ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিন কোথায় আছেন সে সম্পর্কে পরিষ্কার তথ্য নেই।
Published : 25 Jun 2023, 09:02 PM
ওয়াগনাররা যতটা আচমকা সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করেছিল, বেলারুশের প্রেসিডেন্টের মধ্যস্থতায় ততটা দ্রুতই সেই বিদ্রোহের অবসান হয়েছে। কিন্তু মস্কোর আকাশ থেকে সংকটের কালো মেঘ কী আসলেই কেটে গেছে। বিশেষজ্ঞরা অন্তত তেমনটা ভাবতে নারাজ।
শুক্রবার মধ্যরাতের পর থেকে শনিবার দিনভর প্রবল আক্রোশে মস্কোর দিকে অগ্রসর হয়েছে রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদের বাহিনী ওয়াগনার। মাত্র ২৪ ঘণ্টায় তারা এক হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে মস্কোর ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল। যদিও এই বিদ্রোহ রক্তপাতহীন ভাবেই শেষ হয়েছে।
তবে দেড় দিনের এ বিদ্রোহ রাশিয়ার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবেই লিপিবদ্ধ থাকবে। পুরো বিশ্ব গভীর সংশয় নিয়ে শনিবার দিনভর চলা এ ঘটনার উপর নজর রেখেছে। আর ইউক্রেইনে হয়েছে উল্লাস।
বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় ওয়াগনার প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন তার বাহিনীকে ফিরিয়ে নিয়েছেন এবং তারা ফিল্ড ক্যাম্পে ফিরে গেছে।
প্রিগোজিন একসময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাকে ‘পুতিন্স শেফ’ নামে ডাকা হতো।
প্রিগোজিনের সঙ্গে একটি সমঝোতায় এসেছে ক্রেমলিন। সে সমঝোতার বিস্তারিতও প্রকাশ করা হয়েছে।
কিন্তু এখনো অনেক কিছুই ধোঁয়াশার মধ্যে রয়ে গেছে। তাই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, বিরল এই বিদ্রোহ কোনো পরিণতি ছাড়াই এত দ্রুত শেষ হওয়ার কথা না।
দাপটের সঙ্গে গত ২৩ বছর ধরে রাশিয়াকে শাসন করে যাওয়া পুতিনকে এই প্রথম এতটা গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই নিজের শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে বিদ্রোহ পরবর্তী অবস্থায় তাকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সব দিক হিসাবনিকাশ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
সর্বশেষ যা জানা গেছে:
ওয়াগনারের মাথাগরম প্রধান প্রিগোজিন রাশিয়া ছেড়ে বেলারুশে চলে যেতে রাজি হয়েছেন বলে জানিয়েছে ক্রেমলিন।
শনিবার সন্ধ্যায় ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এমনটাই বলেছেন বলে জানিয়েছে আরটি।
পেসকভ বলেন, ‘‘রাশিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার বিনিময়ে প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে হওয়া ফৌজদারি মামলা তুলে নেওয়া হবে।”
‘‘এছাড়াও ইউক্রেইন যুদ্ধে বীরত্ব বিবেচনায় বিদ্রোহে অংশ নেওয়া ওয়াগনার যোদ্ধাদের বিচারের আওতায়ও আনা হবে না।
“ভ্লাদিমির পুতিনের সরকার এই যোদ্ধাদের অবদানকে যথেষ্ট শ্রদ্ধার চোখে দেখে,” বলেছেন পেসকভ।
আর ওয়াগনারের যেসব যোদ্ধা বিদ্রোহে অংশ নিতে রাজি হয়নি, এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ইউনিটও আছে, তাদেরকে রুশ প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন ক্রেমলিন মুখপাত্র।
এর আগেও ওয়াগনার বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রিগোজিন ওই প্রস্তাবে রাজি হননি।
ইউক্রেইন যুদ্ধে রাশিয়ার সবচেয়ে আগ্রাসী ইউনিটের স্বীকৃতি পেয়েছে ভাড়াটে সেনাদের দল ওয়াগনার বাহিনী। যাদের নেতৃত্বে তীব্র লড়াইয়ের পর গত মাসে রাশিয়া ইউক্রেইনের গুরুত্বপূর্ণ বাখমুত শহরের দখল পায়।
বাহিনীটির প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন পুতিনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তবে ইউক্রেইন যুদ্ধের মধ্যে তার সঙ্গে রুশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের বিরোধ প্রায়ই বিশ্ব গণমাধ্যমের নজর কাড়ছিল।
প্রিগোজিন বর্তমানে কোথায় আছেন তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি। ক্রেমলিনের কাছেও তার অবস্থানের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই বলে শনিবার জানিয়েছেন পেসকভ।
তবে শনিবার ওয়াগনার বাহিনী রাশিয়ার দুইটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অবকাঠামোর দখল নেওয়ার যে দাবি করেছিল তার একটি রস্তোভ-অন-দন থেকে প্রিগোজিন ও তার বাহিনীর সরে যাওয়ার একটি ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে। ওই ভিডিও সত্যতা যাচাই করেছে সিএনএন।
এরপর প্রিগোজিন ও ওয়াগনারের কী হবে:
ওয়াগনার বাহিনীতে প্রিগোজিনের ভূমিকা এরপর কী হবে, ইউক্রেইন যুদ্ধেই বা তার ভূমিকা কী হতে চলেছে, তার বাহিনীর সবাই রাশিয়ার সেনাবিহনীর সঙ্গে চুক্তি করতে চলেছে কিনা, এমন অনেক কিছুই এখনো অস্পষ্ট।
প্রিগোজিন রাশিয়া ছেড়ে বেলারুশ চলে যাচ্ছেন বলে জানালেও সেখানে তার ভূমিকা কী হতে চলেছে সে বিষয়ে শনিবার কিছুই জানাননি ক্রেমলিন মুখপাত্র। তিনি বলেন, তিনি এসব প্রশ্নের ‘উত্তর দিতে পারবেন না’।
বেলারুশে চলে যাবেন প্রিগোজিন, তুলে নেওয়া হবে মামলা: ক্রেমলিন
নিজ দেশে রক্তপাত এড়াতে পারলেন পুতিন?
প্রিগোজিন নিজেও মস্কো অভিমুখে ‘যুদ্ধযাত্রা’ বাতিল করার চুক্তির বিষয়ে খুব সামান্য তথ্যই দিয়েছেন।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজর মাইক লায়ন্স বলেন, ওয়াগনার গ্রুপ একটি ‘স্বাধীন যোদ্ধা কোম্পানি’। রাশিয়ার সেনাবাহিনী থেকে তারা সম্পূর্ণ আলাদা। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়, রাশিয়ার সেনাবাহিনীর তুলনায় ওয়াগনার যোদ্ধারা বেশি সুযোগ সুবিধা পায়।
তিনি বলেন, ‘‘হয়তো কেউ কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
‘‘তবে ওয়াগনার যোদ্ধারা প্রিগোজিনের অনুগত, দেশ বা মিশনের প্রতি তাদের আনুগত্য নেই। আমার মনে হয়, আমাদের সামনে এখনো অনেক প্রশ্ন রয়েছে যেগুলোর উত্তর এই মুহূর্তে পাওয়া যাবে না।”
তবে বিপদ শুধু মস্কোর মাথার উপরই রয়ে গেছে বিষয়টা এমন নয় বলেও মত বিশেষজ্ঞদের। বরং প্রিগোজিনের বিপদও এখনো কাটেনি।
মস্কোয় সিএনএন এর সাবেক ব্যুরো প্রধান এবং দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ জিল ডগার্টি বলেন, ‘‘পুতিন বিশ্বাসঘাতকদের কখনো ক্ষমা করেন না। যদিও পুতিন বলেছেন, ‘প্রিগোজিন, আপনি বেলারুশ চলে যান’,। কিন্তু তিনি এখনো একজন বিশ্বাসঘাতকই রয়ে গেছেন এবং আমার মনে হয়, পুতিন তাকে কখনো ক্ষমা করবেন না।”
তাই বেলারুশে প্রিগোজিনকে ‘হত্যা করা হতে পারে’ বলেই মনে করেন জ্যেষ্ঠ এই সাংবাদিক।
তিনি এও বলেন, মস্কোর জন্য প্রিগোজিন এখন কঠিন এক দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে।
‘‘কারণ, যতদিন পর্যন্ত প্রিগোজিনের এক ধরণের সমর্থন থাকবে, তিনি মস্কোর জন্য হুমকি হয়েই থাকবেন, তা তিনি যেখানেই অবস্থান করুন না কেনো।”
পুতিনের জন্য এই বিদ্রোহের অর্থ কী:
বিদ্রোহ দ্রুত দমন করা সম্ভব হলেও পুতিনকে এখন সত্যিকারের কিছু সংকটে পড়তে হবে।
বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে সিএনএনকে বলেছেন, পুতিন সম্ভাব্য অভ্যুত্থান থেকে রক্ষা পেলেও বাকি বিশ্ব এবং তার শত্রুরা এখন তাকে দুর্বল বলে ধরে নেবে।
ডগার্টি বলেন, ‘‘যদি আমি পুতিনের জায়গায় থাকতাম, তবে ওয়াগনাররা ফিরে যাওয়ার সময় রস্তোভের সড়কগুলোতে যেভাবে লোকজন তাদের দিকে হাসি মুখে হাত নাড়তে নাড়তে অভিবাদন জানাচ্ছিল তা নিয়ে চিন্তিত হতাম।”
সিএনএন এমন একটি ভিডিওর সত্যতা যাচাই করে নিশ্চিত হয়েছে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, প্রিগোজিনের গাড়ি যখন রস্তোভ-অন-দন নগরী ছেড়ে যাচ্ছিল তখন উচ্ছ্বসিত জনতা হাত নেমে তাকে অভিবাদন জানাচ্ছিল। সেখানে এক ব্যক্তিকে প্রিগোজিনের গাড়ি থামিয়ে তার সঙ্গে করমর্দন করতেও দেখা যায়।
সৈন্যদল ফিরে যাবে: ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিন
পুতিনের নিন্দার জবাবে বিদ্বেষ ঝরালেন ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিন
প্রিগোজিনকে বেলারুশে পাঠিয়ে উভয়পক্ষ নিজেদের মুখ রক্ষা করতে পেরেছে বটে।
কিন্তু বিদ্রোহের এই ঘটনায় শেষ পর্যন্ত পুতিনের ইমেজ নষ্ট হয়েছে এবং বিশ্বের সামনে তার দুর্বল ভাবমূর্তির প্রকাশ পেয়েছে বলে মনে করেন রাশিয়া বিষয়ে সিআইএ-র সাবেক প্রধান স্টিভ হল।
তিনি সিএনএনকে বলেন, ‘‘পুতিনের উচিত ছিল অন্তত মাস কয়েক আগে হলেও এমন একটি ঘটনার পূর্বাভাস পাওয়া। দেখা যাক এটা কিভাবে শেষ হয়। তবে আমার মনে হয়, এই ঘটনার শেষ এখনো হয়নি।”