জার্মানি এখন যেন অতীতের কঙ্কাল

দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সেই জার্মানির এখন জীর্ণ দশা, পরপর দুই বিশ্বকাপে তারা বিদায় নিল গ্রুপ পর্ব থেকে।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Dec 2022, 04:55 AM
Updated : 2 Dec 2022, 04:55 AM

“ফুটবল খুব সাধারণ একটি খেলা, যেখানে ২২ জন মিলে একটি বল তাড়া করে এবং শেষ পর্যন্ত জার্মানি সবসময় জেতে।” ইংলিশ গ্রেট গ্যারি লিনেকারের এই কথা ফুটবলে যেমন কিংবদন্তি হয়ে গেছে, তেমনি বছরের পর বছর ছিল প্রতিষ্ঠিত সত্যও। ‘ছিল’ বলতে হচ্ছে, কারণ লিনেকারের কথাটি এখন অনেকটা শোনাচ্ছে পরিহাসের মতো। সেই জার্মানি যে এখন ভীষণ অচেনা!

২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে যখন গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিল জার্মানি, ফুটবল বিশ্বে তা ছিল বড় বিস্ময়। আগে একবারই তারা গ্রুপ থেকে বিদায় নিয়েছিল। সেটিও সেই ১৯৩৮ সালে। বড় অঘটন হিসেবেই সেটিকে ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার কাতার বিশ্বকাপেও তাদের পথচলা শেষ গ্রুপেই।

বিস্ময় কিছু আছে এবারও। তবে গতবারের মতো হয়তো নয়। বরং জার্মানির ক্ষয়িষ্ণু সময়ের প্রতিবিম্ব হয়ে রইল এই আসর।

কোস্টা রিকার সঙ্গে বৃহস্পতিবার ৪-২ গোলে জিতেও জার্মানিকে মাঠ ছাড়তে হলো মলিন মুখে। সর্বনাশের বীজ তারা বুনে রেখেছিল যে আগেই। আসরের প্রথম ম্যাচেই তারা হেরে যায় জাপানের কাছে। পরের ম্যাচে স্পেনের সঙ্গে হার এড়াতে পারলেও জিততে পারেনি। ড্র থেকে পাওয়া এক পয়েন্ট নিয়ে শেষের লড়াইয়ে নামে তারা, যখন সবকিছু আর নিজেদের হাতে নেই। তাই জিতেও শেষ পর্যন্ত গ্রুপ পেরোতে পারেনি, অন্য ম্যাচের ফল পক্ষে না আসায়।

একটা সময় জার্মানি ছিল বিশ্ব আসরের সবচেয়ে ধারাবাহিক দল। খারাপ সময়েও ন্যূনতম একটা মান, একটা পর্যায় পর্যন্ত তাদের যেতে দেখা গেছে। সেই জার্মানি প্রথমবারের মতো টানা দুই বিশ্বকাপে বিদায় নিল গ্রুপ থেকে। মাঝে গত বছর ইউরোতেও খুব ভালো কিছু করতে পারেনি তারা। কোনোরকমে গ্রুপ পর্ব উতরাতে পারলেও ইংল্যান্ডের কাছে হেরে যায় দ্বিতীয় রাউন্ডেই।

অথচ ২০১৪ ব্রাজিল আসরে অসাধারণ ছন্দময়, গতিময়, নান্দনিক ও আগ্রাসী ফুটবল খেলে তারা জিতে নিয়েছিল ট্রফি। ২০১০ ও ২০০৬ আসরে তারা হয়েছিল তৃতীয়, ২০০২ বিশ্বকাপে খেলেছিল ফাইনালে।

এই কবছরই শুধু নয়, বছরের পর বছর ধরে ছিল তাদের দাপুটে ফুটবলের প্রদর্শনী। চারবারের বিশ্বকাপজয়ী দল তারা, ব্রাজিলের পর যা সর্বোচ্চ। এছাড়াও রানার্স আপ হয়েছে তারা চারবার, সেমি-ফাইনাল খেলেছে আরও পাঁচবার। এমন ধারাবাহিকতা বিশ্বকাপে অনন্য।

কিন্তু সেসব এখন কেবলই অতীতের সোনালি স্মৃতি। গত বিশ্বকাপ থেকে এই বিশ্বকাপের জার্মানি ফুটিয়ে তুলছে বিপর্যস্ত বর্তমানকে।

কোচ হান্সি ফ্লিকের এই দলের প্রস্তুতির ঘাটতি স্পষ্ট। ফুটবলের গুণগত মানেও তারা পিছিয়ে বেশ। মানসম্পন্ন ফুটবলার খুব বেশি নেই। স্কোয়াডের গভীরতাও খুব একটা নেই। তবে সবচেয়ে বেশি যা চোখে পড়ার মতো, চেনা সেই জার্মান চরিত্রই নেই!

জার্মানি মানেই ছিল হার না মানা মানসিকতা, লড়াইয়ে পিছপা না হওয়া, জার্মানি মানেই উজ্জীবিত ও অদম্য মানসিকতা। জার্মানি মানে যে কোনো প্রতিকূলতার স্রোত উল্টে ফেলার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা আর বিশ্বাস। সেই জার্মান চরিত্র এবার যেন চাপা পড়ে গেল কাতারের মরুতে। এই জার্মানি কেবল অতীতের ছায়া, যাদেরকে চিনতে হয় স্রেফ পোশাক দেখে।

বরং জার্মান চরিত্র এবার ফুটে উঠল জাপানের খেলায়। প্রথম ম্যাচে শুধু জার্মানিকে হারিয়েই দেয়নি তারা, শেষ ম্যাচে টিকে থাকার কঠিন লড়াইয়ে স্পেনের বিপক্ষে পিছিয়ে পড়েও ঘুরে দাঁড়িয়ে দারুণ জয়ে তারা গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পা রাখল শেষ ষোলোয়।

ফ্লিকের এই জার্মানি দলে বেশ কজন ছিলেন, বয়সের ভারে যারা এখন ন্যুজ। সেরা সময়ে অনেক পেছনে ফেলে যারা এখন বিবর্ণ। এবারের বিশ্বকাপেও তা ফুটে উঠেছে। আর কিছু ফুটবলার ছিলেন একদম অনভিজ্ঞ। তাদের মধ্যে জামাল মুসিয়ালা দুর্দান্ত স্কিল দেখিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ছবি মেলে ধরেছেন বটে, সম্ভাবনার ঝলক দেখিয়েছেন আরও দু-একজন। তবে এবারের জন্য তা যথেষ্ট হয়নি।

এই দলের রক্ষণের সমস্যা অনেক দিন ধরেই। বিশ্বকাপের আগের ম্যাচগুলোয় সুনির্দিষ্ট কোনো ‘ডিফেন্স লাইন’ টানা দুই ম্যাচে খেলাতে পারেননি ফ্লিক। বিশ্বকাপেও সেই রক্ষণ নিয়ে ভুগতে হয়েছে দলকে।

জার্মানি দলের সবসময়ই দেখা যেত এক বা একাধিক দারুণ স্কোরার, দলের খুনে মানসিকতা চূড়ান্ত রূপ পেত যাদের মাধ্যমে। কিন্তু এই দলের ছিল না কোনো সত্যিকারের স্কোরার। টমাস মুলার আর সেই ২০১৪ সালের চেহারায় নেই। মাঝে তিনি দলে জায়গাও হারিয়েছিলেন। পরে ফিরতে পারলেও নিজেকে ফিরে পেলেন না। বিশ্বকাপ অভিযান শেষে হয়তো অবসরই নেবেন তিনি জাতীয় দল থেকে।

বিকল্প হিসেবে তাদের নির্ভর করতে হয়েছে নিকলাস ফুলখুগের ওপর, বয়স ২৯ হলেও যার জাতীয় দলে অভিষেক বিশ্বকাপের মাত্র কদিন আগে। মাঝমাঠে ইলাকাই গিনদোয়ান, জসুয়া কিমিখরা নিজেদের ভূমিকায় থাকতে পারেননি প্রায়ই।

গোলবারের নীচে মানুয়েল নয়্যার আগের মতো জাদুকরী ও নির্ভরতার প্রতিশব্দ নন। বেশ কিছুদিন থেকেই তিনি ভুল করছেন প্রায় নিয়মিতই। কোস্টা রিকার বিপক্ষেও দল প্রথম গোল হজম করে তার হাত থেকে সহজ বল ফসে যাওয়ায়। দ্বিতীয় গোল হজমেও ভুল আছে তার। অধিনায়ক হিসেবেও তিনি দলকে ততটা উজ্জীবিতও করতে পারেননি ততটা।

মাঠে একজন নেতার অভাব অবশ্য তাদের অনেক দিন ধরেই। ফ্রাঞ্জ বেকেনবাউয়ার, লোথার মাথেউস বা বাস্তিয়ান শোয়াইনস্টাইগারের মতো একজন নেতার অভাব মাঠে তাদের খেলায় ফুটে উঠেছে প্রবলভাবে।

সব মিলিয়ে জার্মানির জাতীয় খেলা এখন রূপ নিয়েছে একরকম জাতীয় বিপর্যয়ে। জার্মান ফুটবলের ভাবমূর্তিকে পুনরুদ্ধার করতে, জার্মান সেই চরিত্র এবং দাপুটে রূপকে ফিরিয়ে আনতে হলে হয়তো জাতীয় দল, ফেডারেশন, কোচিং এবং পরিকল্পনা, সবকিছুই ঢেলে সাজাতে হবে নতুন করে।

তবে আপাতত, জার্মান ফুটবল এখন রোগাক্রান্ত। শয্যাশায়ী।