কেবল গান বা নাচ নয়, সংখ্যালঘুদের স্কুলে নিজের মাতৃভাষা শেখার ওপরও ৪৩ বছর ধরে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে ইরানের শরিয়া আইনপন্থী সরকার।
Published : 02 Nov 2022, 08:10 PM
দেড় মাসের বেশি সময় ধরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছে ইরানে। ‘নারী, জীবন, মুক্তি’ স্লোগান নিয়ে বিক্ষোভের সামনের কাতারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরাই। সরকারি দমন-পীড়নের মধ্যে বিক্ষোভকারীদের সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ দিতে বড় ভূমিকা রাখছে সামাজিক মাধ্যম কেন্দ্রীক প্রযুক্তি সেবা।
ইরানে সরকার বিরোধী বিক্ষোভের সূত্রপাত নীতি পুলিশের হেফাজতে ২২ বছর বয়সী কুর্দিশ তরুণী মাশা আমিনির মৃত্যু থেকে। হিজাব ‘সঠিকভাবে’ না পরার অভিযোগে আমিনিকে গ্রেপ্তার করেছিল ইরানের নীতি পুলিশ।
দেশটির কট্টরপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে হাজারো মানুষ রাজপথে নেমেছেন। এই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সংগঠনে ইরান এবং ইরানের বাইরে সমর্থকদের যোগাযোগ, একাত্মতা জানানোর এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলো।
বিক্ষোভকারী একে অন্যকে খুঁজে নিচ্ছেন হ্যাশট্যাগ দিয়ে
একটি হ্যাশট্যাগকে টুইটারের ‘ট্রেন্ডিং’ তালিকায় তুলে দিয়ে বিশ্ববাসীকে নিজেদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সম্পর্কে জানান দিচ্ছেন ইরানের নাগরিকরা।
বিবিসি জানিয়েছে, মাশা আমিনির মৃত্যুর পরের এক মাসে #mahsaamini পার্সিয়ান ভাষায় টুইট এবং রিটুইট করা হয়েছে ২৫ কোটি বার; আর ইংরেজি ভাষায় টুইট ও রিটুইট করা হয়েছে পাঁচ কোটির বেশিবার।
ইরানের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে হ্যাশট্যাগের গুরুত্ব ও ভূমিকা ব্যাখ্যা করে ইরানের নারী অধিকারকর্মী নেগিন শিরাঘায়েই বিবিসিকে বলেন, “ইরানের বাসিন্দাদের বারবার বলা হয় যে, সরকার বিরোধীদের কোনো অস্তিত্ব নেই অথবা যদি থাকেও তাদের সংখ্যা খুবই কম এবং তাদের গুড়িয়ে দেওয়া হবে।”
“এক্ষেত্রে মানুষের একে অন্যকে খুঁজে নিতে এবং তাদের নিজেদের শক্তি চেনাতে বড় ভূমিকা রাখছে হ্যাশট্যাগগুলো।”
নেতৃত্বহীন প্রতিবাদের যুগে হ্যাশট্যাগগুলোই খানিকটা হলেও সে ভূমিকা পালন করছে বলে বিবিসিকে বলেছেন শিরাঘায়েই।
“মানুষ হ্যাশট্যাগগুলোর কাছে কী চাইছে? আশা, দিকনির্দেশনা এবং তথ্য। বিক্ষোভকারীদের জন্য এখন পর্যন্ত ঠিক এ কাজটাই করেছে হ্যাশট্যাগগুলো।”
তবে, বিশ্ববাসীর নজর টানতে কেবল হ্যাশট্যাগ আর টুইটারে ঝড় তোলার ওপরেই নির্ভর করছেন না ইরানের বিক্ষোভকারীরা।
রাজপথে সহিংসতা, আর হ্যাকাদের ‘রসিকতা’
প্রথম থেকেই বিক্ষোভকারী প্রতি সহিংস আচরণ করছে ইরান সরকার আর দেশটির নীতি পুলিশ। নরওয়েভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘ইরান হিউম্যান রাইটস’-এর প্রতিবেদন বলছে, এখন পর্যন্ত অন্তত ২৫২ জন বিক্ষোভকারীকে হত্যা করেছে ইরানের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী; যার মধ্যে ৩৪ জনই শিশু।
কিন্তু এমন সহিংসতার বাস্তবতায় বিক্ষোভকারীদের রসিকতার খোরাক দিয়ে অনুপ্রেরণা দেওয়ার চেষ্টা করছেন প্রতিবাদ সমর্থক হ্যাকাররা।
রাষ্ট্রায়ত্ব টিভি চ্যানেলে সন্ধ্যার খবর প্রচারের সময় চ্যানেলের কম্পিউটার সিস্টেমে অনুপ্রবেশ করে পর্দায় ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির জ্বলন্ত ছবি দেখিয়েছে হ্যাকাররা। আর ঘটনার আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি সংবাদ উপস্থাপকের ভাবলেশহীন অভিব্যক্তির ছবি নিয়ে মিম বানিয়ে প্রচার করেছে বিক্ষোভের সমর্থকরা।
“যে কারণে…”
শুরু থেকেই সামাজিক মাধ্যমগুলোতে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছে ইরানের বাধ্যতামূলক হিজব আইন আর দৈনন্দিন জীবনে শরীয়া আইনের লাগাতার অনাকাঙ্খিত প্রয়োগ।
বিক্ষোভের শুরুর দিনগুলোতে ইরানী নাগরিকদের অনেকেই টুইটার এবং ইনস্টাগ্রামে তাদের প্রতিবাদ জানানোর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বক্তব্য শুরু করেছেন পার্সিয়ান ভাষায় ‘বারায়ে..’ বলে। ইংরেজিতে ভাবানুবাদ করলে যার মানে দাঁড়ায় “ফর দ্য সেইক অফ…,” আর বাংলায় ভাবানুবাদ করলে দাঁড়ায় “যে কারণে” বা “যে জন্য”।
“যে কারণে আমাদের যতোবার গাড়িতে বাজতে থাকা গানের ভলিউম কমাতে হয়েছে তোমরা (নীতি পুলিশ) পাশ দিয়ে গেছ বলে, যে ক্যাসেটগুলোকে লুকিয়ে ফেলতে হয়েছে আমাদের,” টুইট করেছেন ‘Usaneh_dahr’।
পশ্চিমা পপ গান আর ইরানের ভূখণ্ডের বাইরে প্রযোজিত গানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে ইরান সরকার। দেশটিতে টানা কয়েক দশক ধরে গাড়ি থামিয়ে বেআইনি গাড়ির ক্যাসেটের খোঁজ করার চল আছে দেশটিতে । “অশালীন গানের” ক্যাসেটের খোঁজে বাসা বাড়িতেও অভিযান চালায় ইরানের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী।
রাজপথে নাচার ওপরেও নিষেধাজ্ঞা আছে ইরানে; ব্যতিক্রম কেবল কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী নাচ যা কেবল পুরুষরাই নাচতে পারেন। কোনো পরিস্থিতিতেই নারীদের জনসমক্ষে নাচার বা গান গাওয়ার অনুমতি নেই দেশটিতে। তারপরও দেশটির অনেক নারী গোপনে নাচের প্রশিক্ষণ নেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।
সে নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ টেনে টুইটার ব্যবহারকারী ‘Ferferity’ টুইট করেছেন, “সেই সব মেয়েদের জন্য যাদের পেশাদার নাচের স্কুলে যাবার স্বপ্নকে মাটিচাপা দিতে হয়েছে এবং আমার নিজের জন্য।”
নারী ও পুরুষদের আলাদা ক্লাস নেওয়া হলেও ২০১৭ সালে ‘জুম্বা’ নিষিদ্ধ করেছে ইরান। নাচ এবং ব্যায়ামের মিশেলে শরীরচর্চা অনুশীলনকে ‘অইসলামিক’ বলে আখ্যা দিয়েছে ইরান সরকার।
কেবল গান বা নাচ নয়, সংখ্যালঘুদের স্কুলে নিজের মাতৃভাষা শেখার ওপর ৪৩ বছর ধরে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে ইরান সরকার।
সেই স্মৃতি টেনে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের আরেক সমর্থক ‘RMshii94’ টুইট করেছেন, “আমার মাতৃভাষার জন্য।”
নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে তার শাস্তি কারাদণ্ড। নিজের মাতৃভাষা শেখানোর অপরাধে পাঁচ বছরের কারাভোগ করছেন কুর্দিশ ভাষার শিক্ষক জারা মোহাম্মাদী।
টুইট মিলিয়ে প্রতিবাদের গান
ইরানেই থাকেন পপ গায়ক শেরভিন হাজিপৌর। “বারায়ে…” দিয়ে শুরু এমন বেশ কয়েকটি টুইট নিয়ে গান বানিয়েছিলেন; গানের শিরোনামও ছিল একই।
গানের ভিডিও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করার প্রথম ৪৮ ঘণ্টায় চার কোটির বেশি ভিউ পেয়েছিল গানটি। তারপর থেকেই সরকার বিরোধী বিক্ষোভে একাত্মতা প্রকাশের গণসংগীতে পরিণত হয়েছে গানটি।
২৯ সেপ্টেম্বর হাজিপৌরকে গ্রেপ্তার করে ইরানের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী; তিনি জামিনে মুক্তি পান ৪ অক্টোবর। মুক্তি পেয়ে হাজিপৌর ইনস্টাগ্রামে স্টোরি পোস্ট করে বলেন, গানটি “নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে” ব্যবহার করছে দেশের বাইরের রাজনৈতিক শক্তি।
ইনস্টাগ্রাম স্টোরি পোস্ট করার সময়েও হাজিপৌর আটক অবস্থা ছিলেন কি না, বা কোনো চাপের মুখে ছিলেন কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি বিবিসি।
তবে, অধিকারকর্মীদের দাবি, ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ব সংবাদমাধ্যমগুলো নিয়মিত বিরোধীদের মোকাবেলার কৌশল হিসেবে ভিন্নমতালম্বীদের কাছ থেকে জোর করে স্বীকারোক্তি নিয়ে প্রচার করে।
চুল কেটেও চলছে প্রতিবাদ
গত চার দশক ধরেই ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামিক নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের সেন্সরশিপ এড়ানোর নানা অভিনব কৌশল উদ্ভাবন করেছেন দেশটির শিল্পীরা।
যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসভিত্তিক ডিজিটাল কনটেন্ট নির্মাতা ফোরোযান নিজের ইনস্টাগ্রাম পেইজ ব্যবহার করে ইরানের চলমান বিক্ষোভে সমর্থন দিচ্ছেন। তার সবচেয়ে প্রচারিত ডিজিটাল শিল্পকর্মের একটির বিষয়বস্তুর এক তরুণী; ইরানের আল্লাহভারদি খান ব্রিজের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল কেটে ফেলছেন তিনি।
মাশা আমিনির মৃত্যুর পর শুরু হওয়া বিক্ষোভে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে নারীদের চুল কেটে ফেলার দৃশ্য। কেবল ইরানের নারীরা নন, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে নিজের চুল কেটে ফেলছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নারীরা।
সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে আরেক ইরানী শিল্পী বেনইয়ামিনের ভিডিও ‘ইউনিটি ফর ফ্রিদম’। ভিডিওতে ইরানের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক সদস্যের হাত ব্যাটন দিয়ে পেটাতে দেখা যায় আশপাশের অন্যদের হাত। কিন্তু এক পর্যায়ে অন্য হাতগুলোর ভিড়ে চাপা পড়ে যায় তার হাত। ভিডিওর শেষে অন্য হাতগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে জয়ের ‘ভিক্টরি সাইন’ দেখায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের হাতটি।
এমন কনটেন্ট থেকে একটি বিষয়ই স্পষ্ট হয়ে উঠে আসছে, রাজপথে এবং অনলাইনে ইরানের ক্ষমতাশীল কর্তৃপক্ষ বিক্ষোভকারীদের কণ্ঠ রোধের সর্বাত্মক চেষ্টা করেও থামাতে পারছে না।
“যে দেশে মানুষের কোনো সংবাদমাধ্যম নেই, সেখানে সামাজিক মাধ্যমই মানুষের ভরসার জায়গা নিয়েছে।” এই ‘বিকেন্দ্রীক মাধ্যমগুলোই’ মানুষকে তাদের যা বলার এবং যা দেখাতে চান তা দেখানোর সুযোগ করে দিচ্ছে বলে মন্তব্য নেগিন শিরাঘায়েইয়ের।