পাকিস্তান-ভিত্তিক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার শাখা ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলার দায় স্বীকার করেছে।
Published : 23 Apr 2025, 08:06 PM
ভারত-শাসিত কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র পহেলগামে মঙ্গলবার ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলায় ২৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত আরও ১০ জন। কাশ্মীরে ঘুরতে গিয়ে তারা এই হামলার শিকার হয়েছেন। প্রিয়জন হারিয়েছেন নানা প্রান্তের মানুষ।
‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামের একটি জঙ্গি সংগঠন এই ভয়াবহ হামলার দায় স্বীকার করেছে। এই সংগঠনটি পাকিস্তান-ভিত্তিক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা। টিআরএফ এর পেছনে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর সমর্থন আছে বলে ধারণা করা হয়।
লস্কর ই তৈয়বার প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারতের মুম্বাইয়ে ২৬/১১ সন্ত্রাসী হামলার হোতা হাফিজ মহম্মদ সাঈদ সেই সময় যে সব ‘ছায়া সংগঠন’ গড়ে তুলেছিলেন, সেই সূত্রেই গড়ে উঠেছিল ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) -এর মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো।
এনডিটিভি জানায়, টিআরএফ এর দেওয়া এক বার্তায় বলা হয়েছে, কাশ্মীরে ৮৫ হাজারের বেশি ‘বহিরাগত’-কে বাসস্থান (ডোমিসাইল) দেওয়া হয়েছে। এতে সেখানকার জনমিতি পাল্টে যাওয়ার কারণেই তাদের এই হামলা।
এই জঙ্গি সংগঠনটি বলছে, “কাশ্মীরের ওই বহিরাগতরা পর্যটক সেজে এসে বাসস্থান দখল করে এমন ভাব করছে যেন এই ভূমি তাদের নিজেদের । তাই অবৈধভাবে স্থায়ী নিবাস গড়ার এই চেষ্টা রুখতে তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার পথই বেছে নিতে হবে।”
গত মঙ্গলবার স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ৪৫ থেকে ৩টার মধ্যে টিআরএফ জঙ্গিরা হামলা চালায় দক্ষিণ কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার বেইসারান উপত্যকায়। পর্যটনে মেতে ওঠা এক উজ্জ্বল দুপুর মুহূর্তেই রূপ নেয় রক্তাক্ত বিভীষিকায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সেনা পোশাকে ২ থেকে ৩ জন বন্দুকধারী হঠাৎ পাশের জঙ্গল থেকে বের হয়ে পর্যটকদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে।
হামলার পরপরই এলাকা জুড়ে নেমে আসে আতঙ্ক। গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ থাকায় এবং এলাকাটিতে কেবল হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া যায় বলে ঘটনাস্থল থেকে আহতদের দ্রুত সরিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এতে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কাও আছে।
কাশ্মীরের 'মিনি সুইজারল্যান্ড' নামে খ্যাত বেইসারান উপত্যকা পহেলগাম শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার উঁচুতে অবস্থিত। যার বিস্তৃত সবুজ মাঠ আর চারপাশের পাইন বনের সৌন্দর্য, বরফে ঢাকা পর্বতশৃঙ্গের পটভূমিতে এই উপত্যকা বহু পর্যটকের গন্তব্য- বিশেষত ছবি তোলা, ক্যাম্পিং এবং ট্রেকিংয়ের জন্য।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে্য ভরা এ উপত্যকাটি জঙ্গি হামলার ঘটনায় পরিণত হয়েছে বিপদ এবং আতঙ্কের জনপদে। নিরাপত্তা বাহিনী এখন আশেপাশের জঙ্গলে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে। তদন্ত চলছে কীভাবে পর্যটনসমৃদ্ধ এই এলাকায় এত সহজে জঙ্গিরা ঢুকে হামলা চালাতে পারল।
হামলার এই ঘটনা কেবল প্রাণই কেড়ে নেয়নি, প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে পর্যটন-নির্ভর কাশ্মীরের নিরাপত্তা নিয়েও।
‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ এর উত্থান:
২০১৯ সালে ভারতের সংবিধান থেকে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর লস্কর ই তৈয়বার ছায়া সংগঠন হিসাবে ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) জঙ্গি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
শুরুর দিকে এই সংগঠনের উপস্থিতি ছিল কেবল অনলাইনে। পরে ছয়মাসের মধ্যেই পুরোদস্তুর এক সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত হয় টিআরএফ।
উপস্থিতি জানান দিতে লস্কর, জৈশ-ই-মহম্মদ, তেহরিক-ই-মিল্লাত, ইসলামিয়া এবং গজনবী হিন্দের মতো একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠী থেকে এই সংগঠনে সদস্যদের নিযুক্ত করা হয়েছিল।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, টিআরএফ জম্মু-কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারাসহ নিরীহ মানুষজনকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত ছিল। অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে অস্ত্র সরবরাহ করা এবং সমন্বয় করা, সন্ত্রাসীদেরকে দলে ভেড়ানো, সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশ ঘটানো এমনকী সীমান্ত এলাকাজুড়ে অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানেও তারা জড়িত ছিল।
২০২৩ সালে টিআরএফ-কে অবৈধ কর্মকাণ্ড রোধক একটি আইনের আওতায় ‘সন্ত্রাসবাদী সংগঠন’ হিসাবে ঘোষণা করেছিল ভারতের কেন্দ্র সরকার। জারি হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা।
টিআরএফ এর সুপ্রিম কমান্ডার শেখ সাজ্জাদ গুল। নতুন জঙ্গি সংগঠন তৈরির আগে গুল ছিলেন লস্কর-ই-তৈয়বার কমান্ডার।
লস্কর ও জৈশ-ই-মোহম্মদের পাশাপাশি মূলত কাশ্মীরিদের নিয়ে গঠিত জঙ্গিগোষ্ঠী হিজবুল মুজাহিদিনের দলছুট গোষ্ঠীর কমান্ডার মাইসের আহমেদও পরবর্তীতে সামিল হয়েছিলেন টিআরএফ- এ।
২০২৩ সালের নভেম্বরে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছিলেন মাইসের। কিন্তু ততদিনে টিআরএফ-এর জাল ছড়িয়ে পড়েছিল কাশ্মীরের গভীরে।
গতবছর জুন মাসে জম্মু-কাশ্মীরের রেইসি জেলায় পুণ্যার্থীদের একটি বাসে হামলা হয়। তাতে মৃত্যু হয়েছিল অন্তত ১০ জন পুণ্যার্থীর। সেই হামলার নেপথ্যেও ছিল টিআরএফ।