এরমধ্যে আমানতের বিপরীতে সর্বোচ্চ ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে একটি ব্যাংক। এডিআর সীমা লঙ্ঘনের তালিকায় সাতটির পর্ষদ এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
Published : 07 Apr 2025, 01:39 AM
মাসের পর মাস আগ্রাসী ঋণ বিতরণের জের টানছে দেশের ১৬টি ব্যাংক; রাষ্ট্রয়াত্ত ও বেসরকারি এসব ব্যাংক আমানতের বিপরীতে নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে, যা আদায় করতে গিয়ে এখন হিমশিম খাচ্ছে।
এরমধ্যে সাতটি আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করে এখন ধুঁকছে, যেসব ব্যাংকের মধ্যে ছয়টির পর্ষদ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের সুবিধাভোগী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অপরটির পর্ষদও আগের সরকারের সময় ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির প্রতাপশালী এক নেতার নিয়ন্ত্রণে ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সীমার চেয়ে বেশি ঋণ দেওয়ায় ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট বেড়েছে। সেসব ঋণ ঠিকমত আদায় না হওয়ায় আমানত ফিরে পাওয়া নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক ডিসেম্বর শেষে ১৬টি ব্যাংকের অগ্রিম আমানত হারের (এডিআর) নির্ধারিত সীমা পেরিয়ে যাওয়ার এসব তথ্য শনাক্ত করেছে। এ তালিকায় দেখা যায়, সর্বোচ্চ ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে একটি ব্যাংক। এটিসহ সাতটি ব্যাংক ১০০ শতাংশের বেশি অর্থ্যাৎ ব্যাংকের মোট যে আমানত তার চেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে।
এডিআর সীমা ছাড়িয়ে আরও সাতটি ব্যাংক আমানতের ৯১ থেকে সাড়ে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে। আর দুটি প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ হার ৮৭ শতাংশ।
এসব ব্যাংকের মধ্যে দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বাকিগুলো বেসরকারি; আর চারটি ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক।
ক্ষমতার পালাবদলের পর নতুন গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আহসান এইচ মনসুর ব্যাংক খাতের সংস্কারের অংশ হিসেবে ১৪টিতে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেন। এগুলোর মধ্যে ডিসেম্বর শেষে ১১টি এডিআর সীমা অতিক্রম করেছে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে এ সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল ১০টি ব্যাংক।
ব্যাংকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, বাছ বিচারহীনভাবে ঋণ দেওয়া এবং পর্ষদের প্রভাবশালীরা ভিন্ন নামে ও সুবিধাভোগীদের নামে ঋণ বের করেন নিয়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর এডিআরের শৃঙ্খলা নষ্ট হয়েছে। এসব বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে সরকার পতনের আগে।
আগ্রাসীভাবে বিতরণ করা এসব ঋণের বড় অংশই এখন আদায় না হওয়ায় খেলাপি ঋণের বোঝা বাড়ছে। ফলে এখন ব্যাংকগুলোর দুর্দশা কাটছে না। নতুন ঋণ দেওয়া বন্ধ থাকার পাশাপাশি আমানত নিয়ে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। ব্যাংকগুলো আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে না।
ব্যাংকাররা বলছেন, দিনের পর দিন এডিআর সীমা না মেনে যেনতেনভাবে ঋণ দেওয়ার রাশ টানতে হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক ক্ষেত্রেই ছিল নির্বিকার। এ কারণে এখন পুরো ব্যাংক খাতজুড়ে শঙ্কা ও আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।
প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এডিআর সীমা ৮৭ শতাংশ এবং ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রমের বিনিয়োগ আমানত হার ৯২ শতাংশ।
অর্থাৎ প্রচলিত ব্যাংকে ১০০ টাকার আমানত এলে সর্বোচ্চ ৮৭ টাকার ঋণ বিতরণ করা যায়। ইসলামি ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে পারে ৯২ টাকা। বাকি অর্থের মধ্যে একটি অংশ সিআরআর (নগদ সংরক্ষণ) হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয় এবং বাকি অংশ এসএলআর (সংবিধিবদ্ধ তারল্য অনুপাত) খাতে (নিজের কাছে নগদ, সোনা বা বন্ডে) বিনিয়োগ করতে পারে।
ব্যাংকগুলোর নতুন পর্ষদের কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন, সরকার পতনের আগেই দেওয়া এসব ঋণের জের এখনও টানতে হচ্ছে। পালাবদলের পর ব্যাংক নিয়ে আস্থাহীনতা তৈরি হওয়ায় নতুন করে আমানত আসছে না। ঋণের অর্থও ফেরানো যাচ্ছে না। এতে এডিআর সীমা বেশিই থাকছে। নতুন করে ঋণ দিতে না পারায় আর্থিক সংকটও বাড়ছে ব্যাংকগুলোর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেসব ব্যাংক সীমার অতিরিক্ত ঋণ বিতরণ করেছে সেগুলোর ক্যামেলস রেটিং কমিয়ে দেওয়া হবে। এ রেটিং খারাপ হলে বহুবিধ সমস্যায় পড়ে ব্যাংক।
“বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিফাইন্যান্স ফ্যাসিলিটি পায় না। কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যায়। তাতে গ্রাহকরা ওই ব্যাংকে টাকা রাখতে চায় না। তাই তাদের নিজেদের জন্য হলেও ঋণ দেওয়ার এ সীমা কমিয়ে আনতে হবে। তা না হলে তাদের নিজেদের ফল নিজেদেরকেই ভোগ করতে হবে।”
এ বিষয়ে আর্থিক জরিমানার কোনো বিধান নেই বলে তুলে ধরেন তিনি।
এডিআর সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া ব্যাংকগুলোর একটি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, যেটির পর্ষদ চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
সরকার বদলের পর এটির নতুন পর্ষদে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়া আবদুল মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অতিরিক্ত ঋণ দেওয়ার বিষয়টি কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। মার্চ শেষে আমরা কমিয়ে আনব। আসলে আমানত বেশি উত্তোলন করা হয়েছে। এ কারণে এডিআর রেশিও বেড়েছে। এছাড়া এডিআর রেশিও বেড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ গ্রাহকের হিসাবে মুনাফা যোগ হওয়া।
“তবে আমানত আবার ফেরত আসছে। তাই এডিআর রেশিওতে সামনে সমস্যা হবে না।”
পর্ষদে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা আরেক ব্যাংক গ্লোবাল ইসলামীও এডিআর সীমা মানেনি।
এ ব্যাংকের নতুন পর্ষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এসব ব্যাংক আগে থেকেই ঋণ দিয়েছিল বেশি। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকেও একই ঘটনা ঘটেছে। এখন সেই ঋণ তো আর ফেরত আসছেই না বরং সুদ আরও যোগ হচ্ছে।
“এসএমই ছাড়া বড় ঋণ দেওয়া বন্ধ রেখেছে এসব ব্যাংক। তাই আগের দেওয়া ঋণের জের টানছে ব্যাংকগুলো।”
এডিআর সীমার নিয়ম না মানার বিষয়ে জানতে চাইলে লিখিত বক্তব্যে এবি ব্যাংক বলেছে, “২০২৩ সালে ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ শতাংশের অধিক। তখন ব্যাংকের এডভান্স ডিপোজিট রেশিও নির্ধারিত সীমার মধ্যে রাখা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালে ব্যাংকগুলোকে রেড-ইয়েলো-গ্রিন জোনে ভাগ করার বিভিন্ন ধরনের খবর প্রচার হয় এবং পরবর্তীতে ব্যাংক মার্জার সংক্রান্ত বিবিধ সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের আমানতকারীরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।
“ফলশ্রুতিতে ২০২৪ সালে করপোরেট গ্রাহকের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ের আমানতকারীরাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যাংক থেকে তাদের আমানত উত্তোলন শুরু করে। এর প্রভাব এবি ব্যাংকের উপরও পড়েছে, যার দরুণ ব্যাংক ২০২৪ সালে আমানতের কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়নি।”
এবি ব্যাংক বলছে, “এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আমানতকারীদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আমানতের প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ব্যাংক বিদ্যমান ডিপোজিট ধরে রাখার পাশাপাশি ব্যাংকের কোর ডিপোজিট বৃদ্ধির জন্য রিটেইল ডিপোজিট সংগ্রহের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপসহ নতুন নতুন ডিপোজিট প্রডাক্ট ডেভেলপমেন্টের কাজ চলমান রয়েছে।”
আগের ঋণ নিয়মিত আদায়ের ওপর গুরুত্বারোপ করার কথা তুলে ধরে ব্যাংকটির আশা, “২০২৫ সালের শেষে আমাদের গৃহিত পদক্ষেপগুলোর ফলে এডভান্স ডিপোজিট রেশিও উন্নতি হবে।”