চাঁদপুর জেলায় প্রায় ৪৫ হাজার জেলে পরিবার তালিকাভুক্ত। তিন কিস্তিতে প্রতি পরিবার পেয়েছে ৪০ কেজি করে চাল।
Published : 10 Apr 2024, 09:15 PM
চারপাশে এখন মানুষের বাড়ি ফেরার ধুম; সদ্য কেনা পোশাকের গন্ধ। ঘরে ঘরে চলছে বাহারি পদের খাবার তৈরির প্রস্তুতি। ঈদকে ঘিরে এতসব আয়োজনের কিছুই নেই চাঁদপুরের চরাঞ্চলের জেলেদের পরিবারে।
ঈদের আমেজ দূর থাক, বেশিরভাগ জেলে পরিবার নতুন জামা-কাপড় কিনতে পারছে না। এমনকি ঈদের দিনের জন্য চিনি-সেমাই কেনারও সামর্থ্য নেই পদ্মা-মেঘনা নদী তীরবর্তী চরের অধিকাংশ জেলে পরিবারের।
নদীতে মাছ ধরে যাদের জীবন কাটে, নিষেধাজ্ঞার দিনগুলোতে সেসব পরিবারগুলোর অধিকাংশেরই কাটে কষ্টে। এবার এই সময়টায় ঈদ পড়ে যাওয়ায় সামান্য আয়োজনটুকু করতে না পারার কষ্টে মলিন হয়েছে উচ্ছ্বাস।
তাদেরই একজন চাঁদপুর সদর উপজেলার হরিনা ফেরিঘাট এলাকার হাবু ছৈয়াল। দীর্ঘ ৩০ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন মাছ শিকার করে। এবার মাছ ধরা বন্ধ তাই অর্থ নেই হাতে। পরিবারের মুখে হাসি নেই; একমাত্র উপার্জনক্ষম এ ব্যক্তির মনের স্বস্তিটুকুও উবে গেছে।
হাবু ছৈয়াল বলেন, “নদীতে মাছ ধরা নিষেধ থাকায় অলস সময় কাটাচ্ছি। কয়েকদিন পরই ঈদ। কিন্ত হাতে তো টাকা-পয়সা নাই। ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রীকে পোশাক কিনে দেওয়ার সামর্থ্যও নাই।”
‘ইলিশ অভয়াশ্রম’ কর্মসূচির আওতায় জাটকা রক্ষায় মার্চ-এপ্রিল দুই মাস নদীতে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা নদীর ৭০ কিলোমিটার এলাকা এ নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন।
চাঁদপুরের মেঘনা নদীর তীরবর্তী কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ জেলে পরিবারে চলছে হাহাকার। এক মাসের বেশি সময় ধরে আয় না থাকায় নিদারুণ কষ্টে কাটছে তাদের দিন। কেউ কেউ আশা করছেন, ঈদের আগে দুই-একদিন ইলিশ ধরতে পারলে পরিবারের জন্য কিছু খরচ করা যেত।
এদিকে জেলা মৎস্য বিভাগ বলছে, চাঁদপুর জেলায় প্রায় ৪৫ হাজার জেলে পরিবার সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত রয়েছে। এ সময় তিন কিস্তিতে প্রতি পরিবারকে ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে অধিকাংশ এলাকার এসব জেলে পরিবারের মাঝে দুই দফা চাল দেওয়া হয়েছে।
হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী এলাকার জেলে মো. হারুন বলেন, “বিগত বছরগুলোতে মাছ ধরে যা উপার্জন করেছি, তা দিয়ে কোনোরকম সংসার চলেছে। অন্যান্যবার তো যেভাবে হোক, ঈদে ছেলে-মেয়ে, বাবা-মাকে নতুন কাপড় দেই। তবে এবারের ঈদে ভীষণ সমস্যার মধ্যে পড়েছি।”
ওই এলাকার জেলে মো. ইদ্রিছ বলেন, “ঈদের আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। এখনও জামা-কাপড় কিনতে পারি নাই। ঘরে বাচ্চারা কান্নাকাটি করে। কিন্তু কেমনে দিব? বাজার কেনাই তো সামর্থ্য নেই।
“ঈদের আগে নদীতে মাছ ধরতে পারলেই কেবল সেমাই-চিনি, সন্তান ও নিজেদের জন্য কাপড় নিতে পারতাম।”
হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী এলাকার জেলেপল্লীর গৃহবধূ আমেনা বেগমের কপালে এখন দুশ্চিন্তার ভাঁজ। ঈদে পরিবারের জন্য চাই নতুন পোশাক আর ভালো খাবার। কিন্তু সেই সামর্থ্য তার নেই তার।
আমেনা বলেন, “মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় গত এক মাস আমাদের পরিবারের কোনো আয় নেই। আমার স্বামী বাড়িতে বসে বেকার সময় পার করছে। আমরা তো দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষ।”
চরভেরবী এলাকায় জেলেপল্লী ঘুরে দেখা গেল, সারি সারি মাছ ধরার নৌকা অলস পড়ে আছে। জাটকা সংরক্ষণে দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা চলছে, তাই এসব নৌকা নদীতে নামতে মানা। এরই মধ্যে পেরিয়েছে এক মাস। ঈদের দিন যত সামনে আসছে, জেলেদের কপালে চিন্তার রেখা তত স্পষ্ট হচ্ছে।
চাঁদপুর সদর উপজেলার হানারচর ইউনিয়নের গোবিন্দিয়া এলাকার জেলে ইদ্রিস গাজী বলেন, “ভাই নাও বাওয়া মানা। পরিবার নিয়া কষ্টে আছি। ঈদে পরিবার, সন্তানগো যে কিছু দিমু কোনো উপাই দেহি না।”
চাঁদপুর সদর উপজেলায় লক্ষ্মীপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা হানুফা বেগমের সংসার চলে তার স্বামী নদীতে জাল ফেললে। মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার এ সময়ে তিনিসহ পরিবারের ছয়জনের সময় কাটছে টেনেটুনে।
ঈদের আয়োজন কী- জানতে চাইলে একবুক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হানুফা বলেন, “স্বামীর উপার্জন বন্ধ। তাই ঈদে সন্তানদের নতুন কাপড় কিনে দিতে পারবেন না। সংসারই চলে না; ঈদের জন্য আর কী আয়োজন করব?”
এসব জেলেদের দুর্দশা দূর করতে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে? জানতে চাইলে চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, “চাঁদপুরে ৪৪ হাজার ৩৫ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছে; এটা বড় সংখ্যক কমিউনিটি। এখানে তো এক-দুইশ লোক না। তবে সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে।
“জেলেদের বিকল্প আয়বর্ধকমূলক উপকরণ হিসেবে সেলাই মেশিন, ছাগল, গরু ও পরিবেশবান্ধব জালসহ বিভিন্ন উপকরণ দেওয়া হয়েছে। তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য এগুলো করা হচ্ছে।”
তিনি বলেন, ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় নিবন্ধনকৃত প্রত্যেক জেলেকে প্রতি মাসে ৪০ কেজি করে চার মাসে ১৬০ কেজি চাল দেওয়া হয়। চালের অর্ধেক এরইমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। বাকি দুই মাসের চাল সহযোগিতা দ্রুতই দেওয়া হবে।
কর্মহীন এসব জেলেদের জন্য ঈদে বিশেষ কোনো সহায়তা দেওয়া হবে কী না জানতে চাইলে বলেন, সরকার থেকে জেলেদের চাল, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সহযোগিতা তো করা হচ্ছেই। ঈদের জন্য আলাদা করে কোনো ব্যবস্থা নেই। নিবন্ধিত সব জেলেকে ঈদের আগেই সরকারি চাল সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।