বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে মধ্যবাম রাজনীতিবিদ স্টারমারকে।
Published : 05 Jul 2024, 10:53 PM
যুক্তরাজ্যে ১৪ বছর বিরোধী দলে থাকার পর জাতীয় নির্বাচনে বিপুল বিজয়ে ক্ষমতায় ফিরছে লেবার পার্টি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম ভাষণে যুক্তরাজ্যকে নতুন করে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন লেবার নেতা কিয়ার স্টারমার।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে মূল্যস্ফীতি কমানো, অর্থনীতির মেরামত, অভিবাসন সংকটের সুরাহা করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নানা সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখতে হবে স্টারমারকে। ফলে সরকার পরিবর্তনে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র নীতি কতটা বদলাবে, সামনে আসছে সে প্রশ্ন।
দেশে অনেক কাজ নতুন করে শুরু করার পাশাপাশি বহুমেরুর এই বিশ্বে খাপ খাইয়ে চলাসহ বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে মধ্যবাম রাজনীতিবিদ স্টারমারকে। ব্রেক্সিট পরবর্তী যুক্তরাজ্যের ভাবমূর্তিও গড়তে হবে নতুন করে।
বিশ্বের সুপারপাওয়ার এবং ভূরাজনৈতিক দিক থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মধ্যে স্পর্শকাতর সম্পর্ক সুষ্ঠূভাবে পরিচালনা করতে হবে লেবার সরকারকে। আবার বিশ্বে বাড়তে থাকা হুমকির মুখে নতুন সরকারকে যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তাও বাড়াতে হবে।
লেবার পার্টি ক্ষমতায় এলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ছায়া সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি।
ভোটের আগে লেবার পার্টি তাদের ইশতেহারে পররাষ্ট্রনীতির যে পরিকল্পনা দিয়েছিল, তা মোটামুটি এরকম–
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
লেবার পার্টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে থাকবে। তারা ইইউ-এর একক বাজার এবং কাস্টমস ইউনিয়নে ফিরতে চায় না। যদিও ২০১৬ সালের ব্রেক্সিট গণভোটে স্টারমার ইইউয়ে থাকার পক্ষে ছিলেন।
সেই ভোটের (ব্রেক্সিট) আট বছর পর লেবার পার্টি এখন ইইউ-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। বাণিজ্য, গবেষণা এবং নিরাপত্তার মত ক্ষেত্রগুলোতে যুক্তরাজ্য-ইইউ চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্টারমার।
লেবার পার্টি ফ্রান্স ও জার্মানিসহ ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে সহযোগিতা জোরদার করা এবং সম্পর্ক পুনর্নির্মাণের জন্য একটি নতুন যুক্তরাজ্য-ইইউ নিরাপত্তা চুক্তি করার পরিকল্পনা করছে। পাশাপাশি নতুন দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও করার চেস্টা চালাবে তারা।
রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে ইউক্রেইনকে দিয়ে যাওয়া যুক্তরাজ্যের দৃঢ় সমর্থন ইইউ দেশগুলোর সঙ্গে দেশটির সন্তোষজনক সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়ক হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়ে ইউরোপের নিরাপত্তার ভিতকে শক্তিশালী করতে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যুক্তরাজ্যে নতুন সরকার এলেও সে অবস্থানের পরিবর্তন হবে না।
ইসিএইচআর
লেবার পার্টি বলেছে, যুক্তরাজ্য ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস (ইসিএইচআর) এর সদস্য থাকবে।
নেটো
লেবার পার্টি বলেছে, ইউরোপীয় ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার ভিত্তি গড়তে নেটোর প্রতি তাদের অঙ্গীকার 'অটুট' থাকবে।
তাছাড়া, নতুন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নেটো এবং জাতিসংঘ, জি-৭, জি-২০-সহ অন্যান্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, শক্তিশালী করা ও সংস্কারে মিত্রদের সঙ্গে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে লেবার সরকারের।
রাশিয়া-ইউক্রেইন
লেবার পার্টি ইউক্রেইনকে যুক্তরাজ্যের দিয়ে যাওয়া সামরিক, আর্থিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেছে।
তারা যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকে জবাবদিহিতায় আনার চেষ্টাকে এবং আগ্রাসনের অপরাধের জন্য একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের আহ্বানকে সমর্থন করবে।
ইউক্রেইনকে সহায়তা করার জন্য রুশ রাষ্ট্রীয় সম্পদ জব্দ করা এবং তা কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করতে মিত্রদের সঙ্গে কাজ করবে লেবার সরকার।
লেবার পার্টি আরও বলেছে, তারা ইউক্রেইনকে নেটোর সদস্যপদ পাইয়ে দেওয়ার পথ সুগম করতে সহায়তা করতে চায়।
মধ্যপ্রাচ্য
লেবার পার্টি বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়টি তাৎক্ষণিক গুরুত্ব পাবে।
গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, সব জিম্মির মুক্তি, আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রাখা এবং ওই অঞ্চলে দ্রুত সহায়তা বাড়ানোর জন্য চাপ দিয়ে যাবে লেবার সরকার।
ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে একটি ‘নতুন শান্তি প্রক্রিয়ার অবদান’ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাজ্যের নতুন সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের দিকেই যাবে।
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে 'ফিলিস্তিনি জনগণের অখণ্ড অধিকার' হিসেবে বর্ণনা করে লেবার পার্টি বলেছে, ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার জন্য এটি অপরিহার্য।
যুক্তরাষ্ট্র
লেবার পার্টি যুক্তরাষ্ট্রকে 'অপরিহার্য মিত্র' হিসেবে বর্ণনা করেছে। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য বিশেষ সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দাসহ অভিন্ন মূল্যবোধ ও অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তিতে লেবার পার্টি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবে।
চীন
লেবার পার্টি বলেছে, তারা চীনের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক পরিচালনার ক্ষেত্রে 'দীর্ঘমেয়াদি ও কৌশলগত পন্থা' নিয়ে আসবে।
তারা বলেছে, “আমরা যেখানে পারি সহযোগিতা করব, যেখানে আমাদের প্রয়োজন সেখানে প্রতিযোগিতা করব এবং যেখানে আমাদের চ্যালেঞ্জ জানানো উচিত সেখানে চ্যালেঞ্জ জানাব।”
দলটি আরও বলেছে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিরীক্ষণের মাধ্যমে চীনের সৃষ্ট নানা চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ বোঝা এবং সে অনুযায়ী সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যকে আরও সক্ষম করে তুলতে চেষ্টা করবে তারা।
যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর হওয়া হংকং সম্প্রদায়ের সদস্যদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের সমর্থন দেবে বলেও জানিয়েছে লেবার পার্টি।
ভারত
ভারতের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিসহ নতুন কৌশলগত অংশীদারিত্ব চায় যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টি। নিরাপত্তা, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও নিবিড় করার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির।
অকাস
লেবার পার্টি বলেছে, তাদের সরকার ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ত্রিপক্ষীয় ‘অকাস’ নিরাপত্তা অংশীদারত্ব চুক্তিতে পুরোপুরি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ব্রিটেনজুড়ে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে এই অকাস চুক্তির পূর্ণ অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে চায় তারা।
ফকল্যান্ড এবং জিব্রাল্টার
লেবার পার্টি বলেছে, তারা ফকল্যান্ড ও জিব্রাল্টারসহ ব্রিটিশ বৈদেশিক অঞ্চল এবং ক্রাউন ডিপেন্ডেন্সি (ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের তিনটি অফশোর দ্বীপাঞ্চল, যা ব্রিটিশ ক্রাউনের স্ব-শাসিত সম্পত্তি) অঞ্চলগুলোকে রক্ষা করবে এবং তাদের সার্বভৌমত্ব ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধির সুরক্ষিত রাখবে।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন
আর্থিক পরিস্থিতি অনুকূল হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যয় মোট জাতীয় আয়ের ০ দশমিক ৭ শতাংশে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে লেবার পার্টি।
বাণিজ্য
লেবার পার্টি সেবা রপ্তানি বাড়াতে নতুন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পাশাপাশি ডিজিটাল বা পারস্পরিক স্বীকৃতি চুক্তির মত স্বতন্ত্র খাতের চুক্তি করার চেষ্টা নিতে চায়।
দলটি বলেছে, তারা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপের মাধ্যমে নিবিড় বাণিজ্য ও সহযোগিতা চালু করতে বাণিজ্য বিধি ও চুক্তির আধুনিকীকরণ নিয়ে আন্তর্জাতিক আলোচনার নেতৃত্ব দেবে।
ওইসিডি’র করপোরেট ট্যাক্সের বৈশ্বিক ন্যূনতম হার বাস্তবায়নকে লেবার পার্টি সমর্থন করে। বহুজাতিক প্রযুক্তি সংস্থাগুলোকে তাদের করের ন্যায্য অংশ প্রদান নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকেও দলটি সমর্থন করে বলে জানিয়েছে।