“তিনি এমন অনেক কিছু করতে পারেন, যা মোদী পারেন না। তিনি মোদীর জন্য দরকারি, তিনি হলেন রোড রোলার; যিনি মোদীর পথের বাধাগুলো সমান করে দেন।”
Published : 03 May 2024, 11:19 PM
নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টানা তৃতীয়বারের মত জিতে রেকর্ড করতে পারবেন কিনা, সেটা তিনি জানতে পারবেন আসছে জুনে। এক দশকের ক্ষমতায় তিনি বাধার সম্মুখিন হয়েছেন বারবার। তবে কম আলোড়িত একজন রাজনীতিবিদকে সবসময় তার পাশে দেখা গেছে, যিনি কৌশলপ্রণেতা হিসেবে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অসাধারণ উত্থানে সাহায্য করে গেছেন।
তিনি অমিত শাহ। প্রায়ই তাকে ভারতের ‘দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি’ বলা হয়। তিনি নরেন্দ্র মোদীর শক্তিশালী পুরোনো বন্ধু, সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন এবং তার নির্বাচনি সিদ্ধান্তের নেপথ্যের মস্তিষ্ক।
কট্টরপন্থি হিন্দু জাতীয়তাবাদী অমিত শাহ দলের কর্মীদের মধ্যে ‘অমিতভাই’ নামেই বেশি পরিচিত। তার হাত ধরেই নির্বাচনে জয়ের খাতা বড় করেছে বিজেপি।
বিবিসি গুজরাটের সাংবাদিক গীতা পাণ্ডের ভাষায়, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মত তারকা খ্যাতি অমিত শাহর নেই। তিনি নিজের গণ্ডিতে চলতেই পছন্দ করেন। তবে তিনি একজন দক্ষ সংগঠক, প্রচার কৌশলবিদ, একজন ঝানু রাজনীতিবিদ এবং মোদীর মতই বিভাজনের রাজনীতির জন্য পরিচিত।
সমর্থকরা তাকে ‘হিন্দু আদর্শের মহান রক্ষক’ হিসেবে দেখেন; কিন্তু কেউ তার সঙ্গে টক্করে যাওয়ার সাহস দেখালে, তার জন্য তিনি ভয়ংকর প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন।
সমালোচকরা বলছেন, কাশ্মিরের আংশিক স্বায়ত্তশাসন বাতিল করাসহ ভারতের কিছু বিতর্কিত আইনের নেপথ্যের ব্যক্তি এই অমিত শাহ। কাশ্মিরের বিষয়টি গত কয়েক দশক ধরেই বিজেপির নির্বাচনি ইশতেহারে ছিল। নতুন নাগরিকত্ব আইন করার ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, যে আইনকে মুসলমানদের জন্য বৈষম্যমূলক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অমিত শাহর বন্ধু ও সহকর্মী, যারা তাকে স্কুলে পড়ার সময় থেকে, কিংবা পেশাজীবনের প্রথম থেকে চেনেন; এমনকি জেল খাটার সময়ও পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তেমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এই বিজেপি নেতার প্রথম দিককার জীবন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছেন বিবিসির গীতা পাণ্ডে।
অমিতভাইয়ের অসাধারণ সাফল্যের পেছনে কী কী কাজ করেছে, তা বর্ণনা করেছেন তারা। দলীয় কর্মীদের প্রতি তার গভীর স্নেহ আর কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতার কথা তারা বলেছেন।
প্রধান কৌশলবিদ
অমিত শাহ জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে প্রথম আলোচনায় উঠে আসেন এক দশক আগে, যখন তিনি ভারতের নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য উত্তর প্রদেশে বিজেপির জন্য একটি অসাধারণ জয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হন।
বছরের পর বছর ধরে উত্তর প্রদেশকে অজেয় হিসেবে দেখেছে বিজেপি। তবে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে দলটি এ রাজ্যের ৮০টি আসনের মধ্যে ৭১টিতে অভূতপূর্ব জয় তুলে নেয়।
অমিত শাহর সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করা বিজেপির প্রাক্তন রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী যতিন ওঝা বলছেন, "শাহের জন্য ঈশ্বরের একটি উপহার আছে, তা হল চাণক্যের চেয়েও তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক।”
পরে অমিত শাহর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলেও যতিন ওঝা তাকে তুলনা করেছেন দুই হাজর বছর আগে উপমহাদেশের প্রথম সাম্রাজ্য বিস্তারের সময়ের প্রবাদপ্রতীম কৌশলবিদদের সঙ্গে।
বন্ধু, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বীরাও একমত হবেন যে, অমিত শাহ তার দক্ষতা নবচেয়ে নিখুঁতভাবে ব্যবহার করেছেন নির্বাচনের সময়।
২০১৪ সালের সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে ২০১৭ ও ২০২২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে জয় তুলে নিয়ে ইতিহাস গড়েন অমিত শাহ। ২০১৯ সালেও বড় জয় পায় তার দল।
যতিন ওঝা বলছেন, প্রথম থেকেই তার মনে হত, অমিত শাহ একদিন ‘ক্ষমতার চূড়ায়’ পৌঁছে যাবেন।
তিনি বলেন, "আমি তার মধ্যে সেই স্ফুলিঙ্গ দেখেছি, তার মধ্যে সেই রাজনৈতিক দীপ্তি দেখেছি। তিনি সেই ঘোড়, যে বড় রেস জিততে যাচ্ছে।”
আহমেদাবাদের বিজেপি কাউন্সিলর দেবাং দানি অমিত শাহকে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে চেনেন। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করাই সবসময়ই অমিত শাহর অগ্রাধিকারে থাকে।
"গ্রাম পঞ্চায়েত হোক বা সংসদ, কোনো নির্বাচনই তার কাছে ছোটো নয়। প্রতিটি যুদ্ধে অমিতভাইয়ের জিততে হবে। মোদী এবং শাহর কারণেই ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে দুটি আসন থেকে বিজেপি ২০১৯ সালে ৩০৩টি আসনে উঠে এসেছে।”
যেখানে সব কিছুর শুরু
১৯৬৪ সালের ২২ অক্টোবর গুজরাটের ছোট্ট শহর মানসাতে জন্মগ্রহণ করেন অমিত শাহ। তার বাবা অনিলচন্দ্রের ছিল পিভিসি পাইপ তৈরির একটি ছোট ব্যবসা। মা কুসুমবেন ছিলেন গৃহিণী।
শৈশবের বন্ধু সুধীর দর্জি পৈতৃক ভিটার সঙ্গে অমিত শাহর ‘নিবিড় যোগাযোগ’ এবং মানসায় তার নিয়মিত যাতায়াতের কথা বলেছেন।
১৬ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে গুজরাটের সবচেয়ে বড় শহর আহমেদাবাদে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অমিত শাহ যেখানে থাকতেন, বন্ধুদের সঙ্গে যে বাগানে ক্রিকেট ও মার্বেল খেলতেন, সেই পারিবারিক পরিসর বিবিসির গীতা পাণ্ডেকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন সুধীর দর্জি। শাহদের বারোয়ারি ভিটাও আছে এর মধ্যে।
পাশের যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অমিত শাহ এবং সুধীর দর্জি পড়তেন, তাদের সেই খেলার মাঠ, শ্রেণিকক্ষ, খেলনার আলমারি আর স্কুলের ঘণ্টা যেন অর্ধশতাব্দীতেও বদলায়নি।
সুধীর বলেন, “অমিত শাহ বেশ শান্ত স্বভাবের ছিল। দুজন ছাত্র তাকে উত্যক্ত করত, একবার তার স্লেট ভেঙে দিয়েছিল। দুপুরের খাবার চুরি করত। ওইরকম বাজে আচরণের জন্য প্রায়ই অধ্যক্ষের অফিসে তাদের ডাক পড়ত।”
‘এক গাড়ির দুই চাকা’
১৯৮২ সালে উগ্র ডানপন্থি সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে (আরএসএস) যোগ দেন অমিত শাহ। ওই সময়ই আহমেদাবাদে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়।
মোদী তখন আরএসএস-এর একজন প্রচারক। তিনি তার অনুজ সহকর্মীকে (অমিত শাহ) বিজেপির ছাত্র শাখা অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন।
অল্প দিনেই দুজনের মধ্যে দৃঢ় বন্ধন তৈরি হয়। মোদীর পদন্নোতি হতে থাকে দ্রুত, অমিত শাহরও তাই। সমর্থকরা তাদের নাম দেন ‘এক গাড়ির দুই চাকা’। হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণের দুই ভাই রাম ও লক্ষ্মণের সঙ্গেও তাদের তুলনা চলতে থাকে।
চলতি শতাব্দীর শুরুর দশকে গুজরাটে টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক ছিলেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কিংশুক নাগ। তিনি বলেছেন, মোদী আর শাহ পরস্পরের জন্য ‘একেবারে উপযুক্ত’ ছিলেন। মোদী জনসাধারণকে মুগ্ধ করতে পারতেন, তিনি সামনেই থাকতেন। তবে অমিত শাহ নিজের মত করে থাকা মানুষ, কিছুটা লাজুক স্বভাবের, যিনি লাইমলাইট থেকে দূরেই থেকেছেন ।
অমিত শাহ কাজ করেছেন পর্দার আড়ালে, নিজের ভিত্তি তৈরি করেছেন, বন্ধু ও অনুসারীদের মন জয় করেছেন এবং নির্বাচনে পরাজিত করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিপক্ষকে।
“যে বিষয়টার মধ্যে শাহর গুরুত্ব নিহিত, সেটা হল, তিনি মোদীর জন্য সবচেয়ে ভালো ফলটা বের করে আনতে সক্ষম। তিনি এমন অনেক কিছু করতে পারেন, যা মোদী পারেন না। তিনি মোদীর জন্য দরকারি, তিনি হলেন রোড রোলার; যিনি মোদীর পথের বাধাগুলো সমান করে দেন,” বলেন কিংশুক নাগ।
অমিত শাহর অনেক সমালোচক তার বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলতে চাননি। বলেছেন, তারা তাকে সত্যিই ভয় পান। কিছু আমলা বলেছেন, তারা শাহর ‘ভয় জাগানো দৃষ্টি, পাথরের মত চোখ আর অনুভূতিশূন্য মুখ’ দেখে ঘাবড়ে যান।
গুজরাটেই উত্থান
অমিত শাহ রাজনৈতিক কারিকুরি শিখেছেন তার নিজ রাজ্যে; বছরের পর বছর ধরে তিনি নিজেকে নরেন্দ্র মোদীর ডান হাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
১৯৮৭ সাল থেকে তাকে চেনেন এমন একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী আরডি দেশাই। তিনি বলেছেন, “তিনি (শাহ) প্রতিভা খুঁজে বের করতে পারদর্শী। যাদের মধ্যে সম্ভাবনা দেখেন, সেই তরুণদের তিনি সমর্থন দিয়ে যান। কিন্তু রাজনীতিতে আসার পর দেড় দশকের বেশি সময় তিনি নিজে কোনো নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি, বলেছেন ‘আগে আমাকে সংগঠন গড়তে হবে’।”
অমিত শাহর এই অন্তর্দৃষ্টির কথা তার প্রথম দিককার সহকর্মীরা জোর দিয়ে বলে থাকেন। তাদের ভাষায়, অমিত শাহ সবসময় লম্বা পাল্লার দৌড়ে বিশ্বাসী।
অমিত শাহ প্রথমবার গুজরাট বিধানসভার সদস্য নির্বাচিতন হন ১৯৯৭ সালে। নরেন্দ্র মোদী তাকে বিধানসভার সারখেজ আসনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন।
১৯৯৮, ২০০২ ও ২০০৭ সালেও একই আসন থেকে জয়ী হন শাহ। ২০০৮ সালে আসনটি বিলুপ্ত হওয়ার পর তিনি নারায়ণপুরায় চলে যান।
২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে (লোকসভা) অমিত শাহ প্রার্থী হননি। তবে ২০১৯ সালে গান্ধীনগর থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং এবারও তিনি একই আসন থেকে বিজেপির প্রার্থী।
২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গুজরাটে সম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং তার পরের ঘটনাপ্রবাহ মোদী-শাহ সম্পর্কের নতুন পটভূমি তৈরি করে, পরে যা আরো বিকশিত হয়েছে। সেই দাঙ্গায় ১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়, যাদের অধিকাংশই মুসলমান।
মোদী তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধের চেষ্টা না করার অভিযোগে তিনি সমালোচিত হন।
তবে মোদীর দাবি, তিনি কোনো অন্যায় করেননি এবং আদালতও তাকে ওই মামলা থেকে খালাস দেয়।
দাঙ্গার কয়েক মাস পরে বিজেপি যখন ধর্মীয়ভাবে দারুণ বিভক্ত গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করল, অমিত শাহকে তখন একডজন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হল।
রাজ্য পুলিশ এবং প্রসিকিউশন তখন অমিত শাহর অধীনে। দাঙ্গা নিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিল তার অধীনে থাকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিছু মামলার তদন্তে গাফিলতির জন্য সুপ্রিম কোর্টে ভর্ৎসনার শিকার হয়েছিলেন তদন্তকারীরা। এটিকে ‘ন্যায়বিচারের বিচ্যুতি’ হিসেবে বর্ণনা করেছিল ভারতের শীর্ষ আদালত।
গুজরাট সরকারও তখন আদালতে স্বীকার করেছিল যে, মামলা নথিভুক্ত করার ক্ষেত্রে রাজ্য পুলিশের পক্ষ থেকে এবং সাক্ষীদের প্রমাণ রেকর্ড করার ক্ষেত্রে প্রসিকিউশনের কিছু ‘ত্রুটি’ হয়েছে।
দাঙ্গায় ভূমিকার জন্য অমিত শাহর বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল উঠেছে বছরের পর বছর ধরে। সেসব অভিযোগ তিনি বরাবরই অস্বীকার করে গেছেন। পাল্টা দাবি করেছেন, তদন্ত সঠিকভাবে করা হয়নি।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রাজীব শাহ তখন সারখেজে একটি অ্যাপার্টমেন্টের মালিক ছিলেন। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় তিনি লেখেন, দাঙ্গার পর যখন তিনি এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করতে বলেছিলেন, অমিত শাহ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তার বাড়ি হিন্দু নাকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায়।
"আমি যখন তাকে জায়গাটা বললাম, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, 'অস্থির হবেন না। আপনার কিছুই হবে না। ঘটনা যাই ঘটুক, অন্য দিকে ঘটবে’।"
বিবিসি লিখেছে, এসব বিষয়ে কথা বলতে অমিত শাহর অফিসে যোগাযোগ করে কোনো সাড়া পায়নি তারা।
খুনের অভিযোগ ও জেলখানার দিনগুলো
২০০৮ সালে অমিত শাহর জীবন জটিল হয়ে উঠতে থাকে। তিন বছর আগে, ২০০৫ সালে সোহরাবুদ্দিন শেখ এবং তার স্ত্রী কউসার বাইকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার জন্য অমিত শাহকে দায়ী করা হয় সে সময়।
অমিত শাহ ওই অভিযোগ ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে অস্বীকার করেন। তারপরও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১০ সালে তার বিরুদ্ধে হত্যা ও অপহরণের অভিযোগও আনা হয়।
নরেন্দ্র মোদীর উত্তরসূরি হিসেবে গুজরাটের ভবিষ্যৎ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাকেই দেখছিল রাজ্যের মানুষ। তবে ওই ঘটনাপ্রবাহে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল এবং তিন মাসের বেশি তাকে জেল খাটতে হয়েছিল।
অমিত শাহ জামিনে মুক্তি পেলে সাক্ষীদের প্রভাবিত করা থেকে বিরত রাখতে তাকে গুজরাট ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত।
সেই কারাবাসের কথা স্মরণ করে গত ডিসেম্বরে অমিত শাহ বলেছিলেন, সেটা ‘কঠিন সময়’ ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে কীভাবে তিনি একজন হাজতিতে পরিণত হয়েছিলেন, সে কথাও তিনি স্মরণ করেন।
অমিত শাহর সঙ্গে আরএসএস সেবক হিতেশ বারোতের প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। হিতেশের ভাষায়, ওই কঠিন সময় আসলে ছিল অমিত শাহর জন্য ভগবানের পরীক্ষা, শেষ পর্যন্ত তিনি ঠিকই শীর্ষে উঠে এসেছেন।
তার দাবি, অভিযোগের সঙ্গে অমিত শাহর তার কোনো সম্পর্ক ছিল না, সেটা ছিল ‘ভুয়া অভিযোগ’।
জেল থেকে অমিত শাহর মুক্তির পরপরই দিল্লিতে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন দেশাই। তার ভাষায়, সমস্যাকে সম্ভাবনায় পরিণত করেছিলেন শাহ।
“তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এই সময়টা দিল্লিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে এবং মোদীকে ক্ষমতায় বসাতে ব্যবহার করব’।”
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ছয় মাস পর আদালত অমিত শাহকে খালাস দেয়। বিচারক এমবি গোসাভি রায়ে বলেন, তার (অমিত শাহ) বিরুদ্ধে অভিযোগ ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’।
যদিও কেন্দ্রীয় পুলিশ ২০১০ সালের জুলাইয়ে চার্জশিটে অমিত শাহর বিরুদ্ধে ‘তদন্তে হস্তক্ষেপের’ অভিযোগ এনেছিল। তবে তিনি খালাস পাওয়ার পর পুলিশ আর আপিল করেনি।
অভিযোগ উঠেছিল, পুলিশ বিজেপির ক্ষমতাবানদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছে। যদিও পুলিশ তা অস্বীকার করে।
অমিত শাহর খালাসের সেই রায় একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। তার কিছুদিন আগে সেই মামলার বিচারক মারাত্মক হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরিবারের সদস্যরা তখন অভিযোগ করেন, তার মৃত্যু ‘সন্দেহজনক’ ছিল এবং তাকে ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।
এর কোনোটাই কখনও প্রমাণিত হয়নি। বিষয়গুলো তদন্তের আর্জি সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে দিয়েছিল।
বিবিসি লিখেছে, বিচারকের পরিবারের অভিযোগের বিষয়ে তাদের প্রশ্নের জবাব দেয়নি অমিত শাহর দপ্তর।
‘আমরা এবং তারা’
নেতা এবং গুরু মোদীর মত প্রায়ই ‘ঐতিহাসিক ভুলগুলো’ সংশোধন করার কথা বলেন অমিত শাহ, যেসব ‘ভুলের’ সূচনা হয়েছে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় থেকে।
কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা এবং বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) প্রবর্তন, যা পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তানের অমুসলিম ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য করা হয়েছে; সেগুলোকে তিনি ‘ভুল সংশোধন’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে গেছেন।
সিএএ নিয়ে বিশ্বজুড়ে নিন্দা কুড়িয়েছে ভারত। কারণ এর ফলে ভারতের ২০ কোটির বেশি মুসলিমের বিরুদ্ধে সহিংসতা বেড়ে গেছে, যে প্রবণতা শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে থেকে।
অবৈধ মুসলিম অভিবাসীদের ‘উঁই পোকা’ হিসেবে বর্ণনা করায় এবং তাদের ‘বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করার’ হুমকি দেওয়ায় ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার কর্মীরা এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অমিত শাহর সমালোচনায় মুখর হয়েছিল।
নির্বাচনী সমাবেশে তিনি নিয়মিতভাবে বলেন ‘আমরা এবং তারা’। সেই ‘তারা’ হল মুসলমানরা।
কিছু বিশ্লেষক অমিত শাহর ভাষাকে বর্ণনা করেন ‘উগ্র প্রচারণা’ হিসেবে। তবে যতিন ওঝার ভাষায়, ওই বিষয়টি বিজেপি নেতার মজ্জায় মিশে আছে।
“আমি সত্যিই জানি না কেন? তবে আমি যেদিন তার সঙ্গে প্রথম দেখা করি, সেদিনই দেখেছিলাম এবং আজ পর্যন্ত তার রাগ, তার কুসংস্কার, এবং মুসলমানদের প্রতি তার বিদ্বেষ একই রকম আছে। তার ঘৃণা এবং বর্জনের নীতি একই রকম রয়ে গেছে, এটা একেবারেই অনমনীয়।”
বিবিসি লিখেছে, অমিত শাহর অফিস এ বিষয়েও তাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়নি।
তবে তার বাল্যবন্ধু সুধীর দর্জি এ বিষয়ে একমত নন। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, “তিনি (শাহ) কখনোই মুসলমানদের বিরুদ্ধে কিছু বলবেন না বা করবেন না। তার লক্ষ্য সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।”
গুজরাটে সবচেয়ে বড় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা জুহাপুরার (অমিত শাহর নির্বাচনী এলাকায় পড়ে) বাসিন্দারা বিবিসিকে বলেছেন, তাদের এমপি তাদের ‘অবহেলা’ করেন।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করেও অমিত শাহর অফিসের কোনো জবাব পায়নি বিবিসি।
দুর্নীতির অভিযোগ
নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ প্রায়ই প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। তবে ২০১৭ সালে দ্য অয়্যার নামে একটি নিউজ পোর্টাল অমিত শাহর একমাত্র ছেলে ব্যবসায়ী জয় শাহর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোল। তখন জয়কে বাঁচাতে অমিত শাহর পাশে দাঁড়িয়েছিল বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
জয় শাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর তার ব্যবসা ১৬ হাজার গুণ বেড়েছে। তবে জয় শাহ ও তার বাবা অভিযোগ অস্বীকার করেন। তারা প্রতিবেদনটিকে ‘মিথ্যা, অবমাননাকর এবং মানহানিকর’ আখ্যা দেন। তারা দ্য অয়্যারের বিরুদ্ধে মামলাও করেন। এখনও সে মামলার নিষ্পত্তি হয়নি।
বিরোধী নেতারা ২০২১ সালের জানুয়ারিতে অমিত শাহর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনেছিলেন। তখন তার ছেলে জয়কে ভারতের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সচিব করা হয়।
বিবিসি লিখেছে, অমিত শাহ যখন তার ছেলেকে রক্ষা করে যাচ্ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ছিলেন নীরব। শাহ তার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এটা তারও ইঙ্গিত।
ভারতের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী?
প্রধানমন্ত্রী মোদীর বয়স ৭৩ এবং তিনি সুস্থ আছেন। তাই শিগগির শীর্ষ পদটি শূন্য হওয়ার সুযোগ নেই।
তবে যখনই প্রশ্ন ওঠে– মোদীর পর কে? তখন ৬০ বছর বয়সী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহর নাম উঠে আসে। অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার কয়েকটি স্বাস্থ্যগত সমস্যার কথা সামনে এসেছে।
অমিত শাহ যদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণও করে থাকেন, তিনি তা কখনও প্রকাশ করেননি।
“তিনি মোদীর ডান হাত এবং কমান্ডার-ইন-চিফ। মোদী তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেন। এটা বলা যায়, শাহ তাকে ডিঙানোর চেষ্টা করবেন না,” বলছিলেন কিংশুক নাগ।
আর যতিন ওঝা বলেছেন, “অমিত শাহর বেলায় বিষয় সবসময়ই এরকম, ‘যদি মোদী না হন, তাহলে অন্য কেউ নন।”