ত্বকী হত্যার বিচার শুরু হয়নি এক দশকেও

ত্বকী ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন; ৮ মার্চ সকালে শহরের পাঁচ নম্বর ঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খালে তার মরদেহ পাওয়া যায়।

সৌরভ হোসেন সিয়াম, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2023, 02:25 AM
Updated : 7 March 2023, 02:25 AM

নারায়ণগঞ্জের মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের এক দশকেও বিচার শুরু হয়নি। এমনকি মামলাটির অভিযোগপত্রও দাখিল করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব।

২০১৩ সালের ৮ মার্চ শহরের পাঁচ নম্বর ঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খাল থেকে ত্বকীর মরদেহ উদ্ধারের পর থেকে বিচারের দাবি জানিয়ে আসছে স্বজন-শুভানুধ্যায়ীসহ দেশের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ।

র‌্যাব তদন্ত চলছে বললেও কবে নাগাদ শেষ হবে তা বলতে পারছে না সংস্থার কেউ।

ত্বকীর পরিবার ও সুধীমহলের অভিযোগ, নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী একটি পরিবার এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে তদন্ত শেষ হওয়ার পরও অভিযোগপত্র না দিয়ে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। দীর্ঘ সময়েও এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু না হওয়াকে তারা ‘বিচারহীনতার’ সংস্কৃতি বলে আখ্যা দিয়েছেন।

শহরের শায়েস্তা খাঁ সড়কের বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। অত্যন্ত মেধাবী এই তরুণ এ লেভেল পরীক্ষায় পদার্থবিজ্ঞানে (২৯৭/৩০০) সারাবিশ্বে সর্বোচ্চ এবং রসায়নে (২৯৪/৩০০) বাংলাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পান। তবে এই ফলাফল দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি।

২০১৩ সালে পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগের দিন ৬ মার্চ বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন। দুইদিন পর ৮ মার্চ সকালে শহরের পাঁচ নম্বর ঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খাল (কুমুদিনী খাল) থেকে তার মরদেহ উদ্ধার হয়।

গত বৃহস্পতিবার যে ঘরটিতে ত্বকী থাকতেন ওই ঘরেই কথা হয় তার বাবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির সঙ্গে। ওই ঘরের দেয়ালে ঝুলছে ত্বকীর একটি ফটোফ্রেম। সন্তানের স্মৃতি ধরে রাখতে ঘরটির তেমন পরিবর্তন করা হয়নি। ত্বকীর ব্যবহৃত পড়ার টেবিল, বসার চেয়ারটিও আগে যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে। মনের খেয়াল লিপিবদ্ধ করা খেরোখাতাটিও রাখা হয়েছে সযত্নে।

রফিউর রাব্বি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকালে বাসা থেকে বেরিয়ে শহরের সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে চাষাঢ়ায় আমার অফিসে আসার কথা। কিন্তু সে আর আসেনি। অনেক খোঁজাখুজি করেও তাকে না পেয়ে সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়।”

ত্বকী হত্যা মামলার নথি থেকে জানা যায়, নিখোঁজের দুইদিন পর ত্বকীর মরদেহ উদ্ধার হয়। ওইদিন অজ্ঞাতদের আসামি করে সদর মডেল থানায় মামলা করেন রফিউর রাব্বি।

এরপর ১৮ মার্চ শামীম ওসমান ও তার ছেলে অয়ন ওসমানসহ সাতজনের বিরুদ্ধে জেলার পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন রাব্বি। শামীম ওসমান বরাবরই ত্বকী হত্যাকাণ্ডে তার পরিবারের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে আসছেন।

শুরুতে থানা পুলিশ মামলাটির তদন্ত করলেও ওই বছরের ২০ জুন হাই কোর্টের নির্দেশে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় র‌্যাব। এরপর ৭ অগাস্ট শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে অবস্থিত উইনার ফ্যাশনে অভিযান চালায় র‌্যাব। সেখান থেকে রক্তমাখা জিন্স প্যান্ট, পিস্তলের বাট, ইয়াবার সরঞ্জাম উদ্ধারের কথা জানায় র‌্যাব। ওই সময় উদ্ধার হওয়া রক্তমাখা জিন্স প্যান্টটি তরুণ আশিকুল ইসলামের বলে দাবি করেছিলেন রফিউর রাব্বি। আশিক তার চাচাতো বোনের ছেলে। ২০১১ সালের ১১ মে সন্ধ্যায় নিখোঁজ হওয়ার দুদিন পর শীতলক্ষ্যা থেকে মেলে আশিকের অর্ধনগ্ন মরদেহ।

আশিক হত্যার দুই বছরের মাথায় ত্বকী হত্যার শিকার হন। ত্বকী হত্যা মামলায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে ইউসুফ হোসেন লিটন ও সুলতান শওকত ভ্রমর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তারা এই হত্যাকাণ্ডে নিজেদের জড়িত থাকার পাশাপাশি আজমেরী ওসমানসহ অন্যদের নামও প্রকাশ করেন।

আজমেরী ওসমানের বাবা প্রয়াত একেএম নাসিম ওসমান জাতীয় পার্টি থেকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে চারবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন এবং দুই চাচা একেএম শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবং একেএম সেলিম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও বিকেএমইএ-এর সভাপতি।

রফিউর রাব্বি বলেন, ২০১৪ সালের ৫ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান সাংবাদিকদের একটি ‘খসড়া অভিযোগপত্র’ সরবরাহ করেন। সেখানে এগারোজন এই কিলিং মিশনে অংশ নেয় বলে উল্লেখ করা হয়।

রফিউর রাব্বিকে শায়েস্তা করার জন্য তার ছেলে ত্বকীকে হত্যা করা হয় বলেও র‌্যাব ১৪ পৃষ্ঠার ওই ‘খসড়া অভিযোগপত্রে’ উল্লেখ করে।

২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী একেএম শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। ওই সময় আইভীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন রফিউর রাব্বি। নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরে যান শামীম ওসমান।

ত্বকী হত্যার প্রথম বর্ষপূর্তিতে র‌্যাব গণমাধ্যমে জানায়, আজমেরী ওসমানের নির্দেশে এবং প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে সহযোগীদের নিয়ে ত্বকীকে হত্যা করা হয়। পরে লাশ ফেলা হয় শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খালে। অচিরেই এই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।

এদিকে গ্রেপ্তার আসামিরাও জামিনে বেরিয়ে এসে এখন পলাতক। সর্বশেষ এই মামলায় কারাগারে থাকা সুলতান শওকত ভ্রমরও জামিন পেয়েছেন।

ত্বকী হত্যা মামলার বাদীপক্ষের আইজনীবী প্রদীপ ঘোষ বাবু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব দেশের সকল গণমাধ্যমকর্মীদের ডেকে সংবাদ সম্মেলনে কে, কেন, কীভাবে ত্বকীকে হত্যা করেছে বিস্তারিত জানিয়েছে। এই মামলায় গ্রেপ্তার দুই আসামি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে আজমেরী ওসমানসহ একাধিক ব্যক্তির এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িতের কথা বলেছে। এই হত্যা মামলার সবকিছুই স্পষ্ট। কিন্তু তারপরও র‌্যাব অভিযোগপত্র আদালতে দিচ্ছে না।

“এখন পর্যন্ত এই মামলায় ৬০ বার তারিখ ধার্য হয়েছে। ৬১তম তারিখ পড়েছে আগামী ১৪ মার্চ। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে আসা আসামিদের গ্রেপ্তারসহ অভিযোগপত্র দ্রুত দাখিলের বিষয়ে আদালতে আমাদের বক্তব্য একাধিকবার পেশ করেছি। আদালত অভিযোগপত্র দাখিলের জন্য তাগিদও দিয়েছেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।”

‘হত্যার কারণ স্পষ্ট ও আসামিরা চিহ্নিত’ হওয়ার পরও অভিযোগপত্র দাখিল না করায় বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলেও মন্তব্য করেন বাদীপক্ষের এই আইনজীবী।

তিনি বলেন, “র‌্যাব আদালতে অভিযোগপত্র দেয়ও না, আবার তাগিদ পাওয়ার পরও কবে নাগাদ দেবে তাও জানায় না। রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্তা-ব্যক্তিরা এগিয়ে না আসলে বিচার পাওয়ার যে সাংবিধানিক অধিকার তা থেকে বঞ্চিত হতে হবে।”

মামলাটির বর্তমান তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামলাটি একটু জটিল। তাছাড়া বদলিজনিত কারণে এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বেশ কয়েকবার পরিবর্তন হয়েছে। মামলাটির তদন্ত এখনও চলমান আছে। তবে কবে তদন্ত শেষ হবে তা বলতে পারছি না।”

হত্যাকাণ্ডের এক বছরের মাথায় সংবাদ সম্মেলনে দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়ার আশ্বাস প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, “ওই সময় কে কী বলেছে তা আমি ঠিক বলতে পারব না। কারণ ওই সময় আমি ছিলাম না।”

তবে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে বলে এখনও আশাবাদী সন্তানহারা বাবা রফিউর রাব্বী।

তিনি বলেন, “খুনিরা সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকজন হলে বিচারকাজ বন্ধ হয়ে যায়। এখন বিচার বন্ধ থাকলেও এই হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হবে। এই সরকার থাকতে হোক কিংবা পরেই হোক।”

ত্বকী হত্যার বিষয়ে মন্তব্যের জন্য নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানের মোবাইল ফোনে একাধিবার কল করে এবং খুদেবার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

তবে আজমেরী ওসমানের মা জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য পারভীন ওসমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এত পুরোনো জিনিসটা নিয়ে প্রতিনিয়ত ঘাঁটাঘাঁটি হয়। ত্বকীর কথা আসলেই আমার পরিবার নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। এইটা নিয়ে আমরা কখনও কথা বলিনি, বলারই বা কী আছে? সত্য একদিন উদঘাটিত হবেই। আমি সহস্রবার বলব, এইটার সাথে আমার ছেলে জড়িত না। আমরাও চাই, ত্বকী হত্যার বিচার হোক, সত্যটা উদঘাটিত হোক।”

এদিকে, ত্বকী হত্যার দশক পেরিয়ে গেলেও বিচারকাজ না হওয়ায় একে ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন সুধীমহল। গত শুক্রবার বিকালে এই হত্যাকাণ্ডের দশক পূর্তিতে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ আয়োজিত সমাবেশে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ ও মানবাধিকারকর্মী খুশি কবিরসহ সুধীজনরা এই হত্যার বিচার করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দাবি করেছেন।