ভারতের ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে নিজের দ্বিতীয় সেরা মৌসুম কাটিয়ে বাংলাদেশে ফিরছেন অভিজ্ঞ এই বাঁহাতি পেসার।
Published : 02 May 2024, 10:21 AM
শেষে এসে প্রথমবার উইকেটশূন্য মুস্তাফিজুর রহমান। এবারের আইপিএলে কেবল এই ম্যাচটিতেই উইকেট পেলেন না তিনি। একটি উইকেট পেলেও ‘পার্পল ক্যাপ’ মাথায় নিয়ে দেশে ফিরতে পারতেন বাংলাদেশের বাঁহাতি পেসার। অবশ্য উইকেট না পেলেও পাঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে বুধবার তার বোলিং ছিল আঁটসাঁট। রান সুনামির এবারের আইপিএলে চেন্নাইয়ের প্রথম বোলার এবং গোটা আসরের প্রথম বিদেশি বোলার হিসেবে মেইডেন ওভারের স্বাদও পেলেন। ম্যাচ শেষে চেন্নাই সুপার কিংসের ফেসবুক পাতায় তার ছবি পোস্ট করে লেখা হলো, ‘ফিজের স্পেলের প্রশংসা করতেই হবে।’
চার উইকেট নিয়ে এবারের আইপিএল শুরু করেছিলেন মুস্তাফিজ, বুধবার শেষ করলেন চার ওভারের নিয়ন্ত্রিত স্পেল দিয়ে (৪-১-২২-০)। শুধু এই স্পেল নয়, প্রশংসা পাচ্ছেন তিনি গোটা আইপিএলে তার পারফরম্যান্স দিয়েই। আইপিএল ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেরা মৌসুম কাটিয়ে তিনি দেশে ফিরছেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ভাগে যোগ দেবেন বাংলাদেশ দলের সঙ্গে। প্রশ্নটির গভীরে তাই এখন যাওয়া যায়, তার এই পারফরম্যান্স কতটা কাজে লাগবে বাংলাদেশ দলের জন্য?
উত্তর খোঁজার আগে এবারের আইপিএলে মুস্তাফিজের সামগ্রিক পারফরম্যান্সে ফিরে তাকানো যাক। টুর্নামেন্টে অভিযান শেষ করে যখন দেশের পথে উড়াল দিচ্ছেন তিনি, তখনও যৌথভাবে সর্বোচ্চ ১৪ উইকেট তার। সমান উইকেট নিয়েও ওভারপ্রতি রান কম দেওয়ায় আপাতত ‘পার্পল ক্যাপ’ জাসপ্রিত বুমরাহর মাথায়।
বিশ্বের শীর্ষ এই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে এবারের চেয়ে ভালো মৌসুম কাটিয়েছেন মুস্তাফিজ একবারই। সেটি তার বহু চর্চিত সেই অভিষেক আসর।
২০১৬ আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে ১৬ ম্যাচ খেলে ১৭ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি ওভারপ্রতি স্রেফ ৬.৯০ রান দিয়ে। দলকে শিরোপা জিতিয়ে সেবার তিনি সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের পুরস্কারও জিতেছিলেন। এখনও পর্যন্ত এই খেতাবজয়ী একমাত্র বিদেশি ক্রিকেটার তিনি। শুরুর সেই আসরকে আর ছাড়িয়ে যেতে পারেননি পরের ছয় আসরে। এবারের মতো ১৪ উইকেট নিয়েছিলেন অবশ্য ২০২১ আসরেও। তবে রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে সেবার ম্যাচ খেলেছিলেন ১৪টি। এবার চেন্নাইয়ের হয়ে খেলেছেন ৯ ম্যাচ। ওভারপ্রতি রান অবশ্য এবার বেশি দিয়েছেন, তবে বোলিং গড় বেশি ভালো এবারই। সব মিলিয়ে আইপিএলে তার দ্বিতীয় সেরা মৌসুম এটিই।
ওভারপ্রতি রানের দিক থেকে এবার খরুচে (৯.২৬) ছিলেন বটে, তবে এবারের আইপিএলের বাস্তবতায় তা বিস্ময়কর নয়। মুস্তাফিজ-বুমরাহর মতোই ১৪ উইকেট শিকারি হার্শাল প্যাটেল ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন ১০.২৪। ১৩ উইকেট শিকারি মুকেশ কুমার দিয়েছেন ওভারপ্রতি ১১ রানের বেশি, সমান উইকেট নিতে ১০ রানের বেশি দিয়েছেন জেরল্ড কুটসিয়া ও আর্শদিপ সিং। কুটসিয়া জায়গা পেয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ দলে, আর্শদিপ আছেন ভারতের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে।
নিখাদ পরিসংখ্যানের বাইরে গেলে, তার পারফরম্যান্সকে বলা যায় মিশ্র। অনুমিতভাবেই চেন্নাইয়ের চিদাম্বারাম স্টেডিয়ামে তিনি ছিলেন বেশি কার্যকর। এই মাঠে ছয় ম্যাচে ১১ উইকেট নিয়েছেন ওভারপ্রতি ৭.৭৯ রান দিয়ে। চেন্নাইয়ের বাইরে তিনটি ম্যাচে তিন উইকেট নিতে ওভারপ্রতি ১২ রানের বেশি খরচ হয়েছে তার।
তার মূল শক্তির জায়গা যেটিকে ধরা হয়, শেষের ওভারগুলোয় কার্যকারিতা, সেখানেও পারফরম্যান্সে ছিল ভালো-মন্দের মিশেল। কখনও তিনি ছিলেন উপযোগী, কখনও খরুচে। কখনও দলের পরিকল্পনা অনুযায়ী বল করতে পেরেছেন, কখনও করেছেন গড়বড়।
তবে টুর্নামেন্ট শুরুর আগের বাস্তবতা যদি চিন্তা করা হয়, তিনি আদৌ কত ম্যাচ খেলতে পারবেন, এটা নিয়েও সংশয় ছিল অনেকের। মাথিশা পাথিরানা তখন চোটে থাকাতেই হয়তো প্রথম ম্যাচটি খেলার সুযোগ পান মুস্তাফিজ এবং সেদিনই চার উইকেট নিয়ে বাজিমাত করে ফেলেন। পরে পাথিরানা ফিরলেও মুস্তাফিজকে বাইরে রাখতে পারেনি দল। সেদিক থেকে চিন্তা করলে, এবারের আইপিএলে তিনি দারুণ সফল।
মূল কৌতূহল, সেই সাফল্যের রেশ কতটা কাজে লাগবে বাংলাদেশ দলে। তাকে নিয়ে দেশের ক্রিকেটে টানাপোড়েন দীর্ঘদিনের। সেটি তার পারফরম্যান্সের কারণেই। কখনও তিনি নিজেকে হারিয়ে খোঁজেন, কখনও থাকেন একদম অচেনা, কখনও আবার পুরোনো দিনের ঝলক দেখিয়ে আশা জাগান সেরা সময়ে ফেরার। গত কয়েক বছরে এই চক্রেই চলছে তার জাতীয় দলের ক্যারিয়ার।
সেখানে এবারের আইপিএলে নতুন কিছু খুব একটা দেখাননি তিনি। শেষ ম্যাচটিতে পাঞ্জাবের বিপক্ষে ও আগের দু-একটি ম্যাচে ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্য বল ভেতরে আনতে পেরেছেন কয়েকটি ডেলিভারিতে। কয়েকটি ওয়াইড ইয়র্কার দেখা গেছে কিছু সময়ে। কিছু কিছু পরিস্থিতিতে দলের ছক আর ফিল্ডিং সাজানো অনুযায়ী বোলিং করতে পেরেছেন। তবে কোনোটিই খুব বড় আশার জায়গা নয়। এসব তো তিনি মাঝেমধ্যে এমনিতেও করে থাকেন।
নতুন কিছু করতে বা পুরোনো কিছুধারাবাহিকভাবে ধরে রাখতে সেভাবে দেখা যায়নি আইপিএলেও। যেসব উইকেটে বল একটু থমকে এসেছে বা কিছুটা গ্রিপ করেছে, যথারীতি সেখানে তার স্লোয়ার ও কাটার কার্যকর হয়েছে।
বিশাখাপাত্নাম, ওয়াংখেড়ে ও লাক্ষ্নৌর ব্যাটিং উইকেটে তাকে অসহায়ই মনে হয়েছে। চেন্নাইতেও সবচেয়ে ভালো ব্যাটিং উইকেট ছিল যে ম্যাচে, যেদিন দুই দলই দুইশ ছাড়িয়েছে, সেখানেও তিনি চার ওভারে দিয়েছেন পঞ্চাশের বেশি রান।
বোলিং স্কিল, নতুন কিছু রপ্ত করা, পুরোনো কিছু ঝালাই করার ক্ষেত্রে তাই আইপিএল থেকে খুব দারুণ কিছু নিয়ে ফিরছেন না মুস্তাফিজ।
একটা জায়গায় অবশ্য আইপিএলের পারফরম্যান্স তার জন্য ‘টনিক’ হতে পারে, সেটি হলো আত্মবিশ্বাস। বাংলাদেশের হয়ে সবশেষ যে টি-টোয়েন্টি সিরিজ তিনি খেলেছেন, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই সিরিজটি তার জন্য ছিল চরম হতাশার। ক্যারিয়ারের প্রথমবারের মতো টানা তিন ম্যাচে রান দিয়েছিলেন চল্লিশের বেশি।
গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে এখনও পর্যন্ত ১৩ টি-টোয়েন্টি খেলে তার উইকেট মোটে ১০টি। ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন সাড়ে সাতের বেশি। এই সময়টায় ১১ ম্যাচ খেলে ২০ উইকেট নিয়েছেন তাসকিন আহমেদ।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, দেশের হয়ে এই সংস্করণে সবশেষ ৩৬টি বোলিং ইনিংসের কোনোটিতে দুটির বেশি উইকেট তিনি নিতে পারেননি।
সেখান থেকে এবারের আইপিএলে গিয়ে তিনি প্রথম ম্যাচে চার উইকেট নিয়েছেন, তার আইপিএল ক্যারিয়ারেই যা প্রথম। টুর্নামেন্ট ছেড়ে আসার সময় তিনি সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। নিজ দলে ও গোটা টুর্নামেন্টে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছেন। তাকে আর পাওয়া যাবে না বলে দল থেকে আফসোসের কথাও বলেছেন নানা জনে। এই সবকিছুই তার আত্মবিশ্বাসে নতুন দোলা দেওয়ার কথা।
নিজেকে নিয়ে যদি সংশয় কিছু থাকত তার ভেতরে কিংবা মনের কোনো কোণে, সেখানেও আপাতত প্রলেপ পড়ার কথা বিশ্বমানের একটি আসরে বল হাতে প্রভাব রাখার পর।
এছাড়াও মাহেন্দ্র সিং ধোনি, স্টিভেন ফ্লেমিং, মাইক হাসিদের সংস্পর্শে এসে তাদের ক্রিকেট মস্তিষ্ক থেকেও আগের চেয়ে কিছুটা সমৃদ্ধ হওয়া উচিত তার। সেটি অবশ্য নির্ভর করছে একদমই তার ওপর, আদতে কতটা তিনি নিতে পেরেছেন।
সব মিলিয়ে আইপিএলের পর তাকে নিয়ে যদি নতুন করে আশার সঞ্চার কিছু হয়, তা বোলিংয়ের চেয়ে বেশি ওই আত্মবিশ্বাস আর মানসিকতা ঘিরেই।
সেই আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়ায় তিনি কিছুটা ধারাবাহিকতা ফিরে পাবেন, খুব বিধ্বংসী না হলেও কার্যকর কিছু অবদান রাখতে পারবেন, দলের প্রয়োজনের সময় অভিজ্ঞতাটুকু মেলে ধরতে পারবেন, এই আশাই কেবল করতে পারে বাংলাদেশ দল। ম্যাচের পর ম্যাচ ক্ষুরধার বোলিং হয়তো তার কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। তবে দলের বোলিং আক্রমণের একটা অংশ হিসেবে নিজের কাজটুকু করবেন, ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট ভূমিকাটুকু পালন করবেন, সতীর্থ বোলারদের সঙ্গে জুটি বেঁধে কাজ করবেন, এই আশাটুকু অন্তত করা যায়।
টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে প্রায় আড়াইশ ম্যাচ খেলার পর এবং আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে প্রায় ৯ বছর কাটিয়ে এখন তার হয়ে ওঠার কথা বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণের অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। একাদশে তার জায়গাই প্রশ্নবিদ্ধ হয় এখন প্রায়ই। আইপিএলে ১৪ উইকেটের আত্মবিশ্বাসের সুধায় জাতীয় দলে কিছুটা ধারাবাহিক হবেন, বড় ম্যাচে ও কঠিন পরিস্থিতিতে অধিনায়ক আবারও ভরসা নিয়ে তার হাতে বল তুলে দিতে পারবে, মুস্তাফিজের কাছে হয়তো এটুকুই আশা বাংলাদেশ ক্রিকেটের।