একান্ত সাক্ষাৎকারে সাদিয়া রহমান মৌ কথা বললেন তার বেড়ে ওঠা, দেশের সেরা হওয়া, কমনওয়েলথ গেমসের সেই আলোচিত কাণ্ড, ভবিষ্যৎ ভাবনাসহ আরও অনেক কিছু নিয়ে।
Published : 13 Aug 2023, 12:18 PM
“আমি দুষ্টু একটা মেয়ে। শুধু দুষ্টু বললে ভুল হবে, ভয়ানক দুষ্টু! ভাঙচুর, কাটাছেঁড়া করা আমার অভ্যাস। এগুলোর জন্য জীবনে অনেক মার খেয়েছি আম্মুর কাছে…”- সাদিয়া রহমান মৌ যখন শৈশবের স্মৃতি আওড়াচ্ছিলেন, পাশে বসে থাকা মায়ের মুখে তখন হাসির ফোয়ারা। সেই হাসিতে এখন আছে প্রশ্রয়। গর্বের ঝিলিকও স্পষ্ট। তা হওয়ারই কথা। মেয়ে যে তার জাতীয় টেবিল টেনিসের চ্যাম্পিয়ন, তাও মাত্র ১৮ বছর বয়সেই!
কদিন আগে চট্টগ্রামে শেষ হয়েছে জাতীয় টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ। মেয়েদের এককে বাজিমাত করেছেন মৌ, ছেলেদের এককে চোখ ধাঁধানো সাফল্য পেয়েছেন রামহিম লিয়ান বম।
উঠতি এই দুই তারকার পাশাপাশি ফেডারেশনের কর্তা ও কোচদের কথা শুনেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। শৈশব, কৈশর, বেড়ে ওঠার গল্প বলার পাশাপাশি ক্যাম্পের জীবন, স্বপ্নের আকাশের পরিধি আরও বিস্তৃত করতে প্রয়োজনীয় চাওয়া, সবকিছুই খেলোয়াড়রা জানালেন মন খুলে। প্রথম পর্বে থাকছে মৌয়ের কথা।
দস্যিপনায় ভরা দুরন্ত শৈশব
বলা যায়, নড়াইল জেলাটি টেবিল টেনিসের আতুঁড়ঘর। মাহবুব বিল্লাহ, মৌমিতা আলম রুমি, সোনাম সুলতানা সোমা, সালেহা খাতুন-এমন অনেক তারকার মতো মৌও নড়াইলের মেয়ে। যদিও শৈশবে স্বপ্ন ডানা মেলেছিল নানা দিকে। একসময় হতে চেয়েছিলেন ডাক্তার। নৃত্যশিল্পীও হতে চাইতেন। কিন্তু দুরন্তপনার কারণে মায়ের হাতে পিটুনি খাওয়া সেই মেয়েটি শেষ পর্যন্ত হাঁটল টেবিল টেনিসের পথে।
“দুষ্টুমির জন্য জীবনে অনেক মার খেয়েছি আম্মুর কাছে। আসলে আমার শৈশবটা এরকমই ছিল। খুবই ব্যস্ত শৈশব ছিল, অনেক কিছু করতে করতে বেড়ে উঠেছি। আম্মু কিছুই শেখাতে বাদ রাখেননি। আর্ট, অভিনয়, নাচ, গান এবং এর পাশাপাশি খেলাটা। আমার প্রথম পছন্দ ছিল নাচ, কিন্তু পরবর্তীতে কিভাবে যেন খেলাতেই বদলে গেল। মজার বিষয় হচ্ছে, আমার পাসপোর্টটাও করা হয়েছিল ভারতে একটি নাচের একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য, সেটা নিয়েই টিটি খেলতে গিয়েছিলাম ভারতে।”
টিটি খেলোয়াড় হিসেবে ভারতযাত্রার আগের সময়টাতে ছিল নানা দোটানা। ‘মেয়ে’ বলে মা চোখের আড়াল হতে দিতে চাননি। অন্য খেলায়ও মৌয়ের পা বাড়ানো হয়নি চোট শঙ্কা, নিরাপত্তার ভয়ে। ওই সময় ছাতা হয়ে এসেছিলেন নড়াইলের বর্ষীয়ান সংগঠক শামসুল আলম আনু, যিনি দুই বছর আগে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।
“আসলে ঘরোয়া কোনো খেলাতেই আম্মা আমাকে আনতে চাচ্ছিলেন। কারণ খোলা মাঠের খেলা নিরাপদ হবে কি না… কিংবা ওই ধরনের খেলা নড়াইলে তেমন একটা ছিলও না। ক্রিকেট, ফুটবলে তেমন আগ্রহও ছিল না সেসবে আঘাত পাওয়ার বিষয়টি থাকায়। সব মিলিয়ে নড়াইলের টিটি ক্লাবে যাতায়াত শুরু এবং এরপর কিভাবে কিভাবে যেন ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ার সময় টপ এইটে চলে এলাম।”
“টপ এইট যে কী বিষয়, সেটাও তখন বুঝি না। তখন আমার মাথার উপরে একজনের হাত ছিল, তিনি শামসুল আলম আনু, উনি বোঝাতেন ‘টপ এইটে এসেছো, এর পরে ধাপ এটা…এগুলো… এরপর এই লক্ষ্য স্থির করো।’ কখনও চাপ দেননি তিনি, শুধু বোঝাতেন। একসময় টপ ফোরে চলেও এলাম। এভাবেই টেবিল টেনিসের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া।”
এলেন, মন জয় করে নিলেন
পাঁচ-সাড়ে ৫ বছর বয়সে ঢাকায় যাতায়াত মৌয়ের। ওই বয়সে টেবিলে ঠিকঠাক নাগালও পেতেন না! জাতীয় পর্যায়ে খেলা শুরু ২০০৯ সালে। রাজশাহী জেলার হয়ে খেলে পেয়েছিলেন দলগত ব্রোঞ্জ। ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গেমসে এসে প্রথমবারের মতো পেলেন এককে শিরোপার স্বাদ। এরপর ফেডারেশন কাপ টিটির এককেও জিতলেন সেরার মুকুট। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে এবার জাতীয় পর্যায়ে উঁচিয়ে ধরলেন ট্রফি।
“যখন জাতীয় পর্যায়ে খেলা শুরু করলাম, তখন অনেক জেলার মেয়েরাই খেলতে আসত। মনে করতে পারছি না, নওগাঁ না রাজশাহী জেলার দলের হয়ে খেলার সুযোগ পেলাম। হ্যাঁ, রাজশাহীর হয়ে খেলেছিলাম। এটুকু মনে আছে, টেবিলে ওভাবে নাগাল পেতাম না। অনেকেই আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, এখন যারা সিনিয়র খেলোয়াড় আছেন, অনেকে যারা অবসরে গেছেন, মনে আছে, আমি তাদের সবার কোলে কোলে ঘুরে বেড়িয়েছি (হাসি)।”
খালাত বোন সোমাকে হারিয়ে তিনবার সেরা হয়েছে মৌ। বাংলাদেশ গেমসে জিতেছেন ৪-২ সেটে, ফেডারেশন কাপে ৪-৩ সেটে এবং জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ৪-৩ ব্যবধানে। যে বোনের সাফল্য দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠা, তাকে হারানোর আনন্দ মৌয়ের কাছে পুরোই অন্যরকম।
“২০০৯ সালে যখন জাতীয় পর্যায়ে খেলতে আসি, তখনই দেখছি আপু ফাইনাল খেলছে। পদক জিতছে। আমার কাছে একটা ছবিও আছে, আপু চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, ট্রফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমরা দুই বোন তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। ওই স্মৃতিও আমার মনে পড়ে। তাকে আমি কত ছোট বয়সে চ্যাম্পিয়ন হতে দেখেছি। তার সঙ্গে এক সাথে খেলার সুযোগও হয়েছে আমার।”
“প্রথম যখন ফাইনালে (বাংলাদেশ গেমসে) তার বিপক্ষে খেলতে নামি, স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলাম। খেলতে নেমে আগে তাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। এরপর আমি যখন জিতে গেলাম, তখন আমার মা কোর্টে এসে আমাকে নয়, সোমা আপুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। ওই ম্যাচে খুব চাপ অনুভব করিনি, কিন্তু জয়ের আনন্দ ঠিকই টের পেয়েছিলাম। ফেডারেশন কাপে অনেক পিছিয়ে থেকে আপুর বিপক্ষে জিতেছিলাম। এই টুর্নামেন্টে আপু অনেক ভালো খেলেছে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল আমার দিকে।”
সেই বার্মিংহাম কাণ্ড
এই সাফল্যের মাঝেই ঘটল মহা এক বিপত্তি। গত বছর বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসের সময় রীতিমতো শোরগোল পড়ে গিয়েছিল চারদিকে-ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা বাদ দিয়ে দিব্যি লন্ডনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সোমা ও মৌ! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ঘুরে বেড়ানোর ছবি ছড়িয়ে পড়ার পর তুমুল সমালোচনা হয়েছিল। ফেডারেশনও দেয় নিষেধাজ্ঞা। ওই ঘটনা এখনও তাড়া করে ফিরে মৌকে।
“আসলে ঘটনাটা কী বলব… প্রথমে বিষয়টা যতটা রটেছিল, সেটা মৌখিকভাবে রটেছিল। তখনও আমরা কোনো কাগজপত্র পাইনি। আমাদেরকে অনেকেই প্রশ্ন করেছে, কিন্তু কাগজ না পাওয়ায় আমরা কোনো কিছুই বলতে পারিনি। মৌখিক অনেক কিছুই বলা যায়, রটানো যায়। অলিম্পিকের হাতে ছিল তদন্ত ভার, তারা তদন্তের পর কী রিপোর্ট দিয়েছে, তা আমরা এখনও জানি না। আমাদের কাছে যে তথ্য ছিল, সেগুলো দিয়েছি, তদন্তের জন্য ডেকেছিল, পরবর্তীতে আমাদের কিছু জানানো হয়নি।”
“যেটা ঘটেছিল…সোমা আপু ইনজুরড ছিল। ইনজুরির কারণে ডাক্তার তাকে খেলতে নিষেধ করেছিল। সে যখন বিশ্রামেই ছিল, তখন আমরা বাইরে যেতে চেয়েছিলাম। বিষয়টি আমরা ইনফর্ম করেছিলাম, এমনকি আমাদের সঙ্গে একজন কর্মকর্তার যাওয়ারও কথা ছিল, তিনি নিজ মুখেই বলেছিলেন-‘হ্যাঁ, আমি যাব।’ পরবর্তীতে উনি যেতে চাননি। ওখানে (ওই দিন) যে খেলা আছে, এটা তো খেলোয়াড় জানবে না। কোচ, ম্যানেজার জানবে। খেলার সময় কোচ খেলোয়াড়দের পাশে থাকবে, বিষয়টি হয়ত তার জানার কথা না, কিন্তু ম্যানেজারের জানার কথা। কিন্তু আমাদেরকে ইনফর্মই করা হয়নি। পরবর্তীতে যখন এটা নিয়ে কথা উঠল, তখন তিনি কেন কথা বললেন না, কিংবা তিনি নেতিবাচক কিছু বলেছিলেন কি না, সে ব্যাপারে আমার ধারণা নেই, পরে এভাবেই রটে গেল বিষয়টি।”
আর পিছু ফিরে থাকা নয়
বার্মিংহামের ঘটনা এখনও পিছু ছাড়েনি সোমা ও মৌয়ের। তবে টিটির পাশে বাংলাদেশ পুলিশ ও আনসারের থাকার কারণে দুজনে ঘরোয়াতে খেলার সুযোগ পেয়েছেন ‘বিশেষ বিবেচনায়’, জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে দুজনে ফাইনালও খেলেছেন। দুই বছরের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়নি এখনও।
তবুও পিছন ফিরে তাকাতে চান না মৌ। দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ছড়াতে চান আলো। কিন্তু তার জন্য ভাগ্যের সহায়তার চেয়ে পরিশ্রম, কঠোর অনুশীলন, আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন গত এসএ গেমসে মেয়েদের দ্বৈতে সোমার সাথে জুটি বেঁধে ব্রোঞ্জ জয় করা মৌ। এই চাওয়াগুলো পূরণ হলেই কেবল টেবিল টেনিসকে পেশা হিসেবে নেওয়ার দুয়ার খুলবে বলে মনে করেন ১৮ বছর বয়সী এই তরুণী।
“এখন যে পরিস্থিতি, আমরা পরিচিত খেলোয়াড়ের বিপক্ষে নিয়মিত খেলি। তার উন্নতি, সার্ভিস, সবকিছু চাক্ষুস দেখছি। কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ের টুর্নামেন্টের প্রস্তুতি একজন আন্তর্জাতিক মানের কোচের তত্ত্বাবধানে হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। যখন একজন আন্তর্জাতিক মানের কোচের কাছে অনুশীলন করব, তিনি আমাদের সেভাবেই তৈরি করবেন। এটা একদিনের বিষয় নয়। ধারাবাহিকতার বিষয়। আমাদের প্রস্তুতিতেও সেই ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলো খেলতে হবে। তারপর আমরা ওই পর্যায়ে যেতে পারব।”
“আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বপ্ন দেখি। এই স্বপ্নটা দেখা সহজ নয়, পূরণ করা আরও কঠিন। জাতীয় পর্যায়ে যখন থেকে সাফল্য পাওয়া শুরু হয়েছে, পদক জিতছি, তখন থেকে ইচ্ছা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো করার। যেহেতু এক নম্বর হয়েছি, এখন লক্ষ্য দেশের বাইরে ভালো করা। শুধু দেশের সেরা হয়েই থাকব, তা নয়। বাইরেও আমরা যেন দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারি, আমাদের সেভাবে প্রস্তুত করা হোক, যেন দেশকে ভালো কিছু এনে দিতে পারি, দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারি।”