জীবনযুদ্ধে কারও বোঝা হতে চান না বরিশালের শাহীন ফকির। তাইতো শারীরিক প্রতিবন্ধিতা দমিয়ে রাখতে পারেনি মাত্র ১৮ ইঞ্চি উচ্চতার এই যুবককে।
গত পাঁচ বছর ধরে নিজের ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করেছেন ত্রিশোর্ধ্ব শাহীন। তার দোকানে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার পাশাপাশি শিশুদের চকলেট, বিস্কুটসহ কয়েক ধরনের পণ্য বিক্রি করেন তিনি।
জন্মের পর পোলিও আক্রান্ত হয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বেড়ে ওঠা শাহীনের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য প্রিয় খেলোয়াড় তামিম ইকবালের সঙ্গে দেখা ও কথা বলার সুযোগ পাওয়া।
শাহীন বরিশালের মুলাদী উপজেলার চর কমিশনার এলাকার আবুল হাসেম ফকিরের ছেলে। বাবা-মা, দুই ভাই, চার বোন ও ভাবি-ভাতিজীকে নিয়ে যৌথ পরিবারে বাস করেন তিনি। তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। এক ভাই মালয়শিয়া প্রবাসী।
চতুর্থ শ্রেণির পর পড়াশোনা চালিয়ে নিতে না পারলেও কাজ-কর্ম করে নিজের আয়েই বেঁচে থাকার লক্ষ্য ঠিক করেছেন উদ্যমী শাহীন।
শাহীনের মা আলেয়া বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সাত দিন বয়সী শাহীন অনেক কান্নাকাটি করলে তাকে স্থানীয় পল্লী চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। চিকিৎসক তাদের বরিশালে নিয়ে ‘বড় ডাক্তার’ দেখাতে বলেন।
কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট এবং যাতায়াতের দুর্গমতার কারণে তাদের পক্ষে তা করা সম্ভব হয়নি।কিছুদিন পর শাহীনের হাত পা বেঁকে যেতে থাকলে তারা বরিশালে নিয়ে জানতে পারেন সে পোলিও আক্রান্ত হয়েছে।
আলেয়া বেগম আরও জানান, শাহীন নিজে কিছু করতে পারেন না। গোসল, বাথরুমসহ দৈনন্দিন সব কাজে তার অন্যের সহায়তা প্রয়োজন হয়।
তারপরও শাহীন কারো বোঝা না হয়ে নিজের আয়ে চলতে চায়, সেজন্য কষ্ট করে হলেও সে প্রতিদিন দোকানে যায়, বলে জানান তার মা আলেয়া বেগম।
বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরত্বে বরিশাল সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের হায়াতসার গ্রামে ফুলতলা বাজারের পূর্বে শাহীনের দোকান।
একটি জরাজীর্ণ হুইল চেয়ারে বসে দোকানে ও বাসায় যাওয়া-আসা করেন তিনি। তবে নিজে চেয়ারটি চালাতে না পারায় তিনি মাসিক পাঁচশ টাকার বিনিময়ে একজন লোক ঠিক করেছেন। যে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৯টায় তাকে দোকানে নিয়ে আসে ও রাত ৮টার দিকে বাসায় পৌঁছে দেয়।
কোনো লোকের সাহায্যে ছাড়া তিনি কিছু করতে পারেন না জানিয়ে তিনি বলেন, “এলাকার পোলাপানরা কাজকর্মে সাহায্য করে। কোনো সমস্যা হয় না। দোকানের আশে-পাশে কিশোর ও তরুণ কেউ না কেউ থাকেই।”
নিজের উচ্চতা ঠিক কতটুকু তা সঠিক জানেন না জানিয়ে শাহীন বলেন, “অনেক বছর পূর্বে একজন পরিমাপ করেছিলো। সে জানিয়েছে আমার উচ্চতা মাত্র ১৮ ইঞ্চি।”
তিনি বলেন, “বাইচ্যা থাকতে অইলে কাম কইরা খাওয়া লাগে, এছাড়া তো খাওয়া যায় না। আমার মতো মানুষ যারা, তারা ভিক্ষা কইরা খায়। আমি ওই পথে যাইতে চাই না, ওটা ভালো পথ না। তাই করমো কইরা খাই।”
দোকান থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ টাকা আয় করেন বলে জানান শাহীন। আয়ের টাকা নিজেই ব্যয় করেন। তার ইচ্ছা ব্যবসা বাড়ানো, আরও বড় করে দোকান করা।
তবে এই স্বল্প আয়েই পরোপকারী হিসেবে আশেপাশের মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি।
তার দোকানে আসা তরুণ রাকিবুল ইসলাম বলেন, “সে খুব ভালো লোক। কারো যদি টাকা লাগে, তাকে টাকা ধার দেয়। মানুষের সহায়তা তার প্রয়োজন, কিন্তু উল্টো সে মানুষকে সহায়তা করে।”
এলাকার সবাই শাহীনকে ভালবাসে জানিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তাকে আমরা সবাই সহায়তা করি। আমরা নিজেরাও মাঝে মধ্যে বাড়ি থেকে নিয়ে আসি। আবার বাড়িতেও পৌছে দেই।”
এছাড়া সৎ ব্যবসায়ী হিসেবেও শাহীনের সুনাম আছে জানিয়ে দোকানে থাকা আরেক কিশোর নুরুজ্জামান নাঈম বলেন, “কাউকে তিনি ঠকান না। এমনকী গ্রামের যারা, নগদ, রকেট ও বিকাশে পাসওয়ার্ড মনে রাখতে পারে না, তারাও পাসওয়ার্ড শাহীন ভাইর কাছে রাখে। টাকা এলে উঠিয়ে দেন তিনি।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় জীবনের একটি চাওয়ার কথা জানান ক্রিকেটপ্রেমী শাহীন।
তিনি বলেন, “জীবনে একবার হলেও তামিম ইকবালের সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে চাই। আমার জীবনের একটা লক্ষ্যই হচ্ছে তামিম ইকবালের সঙ্গে একটিবার হলেও একটু কথা বলা।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মাধ্যমেও প্রিয় খেলোয়াড় তামিম ইকবালকে একবার হলেও তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ জানান জীবনযুদ্ধে হার না মানা এই যুবক।
এ ছাড়া নিজের জরাজীর্ণ হুইল চেয়ারটি দেখিয়ে তিনি বলেন, “কেউ যদি একটি মোটরচালিত হুইল চেয়ার উপহার দিত, তাহলে জীবনটা আরেকটু সহজ হত।”
শায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরিফুজ্জামান মুন্না তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শারীরিক প্রতিবন্ধিতা শাহীনকে আটকে রাখতে পারেনি। নিজেকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করছে সে।”
শাহীন সরকারি প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের হাতে তো খুব বেশি কিছু করার সুযোগ থাকে না, তবু তাকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।”
শাহীনের জরাজীর্ণ হুইল চেয়ারের বিষয়ে তিনি বলেন, “বিষয়টি জানা ছিলো না, আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে একটি হুইল চেয়ার দেওয়ার চেষ্টা করবো।”