ইসরায়েল আদালতে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে ‘হত্যাকারীদের সঙ্গে ভুক্তভোগীদের’ তুলনা করা হয়ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে হামাস।
Published : 20 May 2024, 07:54 PM
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এবং হামাসের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি।
সোমবার আইসিসির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রধান কৌঁসুলি করিম এ এ খানের একটি বিবৃতিতে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলি ভূখণ্ডে গত আট মাস ধরে চলা যুদ্ধে উভয় পক্ষের নেতাদের বিরুদ্ধে প্রায় একই অভিযোগ আনা হয়েছে।
এ ঘটনার পর দুই পক্ষই ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ইসরায়েল আদালতে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে ‘হত্যাকারীদের সঙ্গে ভুক্তভোগীদের’ তুলনা করা হয়ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে হামাস।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে আইসিসির প্রি-ট্রাইল চেম্বার ১-এ আবেদন করেছেন করিম খান।
তিনি বলেছেন, “তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনার বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণ রয়েছে।”
বিবিসি জানিয়েছে, গত তিন বছরে অধিকৃত অঞ্চলে (ফিলিস্তিন) ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড (নৃশংসতা) এবং অতি সম্প্রতি সেখানে হামাসের কর্মকাণ্ডেরও তদন্ত করছে হেগভিত্তিক আইসিসি।
নেতানিয়াহু সম্প্রতি আভাস দিয়েছিলেন, জুলুম-নির্যাতনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ধরে আইসিসির ‘গ্রেপ্তারি পরোয়ানার তালিকা’য় ইসরায়েলের শীর্ষ নেতাদের যুক্ত করা হতে পারে।
আইসিসির বিবৃতিতে করিম খান বলেছেন, তার কার্যালয়ের সংগ্রহ করা তথ্যপ্রমাণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনে (গাজা উপত্যকা) যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় ইয়াহিয়া সিনওয়ার, মোহাম্মদ দিয়াব ইব্রাহিম আল-মাসরি ওরফে দেইফ এবং ইসমাইল হানিয়ার ওপর বর্তায়।
তাদের মধ্যে ইয়াহিয়া সিনওয়ার ইসলামিক রেজিস্ট্যান্ট মুভমেন্টের (হামাস) প্রধান, দেইফ রয়েছেন কাসেম ব্রিগেডের নেতৃত্বে এবং হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ইসমাইল হানিয়া।
করিম খান বলছেন, সিসিটিভি ভিডিও, বিশ্বাসযোগ্য অডিও-ভিডিও ও ছবি এবং হামাস নেতাদের বিবৃতি পর্যালোচনা করে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরায়োনা চাওয়া হয়েছে। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আলাদাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
হামাসের এই তিন নেতার প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আটটি করে ধারায় অভিযোগ এনে গ্রেপ্তারের আবেদন করা হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার চেষ্টা, হত্যা, জিম্মি করা, ধর্ষণ, যৌন সহিংসতা ও নির্যাতন।
আর ইসরায়েলের বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর হামাসের বৃহৎ পরিসরে কাঠামোবদ্ধ হামলাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলার ঘটনায় হামাস নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার দাবি করে এখনও তাদের হাতে জিম্মি ইসরায়েলিদের অবিলম্বে মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন করিম খান।
আইসিসিতে করা আবেদনে করিম খান বলেছেন, নেতানিয়াহু ও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণ’ তাদের কাছে রয়েছে।
তার ভাষ্য, ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের নেতৃত্ব এসব অপরাধ সংঘটন করেছেন। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে সাতটি করে ধারায় অভিযোগ এনে গ্রেপ্তারের আবেদন করা হয়েছে।
যুদ্ধের কৌশল হিসেবে সাধারণ মানুষকে (ফিলিস্তিনি) অনাহারে ভোগানো, হত্যাযজ্ঞ, ইচ্ছা করে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা ও জাতিগত নির্মূল অভিযান চালানোর মতো অপরাধের ধারা আনা হয়েছে ইসরায়েলি নেতাদের বিরুদ্ধে।
আদালতে পেশ করা অভিযোগগুলো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির করার জন্য যথেষ্ঠ কিনা, তা এখন পর্যালোচনা করে দেখবেন আইসিসির বিচারকরা। এ ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বিচারকরা কয়েক সপ্তাহ থেকে দুই মাস পর্যন্ত সময় নিতে পারেন।
হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা সামি আবু জুহরি রয়টার্সকে বলেছেন, তাদের তিন নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চাওয়ার মধ্য দিয়ে ‘হত্যাকারী ও ভুক্তভোগী’কে সমান করে ফেলা হয়েছে বলে তারা মনে করছেন।
এ পদক্ষেপ ইসরায়েলকে ‘গণহত্যা’ চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করবে বলে আশঙ্কা তার।
তবে এর বিরুদ্ধে আইসিসিতে তারা আইনি লড়াইয়ে যাবেন কিনা, সে বিষয়ে কিছু তিনি বলেননি।
আইসিসিতে আবেদন জমা পড়ার ঘোষণা আসার পরপরই ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ বলেছেন, বিষয়টি আইনিভাবে মোকাবিলায় একটি ‘বিশেষ কমান্ড সেন্টার’ গঠন করবে তার দেশ। আইসিসির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লড়বেন তারা।
ইসরায়েল রাষ্ট্রের ‘হাত বেঁধে ফেলা এবং আত্মরক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার মতলবে’ আইসিসিতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ কাৎজের। মিত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আদালতে তারা যেন বিরোধিতা করে, সে বিষয়ে সবার সঙ্গে কথা বলবেন তিনি।
তিনি বলেন, কোনো শক্তিই ইসরায়েলকে জিম্মি মুক্ত করা এবং ‘হামাসের পতন ঘটানো’ থেকে বিরত রাখতে পারবে না।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে আকস্মিক হামলা চালায় হামাস। তাতে সহস্রাধিক ইসরায়েলি নিহত হয় বলে দাবি করে আসছে দেশটি। হামলার প্রতিশোধ নিতে এক দিন পর ৮ অক্টোবর থেকে পাল্টা হামলা শুরু করে নেতানিয়াহু সরকার।
অনেক দেশ, সংস্থা ও বিভিন্ন পক্ষ আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েল ও নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’, ‘নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ’ ও ‘জাতিগত নিধন’ অভিযান চালানোর অভিযোগ এনেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার এ-সংক্রান্ত মামলায় গাজায় ‘গণহত্যা’ বন্ধের আহ্বান জানায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)।
গাজা উপত্যকায় গত আট মাসে ইসরায়েলের ধারাবাহিক হামলায় ৩৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। নিহতদের মধ্যে শিশুই সংখ্যাই বেশি।