“বউরে অনেক ঈদ ধরে কিছু কিনে দিতে পারি না, নিজের জন্য কিনি না। বাচ্চাদের তো না দিয়ে পারি না,” বলেন রিকশাচালক মাঈন উদ্দিন।
Published : 23 Mar 2025, 11:41 AM
পরিবারের চার সদস্যের মুখে তিনবেলা খাবার যোগাতেই হিমশিম অবস্থা দিনমজুর জলিল উদ্দিনের; এর মধ্যে নয় বছরের মেয়েটা বায়না ধরেছে ঈদের নতুন জামা লাগবেই।
রাজধানীর মিরপুর ১২ নম্বরের কালাপানি বস্তিতে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে থাকেন জলিল। মাটি কাটার কাজ করলেও প্রতিদিন কাজ মেলে না। ফলে হাতে জমানো কোনো টাকাও থাকে না।
মেয়ের আবদার নিয়ে মা খাদিজা আক্তার বললেন, “ওর বাপ প্রতিদিন কাজ পায় না। পাইলে কিছু টাকা জমাইয়া কিনে দিতে পারতাম। ছোটটা বুঝে না দেখে কিছু চায় না, এইটা বুঝতেছে নতুন কাপড়।
“সামনে যদি ভাল কাজ পায়, তাইলে হয়ত কিনে দিতে পারুম। নইলে পুরান কাপড়েই ঈদ করা লাগব।”
বায়না ধরলেও নতুন জামা যে অনিশ্চিত, নয় বছরের শিশুটিও সেটি জানে। তার ভাষ্য, “চাইতেছি তো সেই কবে থেকেই। কবে কিনে দিবে জানি না। আমার লগের সবাই নতুন জামা কিনছে।”
ঈদ চলে আসায় মজুরির কিছু টাকা বাঁচানোর চেষ্টা করছেন নির্মাণ শ্রমিক নূর নাহার। একমাত্র ছেলের জন্য ঈদের জামা কিনে দেবেন তিনি।
মিরপুরের মাজার রোড এলাকার এই নারীর স্বামী অসুস্থ, ১০ দিনের বেশি আয় করতে পারেন না। ফলে ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে সংসারের চাকা ঘোরাতে হয় নূর নাহারকেই।
ঈদের কেনাকাটার প্রসঙ্গ তুললে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নূর নাহার বলেন, “৪০০ টাকা পাই দিনে। এটা দিয়ে খেয়ে-দেয়ে ঘর ভাড়া দিয়েই থাকে না কিছু। এ কারণে এখনও কিছু কিনিনি।”
“কিছু টাকা বাঁচাইতে পারলে ছেলেরে ফুটপাত থেকে প্যান্ট-শার্ট কিনে দেওয়ার আশা আছে,” বলেন তিনি।
রোজার মাসের মাঝামাঝি থেকেই বেচাকানা জমে উঠেছে রাজধানীর অভিজাত বিপণিবিতানে। অন্যান্য মার্কেটেও যেন পা ফেলা দায়। তবে নূর নাহার আর খাদিজা আক্তারের মত স্বল্প ও নিম্ন আয়ের অনেকে এখনও ঈদের কেনাকাটার কোনো পরিকল্পনাও করেননি।
অভিজাত বিপণিবিতান নয়, ফুটপাতের দোকানই তাদের মার্কেট। আবার চাহিদাও বেশি নয়, তবুও প্রত্যেক ঈদে মেলে না নতুন জামাকাপড়। কায়িক শ্রমের আয় থেকে কিছুটা বাঁচিয়ে সাধ পূরণ করেন ছেলেমেয়ের। যদিও সবসময় সেটাও হয়ে ওঠে না।
এখনও বেতন-বোনাস পাননি মিরপুরের গৃহশ্রমিক আসমা বেগমও। ফলে ঈদের কেনাকাটার কোনো পরিকল্পনাও করেননি তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যেসব বাড়িতে কাজ করি ওইগুলা থেকে আগে বাচ্চাদের কাপড় দিত, নানা জায়গা থেকে শাড়ি পাইতাম, এবার সেগুলাও পাইনি। এরাও (যে বাসায় কাজ করেন) নাকি বোনাস পাইছে না, এ কারণে টাকা দিতে পারছে না। দিলে ফুটপাত থেকে বাচ্চাদের কিনে দেব।”
মাসে ১০ হাজার টাকা আয় করেন গাবতলীর নির্মাণ শ্রমিক শাবানা খাতুন। গত বছর নিজের জন্য একটা থ্রি পিস কিনলে এবার ঈদে ফুটপাত থেকে মেয়েকে কিনে দিয়েছেন থ্রি পিস।
“সবারই তো ইচ্ছা হয় ভালো কিছু কেনার। গরীব মানুষ চাইলেও তো কিনতে পারব না। আরও কম খাইছি, এখান থেকে দুয়েক টাকা রাখছি, সেটা দিয়ে কেনাকাটা করছি। জিনিসের দাম বাড়ছে, কিন্তু কাজ তো তেমন পাই না,” বলেন শাবানা।
মহাখালী এলাকায় রিকশা চালান মাঈন উদ্দিন। ঈদে গ্রামের বাড়িতে ফেরারর আগে বাচ্চাদের জন্য কিনে নিয়ে যাবেন নতুন জামা-কাপড়।
তিনি বলেন, “রোজার মধ্যে অত কামাই করতে পারি না, কাহিল হয়ে যাই বেশি চালাইতে পারি না। বাজারের খরচ বেশি, এগুলাই কিনতে পারছি না।
“বউরে অনেক ঈদ ধরে কিছু কিনে দিতে পারি না, নিজের জন্য কিনি না। বাচ্চাদের তো না দিয়ে পারি না। ঈদ পর্যন্ত যা আয় করতে পারব, সেখান থেকে দুই বাচ্চার জন্য ফুটপাত থেকে কাপড় কিনে নিয়ে যাব।”
অপরদিকে ঈদের আর ১০ দিন হাতে থাকলেও এখনও ‘নিম্ন আর স্বল্প আয়ের ক্রেতা’ সংকটের কথা বলছেন মিরপুরের দোকানিরা।
মিরপুর ১১ নম্বরের মোহাম্মদীয় মার্কেটের নিউ আল আমিন শাড়ি বিতানের মুজিবর রহমান তালুকদার বলেন, “কাস্টমারই নাই। বিক্রি কমে গেছে ৪০ শতাংশ। খুবই খারাপ অবস্থা। আগে ধরেন মানুষ ৫/৬টা শাড়ি কিনে নিয়ে যাইত বাসার আশেপাশের গরীব মানুষদের দিতে, কেউ আবার অনেক শাড়ি কিনত।
“এবার এইরকম কাস্টমারও খুব কম। মানুষ এখন আগে খাইয়া বাঁচতে চাইছে, তারপর কেনাকাটা করে।”
শাড়ির আরেক দোকান অনামিকার বিক্রেতা মিঠু ব্যাপারীর দাবি, এবার কমমানের কাপড় বিক্রির পরিমাণ কমে গেছে। গত রোজায় তারা স্বল্প দামের ২ হাজার শাড়ি বিক্রি করলেও এবার ২১ রোজা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন ৫০০ শাড়ি।
“সব শাড়ি পড়ে আছে৷ আগে এমপি, মন্ত্রী, ব্যবসায়ীরা এগুলা কিনে এলাকার গরীব মানুষদের দিত৷ এখন তো কেনার লোকই নাই। কিছু সাধারণ মানুষ কিনে নিচ্ছে বাসার কাজের লোকদের দেওয়ার জন্য, এদের সংখ্যাটাও এবার কম৷
“মানুষের হাতে টাকা নাই, নিজেদের কেনাকাটাই করতে পারছে না। আর গরীব কাস্টামার তো পাচ্ছিই না।”
পুষ্প শাড়ি দোকানের বিক্রেতা মো. আতিফ বলেন, “বেশি করে কিনবে এমন কাস্টমার এবার এতটা নেই মার্কেটে। নিম্ন আয়ের ক্রেতারও এবার আসতেছে না। খুচরা এক-দুই পিস কাপড় বিক্রি হচ্ছে। কেউ কেউ তাদের জন্য গিফট হিসেবে কিনে নিচ্ছে, তাও খুব বেশি মানুষ কিনতেছে না। এই কোয়ালিটির কাপড় এবার সেকারণে নতুন আর তুলিনি৷”
মিরপুর ১০ নম্বরের ফুটপাত থেকে মেয়ের জন্য পার্টি ফ্রগ কিনছিলেন দারোয়ান আনিছ হোসেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মার্কেটে তো পোশাকের দাম অনেক বেশি। ফুটপাতেও ৫০০ টাকার নিচে কিছু নাই। বেতনের যে টাকা পাই এটাতে ঘর ভাড়া, খাওন, বাচ্চার খরচেই সব যায়গা। থাকে না কিছু। নিজে না কিনলেও বাচ্চারে কষ্ট করে হলেও দিতে অয়৷”
বিক্রেতা সবুজ মিয়া বলেন, তাদের বেশিরভাগ ক্রেতা স্বল্প আয়ের হলেও মধ্যবিত্তরাও ফুটপাতে ভিড় করছেন। তবে ফুটপাতে এখনও বেচাকেনা জমে ওঠেনি।
“মার্কেটে জিনিসের দাম বেশি তো, এ কারণে এখানে আসে। এবার ফুটপাতেও দাম একটু বাড়তি। হাতে হয়ত মানুষের টাকা নাই, এ কারণে আসে না। ওই রকম (নিম্ন আয়ের) মানুষ এবার কমই পাচ্ছি।”