Published : 05 May 2025, 06:15 PM
একশ চল্লিশ কোটি ক্যাথলিকের নতুন ধর্মগুরু নির্বাচনের প্রক্রিয়ার দ্বারপ্রান্তে বিশ্ব। একদিন পরই শুরু হচ্ছে মহা গোপনীয় কনক্লেভ, যা বাইরের দুনিয়া থেকে থাকবে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন।
চিমনি দিয়ে বের হওয়া সাদা ধোঁয়ায় দুনিয়া নতুন পোপ পাওয়ার আনুষ্ঠানিক খবর জানবে। ততক্ষণ ১৩৩ কার্ডিনালকে থাকতে হবে নির্দিষ্ট ঘেরাটোপে। তাদের জন্য থাকবে নির্ধারিত আচরণবিধি, আর খাবার।
বিবিসি লিখেছে, পোপ নির্বাচনের গোপন প্রক্রিয়া কনক্লেভ ঘিরে শতাব্দীর পর শতাব্দীর চলছে কড়া বিধিনিষেধ। ৭৫০ বছরের বেশি সময় ধরে, এমনকি খাবারের মাধ্যমেও বার্তা আদান-প্রদানের আশঙ্কায় মুরগি, র্যাভিওলি কিংবা ন্যাপকিন—সবকিছুর ওপর চলে কড়া নজরদারি।
গত সপ্তাহে রোম ঘুরতে আসা পর্যটকরা হয়তো কার্ডিনালদেরকে তাদের প্রিয় রেস্তোরাঁগুলোতে ঘন ঘন যেতে দেখেছেন। যেমনটা হয়েছে ২০১৩ সালেও।
সেবারও ভ্যাটিকানে নতুন পোপ নির্বাচনের আগে কার্ডিনালদের দেখা যাচ্ছিল রোমের পরিচিত সব রেস্তোরাঁতে। তার মধ্যে এক রেস্তোরাঁতেই যাচ্ছিলেন বেশিরভাগ, ‘আল পাসেত্তো দি বোরগো’।
সেইন্ট পিটার’স ব্যাসিলিকা থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরের এই রেস্তোরাঁটি চালায় একটি পরিবার, সেখানেই মার্কিন কার্ডিনাল ডনাল্ড উইলিয়াম ওয়ুর্ল অর্ডার করেছিলেন লাসাগনা, আর ইতালির ফ্রানচেস্কো কোক্কোপালমেরিও পছন্দ করেছিলেন গ্রিলড স্কুইড।
একইভাবে এবারও হয়তো কার্ডিনালরা এক বা দুইবেলা পছন্দের খাবার খেয়ে নেওয়ার তাগাদা অনুভব করছেন। কারণ, বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে পোপ নির্বাচনের কনক্লেভ, যেখানে তাদের ঘুম, খাবার, ভোটপ্রদান সবই থাকবে নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে বন্দি।
কনক্লেভের গোপনীয়তা নিয়ে নানান মিথ আছে। তবে সাধারণভাবে সবাই যেটা জানে, তা হল- কার্ডিনালদের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ থাকে। কেবল এক উপায়েই তারা খবর পাঠাতে পারেন, সেটা হচ্ছে ধোঁয়া। কালো ধোঁয়া মানে আবার ভোট হবে, পোপ নির্বাচিত হতে হলে উপস্থিত কার্ডিনালদের দুই তৃতীয়াংশের বেশি ভোট লাগে। সেটা হয়ে গেলে আসবে সাদা ধোঁয়া। ভক্তরা প্রস্তুত হবে নতুন পোপকে বরণ করে নিতে।
এ পর্যন্ত পৌঁছাতে কয়েকদিন বা সপ্তাহও পেরিয়ে যেতে পারে। সেই সময়ে কার্ডিনালরা আর যা-ই করেন না করেন, খেতে তো হয়ই।
এই খাবার নিয়ে বিপদও তো কম নয়। কোনো এক কার্ডিনালের র্যাভিওলিতে কিচেন কর্মীদের মাধ্যমে অবৈধভাবে বার্তা পৌঁছে যেতে পারে, ময়লা রুমালের সাহায্যে কোনো কার্ডিনালওতো বাইরের দুনিয়ায় ভোটের খবর পৌঁছে দিতে পারেন। একসঙ্গে খেতে বসে দল পাকানো তো স্বাভাবিকই।
১২৭৪ সালে পোপ দশম গ্রেগরি কনক্লেভের গোপনীয়তা রক্ষায় কঠোর সব নিয়মকানুন বেধে দিয়েছিলেন, যার অনেকখানি এখনও কার্যকর আছে। যত পোপ নির্বাচিত হয়েছেন, তার মধ্যে তার নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক আছে। তাকে নির্বাচিত করতে ইতিহাসের দীর্ঘতম কনক্লেভ লেগেছিল। নির্বাচন শুরু হয়েছিল ১২৬৮ সালে, শেষ হয় ১২৭১ সালে।
সেই কনক্লেভে অংশ নেওয়া ইতালীয় ধর্মশাস্ত্রবিদ হেনরিকাস দে সেগুসিও পরে লিখেছেন—নির্বাচন নিয়ে বিরক্ত হয়ে স্থানীয়রা হুমকি দিয়েছিলেন, প্রয়োজনে কার্ডিনালদের খাবার কমিয়ে দেওয়া হবে, যাতে তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন।
এরপর দশম গ্রেগরি কঠোর গোপনীয়তা সম্বলিত নতুন সব নিয়ম চালু করেন। তাতে বলা হয়, কনক্লেভে অংশ নেওয়া কার্ডিনালদের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হবে। নতুন পোপ কে হবে সে ব্যাপারে তিন দিন পরও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারলে কার্ডিনালদের এরপর দিনে শুধু একবেলা খাবার দেওয়া হবে; আট দিন পেরিয়ে গেলে মিলবে শুধু রুটি আর পানি।
১৩শ শতকের মাঝামাঝি পোপ ষষ্ঠ ক্লেমেন্টের সময়ে এসে খাবার নিয়ে আগের নিয়ম শিথিল হয়। ষষ্ঠ ক্লেমেন্ট কার্ডিনালদের তিন বেলা খাবারই মঞ্জুর করা হয়, যাতে থাকে স্যুপ, মাছ-মাংস বা ডিমের প্রধান পদ এবং ফল বা চিজের মতো ডেজার্ট।
দশম গ্রেগরির ‘খাদ্যে রেশনিং’ এর সেই নিয়ম তো উঠে গেল, তবে থেকে গেল কনক্লেভ ঘিরে কঠোর গোপনীয়তা আর নানান বিধিনিষেধ।
কার্ডিনালদের কাছে খাবার কীভাবে পৌঁছায়? তার বর্ণনা মিলবে রেনেসাঁ যুগের সেলিব্রিটি রাঁধুনি বার্তোলোমেও স্কাপ্পির ১৫৭০ সালের ‘দ্য আর্ট অব কুকিং’ বইয়ে। পোপ তৃতীয় জুলিয়াসকে নির্বাচিত করা হয় যে কনক্লেভে, সেখানে কীভাবে খাবার যেত তার বর্ণনা আছে ওই বইতে।
স্কাপ্পি বলছেন, কার্ডিনালদের প্রতিদিনের খাবার তৈরি হতো একটি যৌথ রান্নাঘরে—রাঁধুনি ও সোমেলিয়ের (ওয়াইন পরিবেশক) হাতে, গোপন ধর্মসভা বা কনক্লেভ পরিচালনায় বহু গৃহস্থালি কাজ আছে, তার জন্য অনেককে দায়িত্বও দেওয়া হয়। তার মধ্যে এই দুটি পদও থাকে।
স্কাপ্পি জানান, যৌথ সেই রান্নাঘর ছিল এমন একটি স্থান, যেখানে বেআইনি বার্তা আদান-প্রদানের ঝুঁকি ছিল, এবং এজন্য সেখানে বিশেষভাবে প্রহরী মোতায়েন করা হতো। প্রতিদিন দুইবার, লটারিতে নির্ধারিত ক্রম অনুযায়ী, স্টুয়ার্ডসরা রুয়োতাতে খাবার নিয়ে যেতেন। এটি ছিল দেয়ালে বসানো এক ধরনের ঘূর্ণায়মান চাকা বা টার্নটেবিল, যার মাধ্যমে খাবার ও পানীয় কার্ডিনালদের ভেতরের কক্ষে পৌঁছে দেওয়া হতো। তার আগে খাবার ও পানীয় পরীক্ষকদের মাধ্যমে যাচাই করা হতো, যেন নিশ্চিত হওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে কোনো বেআইনি বার্তা লুকিয়ে নেই। এই প্রত্যেকটি ধাপ ইতালীয় ও সুইস প্রহরীদের কড়া নজরদারির মধ্যে সম্পন্ন হতো।
খাবার বা পরিবেশন পাত্র সবকিছুই থাকতো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত, এমন কিছুই রাখা যাবে না যার মাধ্যমে গোপনে কোনো বার্তা কার্ডিনালদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।
কোনো মুখবন্ধ পাই নয়, আস্ত মুরগিও নয়। অস্বচ্ছ পাত্রে নয়, পানি আর ওয়াইন দেওয়া হতো স্বচ্ছ গ্লাসে। কাপড়ের ন্যাপকিন খুলে পরীক্ষা করা হতো।
গোপনীয়তা তো বটেই, সঙ্গে ছিল কার্ডিনালদের খাবারে যেন বিষ না যায় তা নিশ্চিত করা। কারণ, রেনেসাঁর ওই যুগে পোপ তো কেবল ধর্মীয়গুরুই নন, তার রাজনৈতিক গুরুত্ব তো অপরিসীম।
তা খাবার যতই নিয়মে বাঁধা থাকুক, মেন্যু কিন্তু ছিল রাজকীয়: ফল, সালাদ, থালাভর্তি মাংস, ওয়াইন, পরিস্কার পানি। থাকার ব্যবস্থাও বেশ আরামদায়ক—সিল্ক দিয়ে সাজানো বড় কক্ষ, বিছানা, টেবিল, পোশাক রাখার র্যাক, বসার জন্য দুটি আসন, তালা দেওয়া যায় এমন জার—সবই থাকতো।
স্কাপ্পির তথ্য বিবেচনায় নিলে, রেনেসাঁ যুগের কনক্লেভ তাহলে খুব একটা মন্দ নয়, কেবল নজরদারিটুকু ছাড়া।
৭ মে শুরু হতে যাওয়া এবারের কনক্লেভে, সিসটিন চ্যাপেল লাগোয়া ডোমাস সানকতে মার্থা-র (এখানেই এখন কনক্লেভের কার্ডিনালরা থাকেন) নানরা কার্ডিনালদের জন্য ইতালির যে অঞ্চলে ভ্যাটিকান অবস্থিত সেই লাজিও ও তার কাছাকাছি অঞ্চলের কিছু সাধারণ খাবার তৈরি করবেন, এর মধ্যে থাকবে মিনেস্ট্রোন, স্পেগেটি, ল্যাম্ব স্কিউয়ার আর সেদ্ধ সবজি।
খাবার হয়তো বদলেছে, কিন্তু পদ্ধতি এখনও আগের মতোই, কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও বিধিনিষেধে ঘেরা।
২০২৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘কনক্লেভ’ চলচ্চিত্রে পোপ নির্বাচনের সব নাটকীয়তা দেখা যায় ডাইনিং হলে। টেবিলের চারপাশেই চুপিসারে চলে প্রভাব খাটানোর প্রয়াস। কারো পাশে বসা, কী খাওয়া, কার সঙ্গে খাওয়া—সবই হয়ে ওঠে একেকটা রাজনৈতিক বার্তা। এর বাইরে ভোটদান কক্ষ অনেক চুপচাপ, সেখানে চলে কেবল আনুষ্ঠানিক বক্তব্য, প্রার্থনা, ভোটদান আর গণনা।
সেই চলচ্চিত্রের এক জায়গায় দেখা গেছে নানরা আস্ত মুরগি সেদ্ধ করে ঝোল বানাচ্ছেন। খুবই সাধারণ খাবার, কিন্তু তার মধ্যেও বার্তা আছে। আধুনিক ক্যাথলিক চার্চ, বিশেষ করে পোপ ফ্রান্সিসের নেতৃত্বাধীন ভ্যাটিকান, খুব সাদামাটা, সংযমী ও পবিত্র ভাবমূর্তি তুলে ধরতে চায়। এখন খাবারের ভেতর লুকানো বার্তা নিয়ে ভয় ফিকে হয়ে গেছে, সে জায়গা নিয়েছে ইলেকট্রনিক উপায়, এটাই এখন দুশ্চিন্তার কেন্দ্র।
তাই আসন্ন কনক্লেভের আগে গুপ্ত ইলেকট্রনিক ডিভাইসের খোঁজে নিরাপত্তাকর্মীদের ঘুম যখন হারাম, কার্ডিনালরা সেরে নিচ্ছেন ব্যক্তিগত প্রস্তুতি। কেউ কেউ রোমে ঘুরে ঘুরে খেয়ে নিচ্ছেন প্রিয় নানান খাবার; মনে মনে হয়তো ভাবছেন, এটাই কি পোপ হওয়ার আগে তাদের শেষ ভোজ?
নতুন পোপ নির্বাচনে কনক্লেভ শুরু ৭ মে: ভ্যাটিকান