কীভাবে একজন সফল ও নিজ যোগ্যতায় হওয়া প্রযুক্তি বিলিয়নেয়ারের স্বর্গ থেকে পতন ঘটল, তা সত্যিই আবিশ্বাস্য এক গল্প।
Published : 24 Jul 2024, 03:34 PM
সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক ইন্টারনেট কোম্পানি ‘কাকাও কর্পোরেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা কিম বেওম-সু।
মঙ্গলবারের এই ঘটনাটি পশ্চিমাদের কাছে তেমন অর্থপূর্ণ না হলেও, কীভাবে একজন সফল ও নিজ যোগ্যতায় হওয়া প্রযুক্তি বিলিয়নেয়ারের স্বর্গ থেকে পতন ঘটল, তা সত্যিই আবিশ্বাস্য এক গল্প।
বলা হচ্ছে, এই পতনের দায় অনেকটাই তার কেনা এক স্ক্যান্ডালভরা কে-পপ এজেন্সি’র।
কিম নামের এই প্রযুক্তি উদ্যোক্তা পরিচিত ব্রায়ান নামেও। ‘এসএম এন্টারটেইনমেন্ট’ নামের একটি কোম্পানি কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। আর এর আগে ব্যবসায়িক লাভের লক্ষ্যে কোম্পানিটির শেয়ারমুল্যে নয়ছয় করেছেন বলে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এ প্রতিযোগিতায় কিমের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ‘হাইব’ নামের কে-পপ লেবেল, যাদের ক্লায়েন্ট তালিকায় আছে শীর্ষ কে-পপ ব্যান্ড ‘বিটিএস’।
গত বছর মামলার বাদীপক্ষ কাকাও’র বিনিয়োগ প্রধান বায়ে জায়ে-হিউনের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলেছিল। এবার, নিজের বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ নাকচ করেছেন কিম।
দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপ ‘কাকাওটক’-এর জন্য কাকাও কর্পোরেশন বিশেষভাবে পরিচিত, যা ব্যবহার করে থাকেন দেশটির পাঁচ কোটি নাগরিকের মধ্যে চার কোটি ৭০ লাখ।
তবে কাকাও’র কার্যক্রম শুধু মেসেজিংয়েই সীমাবদ্ধ নয়। শপিং, ব্যাংকিং থেকে মিউজিক এমনকি রাইড শেয়ারিং খাতেও কোম্পানিটির বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা আছে। এখন কোম্পানিটির বাজারমূল্য প্রায় ১৭ ট্রিলিয়ন কোরীয় উওন অর্থাৎ এক হাজার ২৪০ কোটি মার্কিন ডলার।
কাকাও এরইমধ্যে প্রভাবশালী হলেও তারা কেন একটি কে-পপ কোম্পানি কিনতে আর্থিক জালিয়াতির মতো ঝুঁকি কেন নেবে, সেটাই বড় প্রশ্ন। তবে, এসএম এন্টারটেইনমেন্ট কোনো যেনতেন লেবেল নয়, বরং কোরিয়ার ‘বিগ থ্রি’ কে-পপ এজেন্সির একটি, যাদের ঝুলিতে আছে ‘গার্লস জেনারেশন’, ‘এক্সো’, ‘এনসিটি’ ও ‘এয়েস্পা’র মতো সুপরিচিত ব্যান্ড।
আর কোম্পানিটি অধিগ্রহণের মানে দাঁড়াত কাকাও’র বৈশ্বিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় এগিয়ে যাওয়া। কোম্পানিটি এরইমধ্যে কোরিয়াতে আধিপত্য বিস্তার করলেও দেশটির বাইরে তারা তেমন পরিচিত নয়।
কে-পপ জনরা এশিয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়, এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোতেও এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তবে, হাইবের সঙ্গে কাকাও’র ‘বিডিং ওয়ার’ এ অধিগ্রহণের চূড়ান্ত পর্যায় ছিল, যেখানে কর ফাঁকি, অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি তথাকথিত ‘কে-পপের গডফাদার’-এর পতনও দেখা গেছে। আর এ লড়াইয়ে জয়ী হয়েছে কাকাও, যেখানে ৯৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারে এসএম-এর সিংহভাগ শেয়ার নিজ দখলে নিয়েছে কোম্পানিটি।
প্রতীকীভাবে, কিমের গ্রেপ্তারের ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ কারণ কোরিয়ার অভিজাত শ্রেণির বিপরীতে কিম ছিলেন বিরল এক উদাহরণ, যিনি নিজের যোগ্যতায় বিলিয়নেয়ার হতে পেরেছিলেন। অন্য কথায় বললে, তিনি কোরিয়ার কোনো ধনাঢ্য পরিবার অর্থাৎ ‘চেয়েবল’ থেকে উঠে আসেননি।
কোরিয়ায় চেয়েবল বলতে স্যামসাং, হুন্দাই, এসকে গ্রুপ ও এলজি’র বিভিন্ন পরিবারতান্ত্রিক কোম্পানিকে বোঝায়, যারা প্রায়শই বিভিন্ন ছোট কোম্পানির গলা চেপে ধরে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে আছে।
অন্যদিকে, কিমের গল্প দারিদ্র্য থেকে উঠে আসা একজন ধনী ব্যক্তির, যিনি নিজের পরিবারের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে কলেজে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এমনকি সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছানোর পর স্যামসাংয়ের নির্বাহী চেয়ারম্যান লি জেই-ইয়ং’কে টপকে দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হওয়ার কৃতিত্বও অর্জন করেছিলেন তিনি, যেখানে তার আনুমানিক সম্পদ ছিল এক হাজার তিনশ কোটি ডলার।
তবে, অবশেষে কিমের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াল কাকাওয়ের একচেটিয়া রাজত্বের আগ্রাসী বাসনা। এর আগে ২০২২ সালে কাকাও’র ডেটা সেন্টারে আগুন ধরার পর টানা পাঁচ দিন দেশটির জনগণের যোগাযোগের উপায় বন্ধ ছিল, যার ফলে সরকারি তদন্তের মুখে পড়ে কোম্পানিটি। এমনকি হাতে গোনা কয়েকটি প্রযুক্তি কোম্পানির ওপর কোরিয়ার নির্ভরতার বিষয়টি নিয়েও উদ্বেগ বেড়ে গিয়েছিল তখন।
মার্কিন বাণিজ্য প্রকাশনা ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর পর থেকে বেশ কয়েকবার কর ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে কাকাও’র বিরুদ্ধে। এমনকি এ বছর প্রায় এক তৃতীয়াংশ বাজারমূল্য হারিয়েছে কোম্পানিটি, যেখানে কিম নিজেই প্রায় এক হাজার কোটি ডলারের সম্পদ খুইয়েছেন।