ২০১০ সালে পেন্টাগন ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লাখ লাখ সামরিক ও কূটনৈতিক গোপন নথি ফাঁস করে দিয়ে বিশ্বজুড়ে হৈ চৈ ফেলে দেয়।
ওই সব নথির মধ্যে মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে আফগান যুদ্ধ সম্পর্কিত ৭৬ হাজার এবং ইরাক যুদ্ধ সম্পর্কিত আরো ৪০ হাজার নথি ছিল, যা যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও পেন্টাগনকে চরম বেকায়দায় ফেলে দেয়।
ওই বছরই মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি ভিডিও প্রকাশ করে উইকিলিকস। সেখানে ২০০৭ সালে বাগদাদে অ্যাপাচি হেলিকপ্টার থেকে হামলা চালিয়ে রয়টার্সের দুজন সংবাদকর্মীসহ এক ডজন মানুষকে হত্যা করতে দেখা যায়।
অ্যাসাঞ্জ সমর্থকরা মনে করেন, উইকিলিকস ওই গোপন নথিগুলো প্রকাশ করে আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার অপব্যবহারের স্বরূপ উন্মোচন করেছে। তথ্য ফাঁসের ওই ঘটনাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা হিসেবেও বর্ণনা করেন তারা।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা এবং পশ্চিমা নিরাপত্তা কর্মকর্তারা অ্যাসাঞ্জকে অত্যন্ত অনমনীয় এবং বিপজ্জনক শত্রু বলেই মনে করে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কৌঁসুলিদের ভাষ্য, অ্যাসাঞ্জের ফাঁস করা গোপন নথিতে নাম থাকা গুপ্তচরদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। অ্যাসাঞ্জকে বিচারের মুখোমুখি করতে শুরু থেকেই তাকে হস্তান্তরের জন্য চাপ দিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র।
সুইডেনে যৌন নিপীড়নের এক মামলায় ২০১১ সালে লন্ডনে গ্রেপ্তার হন অ্যাসাঞ্জ। পরে লন্ডনের আদালত থেকে জামিনও পান। কিন্তু সুইডেন হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে, এই আশঙ্কায় ২০১২ সালে তিনি পালিয়ে লন্ডনে একুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় নেন। সুইডেনের সেই মামলা পরে খারিজ হয়ে যায়।
সাত বছর দূতাবাসে কাটানোর পর ২০১৯ সালের এপ্রিলে আবার গ্রেপ্তার হন অ্যাসাঞ্জ। জামিনের শর্ত ভঙ্গের দায়ে ২০১৯ সালের মে মাসে তাকে ৫০ সপ্তাহের জেল দেওয়া হয়। তখন থেকেই তিনি বেলমার্শ কারাগারে ছিলেন।
কারাগারে থাকা অবস্থাতেই আদালতের অনুমতি নিয়ে নিজের আইনজীবী এবং দীর্ঘদিনের প্রেমিকা স্টেলা মরিসকে বিয়ে করেন অ্যাসাঞ্জ। এই দম্পতির দুটি সন্তানও রয়েছে। দুজনের ক্ষেত্রেই মরিসের গর্ভধারণ হয়েছে অ্যাসাঞ্জ দূতাবাসে লুকিয়ে থাকাকালে।
দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আইনজীবী স্টেলা মরিসের সঙ্গে অ্যাসাঞ্জের পরিচয় হয় ২০১১ সালে, যখন তিনি প্রথমবার কারাগারে গেলেন। ২০১৯ সালে জামিনের শর্ত ভঙ্গের অভিযোগে জেলে যাওয়ার পর তাদের প্রেমের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
পুরনো খবর
ইকুয়েডরের রাজনৈতিক আশ্রয়ে অ্যাসাঞ্জ
অ্যাসাঞ্জ পেলেন একুয়েডরের নাগরিকত্ব
অ্যাসাঞ্জ মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন: জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ
কারাগারে কোভিডে আক্রান্ত জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ
লন্ডনের কারাগারে বিয়ে করছেন অ্যাসাঞ্জ