সাপে কাটা রোগী সবচেয়ে বেশি মেলে গ্রামেগঞ্জে এবং মফস্বলে। অথচ উপজেলা পর্যায়ে অনেক হাসপাতালে জীবনরক্ষাকারী এ ওষুধ নেই।
Published : 23 Jul 2023, 01:21 AM
কৃষক জাহিদ প্রামাণিক প্রতিদিনের মতই ক্ষেতে গিয়েছিলেন কাজ করতে। পাট ক্ষেত নিড়ানি দেওয়ার সময় ডান হাতের বুড়ো আঙুলে কিছু একটা কামড় দেয়। সামনে তাকিয়ে দেখেন ছোট এক সাপ। সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাঁচি দিয়ে সেই সাপকে দুই টুকরো করে পলিথিনের ব্যাগে ভরে হাসপাতালে উপস্থিত হন। চিকিৎসকরা জানান, সাপটি রাসেলস ভাইপার।
রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার হাবাসপুর ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের কৃষক জাহিদ প্রামাণিক দুই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে ফিরলেও শারীরিক জটিলতা তার কাটেনি।
শুক্রবার তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, “আল্লাহ বাঁচাইছে, তাই এহনও বাঁচে আছি। যে সাপ কামড়াইছে শুনলাম এই সাপ কামড়াইলে মানুষ বাঁচে না।”
জাহিদ প্রাণে বেঁচে ফিরলেও সেই রাসেলস ভাইপারের ছোবলেই প্রাণ হারিয়েছেন ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের হরিরামপুরের সাপুড়ে মো. ইসলাম চৌধুরী (৩৭)।
তিনিও চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। কিন্তু হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম ছিল না। পরে বাইরে থেকে অনেক দাম দিয়ে অ্যান্টিভেনম কিনেছিলেন। কিন্তু বাঁচানো যায়নি ইসলামকে। সাপে কাটার ১০ দিন পর বৃহস্পতিবার রাতে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
একই দিনে প্রাণ হারিয়েছেন একই উপজেলার টিলারচরের কৃষক বিশা প্রামাণিক (৫৪)। সাপে কাটার ৩৬ দিন পর নিজের বাড়িতেই শারীরিক জটিলতা নিয়ে তিনি মারা যান। চিকিৎসকদের ধারণা, বিশা প্রামাণিককেও হয়ত রাসলস ভাইপারই কামড়েছিল।
বিশা প্রামাণিক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কয়েকদিন চিকিৎসা নিয়েছিলেন; কিন্তু কোনো অ্যান্টিভেনম তাকে দেওয়া হয়নি। পরে পরিবার তাকে বাড়ি নিয়ে যায়। সেখানেই তিনি মারা যান।
জাহিদের বাড়ি পাংশা উপজেলার হাবাসপুর, নজরুলের বাড়ি ফরিদপুর চরভদ্রাসনের হরিরামপুর, কিংবা বিশা প্রামাণিকের বাড়ি টিলারচর পদ্মা নদী সংলগ্ন।
ফরিদপুরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ গোলাম কুদ্দুস ভুঁইয়া বলেন, “বর্ষা মৌসুমে সাপের উপদ্রব বেড়েছে। রাসেলস ভাইপার মূলত আসছে মধুমতি ও পদ্মার স্রোতে মিশে। গত দু-তিন বছর ধরে এই সাপের উপদ্রব এ অঞ্চলে বেড়েছে। প্রতি বছরই দেখছি দু-তিনজন করে মারা যাচ্ছে।”
বাংলাদেশের রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে রাসেলস ভাইপার বেশি দেখা যায়। তবে ইদানিং উপকূলীয় পটুয়াখালীতেও এর দেখা মিলছে। খাবারের সন্ধানে ফসলের মাঠে চলে আসে এই বিষাক্ত সাপ।
প্রতিবেশী ভারত ও শ্রীলঙ্কায় এই সাপের আধিক্য রয়েছে। এই দুই দেশে যত মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়; তার মধ্যে ভারতে প্রায় ৪৩ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় প্রায় ৪০ শতাংশ মৃত্যু হয় রাসেলস ভাইপারের দংশনে। বাংলাদেশে এই হার অত বেশি নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪ লাখের বেশি মানুষকে সাপে কাটে, তাদের মধ্যে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। ৯৫ শতাংশ ঘটনা ঘটে গ্রামঞ্চলে।
বিষধর সাপ কামড়ালে সেই বিষ নিষ্ক্রয় করতে অ্যান্টিভেনম দেওয়া জরুরি। তা না হলে মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় অ্যান্টিভেনমকে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় রাখা হলেও বাংলাদেশে এখনও কোনো অ্যান্টিভেনম তৈরি হয় না, আমদানি করতে হয়।
সাপে কাটা রোগী সবচেয়ে বেশি মেলে গ্রামেগঞ্জে এবং মফস্বলে। অথচ উপজেলা পর্যায়ে বেশিরভাগ হাসপাতালে জীবনরক্ষাকারী এ ওষুধটি নেই। জেলা পর্যায়ের অনেক হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম থাকলেও তার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। আবার কোথাও কোথাও অ্যান্টিভেনম থাকলেও আইসিইউ না থাকায় চিকিৎসকরা ঝুঁকি না নিয়ে রোগীকে বড় হাসপাতালে পাঠান। কিন্তু বড় হাসপালে পৌঁছানোর আগেই রোগীর মৃত্যু হয়।
সে কারণে উপজেলা পর্যায়ে সাপে কাটা রোগীকে এক ডোজ হলেও অ্যান্টিভেনম দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের যুক্তি, তাতে রোগীর প্রাণ বাঁচানোর সম্ভাবনা বাড়বে।
সাপুড়ে মৃত কালা চাঁনের ছেলে ইসলাম চৌধুরী ফরিদপুর শহরের নিকটবর্তী মুন্সীবাজার বেদে পল্লিতে থাকতেন, গত ১১ জুলাই ভোরে এক কাজে চরভদ্রাসনের চর শালিপুরে গেলে সেখানে গ্রামের এক পরিবারের অনুরোধে তিনি সাপ ধরতে যান।
মুন্সীবাজার বেদে পল্লির সরদার জোমিরুল মণ্ডল বলেন, সাপটি দেখে ইসলাম সেটি অজগরের বাচ্চা ভেবে ভুল করেন। আসলে সেটি ছিল রাসেলস ভাইপার।
ইসলাম সাপটি ধরে একটি বস্তার মধ্যে নিয়ে মুন্সীবাজারে ফিরছিলেন। পথে এক কৌতুহলী ব্যক্তি সাপটি দেখতে চান। তখন বস্তার মুখ আলগা করা মাত্র ইসলামের ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলে কামড় দেয় সেই সাপ।ওই অবস্থায় ইসলাম মুন্সীবাজার বেদে পল্লিতে ফিরে যান।
তার ভাই মো. পলাশ চৌধুরী জানান, ওইদিন দুপুরের দিকে ইসলাম বমি করেন। বমির সঙ্গে রক্ত বের হয়। তখন তাকে দ্রুত ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে সাপটিও নেওয়া হয়। সেখানে তার অবস্থার উন্নতি না হলে চিকিৎসক তাকে ঢাকায় পাঠাতে বলেন।
ঢাকায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিলেন ইসলাম। বৃহস্পতিবার রাতে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয় বলে জানান পলাশ।
সাপে কাটা রোগীরা হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম পাচ্ছে না কেন জানতে চাইলে সিভিল সার্জন ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, “ফরিদপুরে নয়টি হাসপাতাল আছে। কোথাও অ্যান্টিভেনম নেই। তাই দুজনকে (বিশা প্রামাণিক ও ইসলাম চৌধুরী) আমরা ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। তাদের ঠিকমত ওষুধ দিতে পারলে হয়ত বাঁচানোর চেষ্টা করা যেত। সেই সুযোগ আমাদের ছিল না।”
ক্ষেতে যেতে ভয়, বন্যা নিয়ে দুঃচিন্তা
সম্প্রতি রাজবাড়ীর হাবাসপুর ও বাহাদুরপুর ইউনিয়নের পদ্মা পাড়ের কয়েকটি গ্রামের মানুষ রাসেলস ভাইপার দেখার কথা জানাচ্ছেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে। বিশেষ করে নদীর পাড়, জেলের জালে, আখ ক্ষেত, পাট ক্ষেতসহ ফসলি জমিতে প্রায়ই দেখা মিলছে রাসেলস ভাইপার, গোখরা, দাঁড়াশসহ বিভিন্ন সাপের।
গত ৩ জুলাই হাবাসপুর ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের কৃষক জাহিদ প্রামাণিককে সাপে কাটার পর ওই অঞ্চলে আতঙ্ক আরও বেড়েছে।
দুই ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন কৃষক বলেছেন, সাপের ভয়ে অনেকে ক্ষেতে কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। এখনও বর্ষার পানি বাড়িঘরে সেভাবে আসেনি। পানি বাড়লে সাপের উপদ্রব আরও বাড়বে বলে তাদের আশঙ্কা।
একই কথা বলছেন ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার বাগাট ইউনিয়নের মধুমতি চরাঞ্চলের মানুষও। সেখানে গত দুই মাসে সাপের কামড়ে দুই কৃষকের মৃত্যু হয়েছে।
বাগাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান খান বলেন, ওই দুটি ঘটনার পর সেখানকার মানুষ ক্ষেতে কাজ করতে যেতে ভয় পাচ্ছে। মধুমতির চর খালি পড়ে থাকছে।
রাজবাড়ীর হাবাসপুর ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের কৃষক আজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তো মাঝে মাঝেই সাপ দেখি, নদীতে দেহি, দোয়াড় (চাঁই) পাতলি দেখি, পাট ক্ষেতে দেখি, কুশোড় (আখ) ক্ষেতে দেখি। মাঝে মধ্যে মারেও ফেলি।
“আমরা তো জানিনে এইগুলো বিষাক্ত রাসেল সাপ। এহন আমরা তো খুব আতঙ্কের মধ্যে আছি। আর কয়দিন পর বন্যার পানি আসপিনি, তহন তো আরও বেশি দেহা যাবি।”
ওই গ্রামের আরেক কৃষক আইয়ুব আলী বলেন, তিন-চারদিন আগে আখ ক্ষেতে গিয়ে তিনি বড় আকারের একটি সাপ দেখেন। পরে ভয়ে আর তিনি মাঠেই যাননি।
কৃষক আব্দুল গফ্ফার বলেন, “আমরা ওই সাপ চিনে নে, নতুন সাপ। ওইদিন আমাদের একভাই জাহিদের সাপে কামুড় দিছে পরে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেছে। ওর নাকি রাসেল ভাইপার সাপ কামড়াইছিল।”
তিনি বলেন, নদীর পাড়ে যাদের বাড়িঘর, তারা বেশি বিপদে আছে। আর কিছুদিন পর নদীর পানি যখন বাড়বে, তখন ঘরেও সাপ উঠে থাকবে। প্রশাসন যদি পদক্ষেপ নেয়, তাহলে ভালো হয়।
স্থানীয়রা কী করছে?
রাজবাড়ীর বাহাদুরপুর ইউনিয়নের তারাপুর গ্রামের বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বৃহস্পতিবার তার বাড়ির কাছে পদ্মার চরে এক বিশাল সাপ দেখতে পায় লোকজন। পরে স্থানীয়রা মসজিদের মাইকে মাইকিং করে, সবাই যেন সতর্ক থাকে।
তিনি বলেন, “পদ্মার চরে বিভিন্ন সাপ দেখা যায়। কিছু কিছু সাপ চিনি, যেগুলো মধ্যে কিছু সাপ বিষধর, আবার কিছু সাপ বিষধর না। বছর খানেক আগে চরে কৃষকরা আখ কাটতে গিয়ে দুটি সাপ পিটিয়ে মেরে ফেলে। সাপ দুটি লম্বায় ছিলো প্রায় চার ফুট। পরে ইউটিউব ও গুগলে সার্চ দিয়ে জানতে পারি সাপ দুটি রাসেলস ভাইপার।”
রাজবাড়ীর হাবাসপুরের নদীর পাড়ের কৃষক রুস্তম আলী বলেন, “সাপের জন্নি পাট কাটপার পারি নে, সাপের জন্নি মাছ মারবার পারিনে। মাঝে-সাজেই সাপ দেহা যায়। চরের ভিতর ঢোল কলমির বাগান আছে হনে সহালে (সকালে) যেয়া দেকবেন বিশাল বিশাল সাপ টান টান হয়া শুয়ে আছে। মাঠে কাম করতে খুব ভয় লাগে আমাদের।”
হাবাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আল মামুন খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সম্প্রতি চরপাড়া গ্রামে এক কৃষককে সাপে কামড়ে ছিল। সে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে এখন সুস্থ।
“আমার এই ইউনিয়নের বড় একটা অংশ নদীর পাড়ে। বর্ষার সময় সাপের উপদ্রব বাড়ে, কারণ পানির সঙ্গে বিভিন্ন জায়গা থেকে সাপ ভেসে আসে।
“আমরা নদী পাড়ের মানুষদের বলেছি আপনারা সচেতন থাকবেন। কাউকে সাপে কামড়লে সে যেন সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেয়। আমরা খুব অল্পদিনের মধ্যে নদী পাড়ের এলাকায় উঠান বৈঠকসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম প্রচার করব।”
হাবাসপুর এবং বাহাদুরপুর এলাকায় সাপের উপদ্রব যে বেড়েছে, সে কথা জানার পর পাংশা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা একটি বৈঠক করেছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রতন কুমার ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা কৃষকদের মাঝে সচেতনতামূলক বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে আসছি। তারা যেন মাঠে কাজের সময় পাহারার ব্যবস্থা করেন।”
পাংশার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ জাফর সাদিক বলেন, চরাঞ্চলে, বিশেষ করে বর্ষায় সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়। সম্প্রতি উপজেলার হাবাসপুর ও বাহাদুরপুর ইউনিয়নে কয়েকটি ঘটনা তারা জেনেছেন। ওই এলাকায় তারা সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাবেন।
হাসপাতালে যেতে হবে যত দ্রুত সম্ভব
কুষ্টিয়া শহরতলী যুগিয়া গ্রামের বাসিন্দা সামসুল আলমের ছেলে ভাঙ্গারি (লোহা) ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম রাজা (৫৫) বুধবার রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘুমিয়েছিলেন। হঠাৎ ডান পায়ের গোড়ালির ওপর কিছু একটা কামড় দেয়। যন্ত্রণায় তার ঘুম ভেঙে যায়। উঠে দেখেন কালো আর হলুদ ডোরাকাটা সাপ। সঙ্গে সঙ্গে সাপ মেরে ব্যাগে করে হাসপাতালে উপস্থিত হন।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডে তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। বললেন, জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সাপটি দেখে রাসেলস ভাইপার বলে শনাক্ত করেছেন।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) তাপস কুমার সরকার বলেন, “আক্রান্ত রোগী সাপ নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে আসায় তার সঠিক চিকিৎসা দ্রুত সময়ের মধ্যে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। রাসেলস ভাইপার তাকে কামড়েছে। সে অনুযায়ী অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন ঝুঁকিমুক্ত।”
এই চিকিৎসক জানান, গত এক মাসে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে বিষধর সাপে কাটা পাঁচজন রোগীকে অ্যান্টিভেনম দিয়ে সুস্থ করা হয়েছে। এরমধ্যে দুইজনকে কামড়ে ছিল রাসেলস ভাইপার, বাকি তিনজনকে কামড়েছে গোখরা জাতীয় বিষধর সাপ।
কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “সম্প্রতি কুষ্টিয়া অঞ্চলে সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা বেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এরমধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে রাসেলস ভাইপারের মত বিষধর সাপের দংশনের ঘটনা।”
সাপে কাটলে কী করবেন
বেশিরভাগ সাপ বিষধর নয়, কাজেই ভয় না পেয়ে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
যেখানে সাপ কামড়াবে, সেই অংশকে বিশ্রামে রাখতে হবে। পায়ে দংশন করলে বসে পড়তে হবে, ওই সময় না হাঁটাই ভালো। হাতে দংশন করলে হাত নড়াচড়া করা যাবে না। হাড় ভাঙলে যেভাবে কাঠ ও ব্যান্ডেজ দিয়ে স্প্লিন্ট করে, সেভাবে ঝুলিয়ে দেওয়া যায়।
দংশিত স্থানে কাটবেন না, সুঁই ফোটাবেন না, কিংবা কোনো রকম প্রলেপ লাগাবেন না। কোনো ধরনের গিঁট দেওয়াও যাবে না।
ওঝা বা বৈদ্য দিয়ে চিকিৎসা করে কিংবা ঝাড়-ফুঁক করে অযথা সময় নষ্ট না করলে বিপদের ঝুঁকি কমবে।
সাপের দংশন কীভাবে এড়ানো যায়
বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে।
খাটের ওপর মশারি ব্যবহার করে ঘুমাতে হবে, মেঝেতে ঘুমাবেন না। রাতের বেলা মাচায় শোয়ার ব্যাপারেও বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
ঘাসের মধ্যে কিংবা ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর হাঁটার সময় সতর্ক থাকতে হবে। লম্বা জুতা বা বুট পড়া ভালো।
রাতে বের হলে আলো-লাঠিসহ বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
গর্তের মধ্যে হাত কিংবা পা দেবেন না। স্তূপ করে রাখা লাকড়ি অথবা খড় সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হবে।
মাছ ধরার সময় ‘চাঁই' বা জালের মধ্যে হাত দেওয়ার আগে সাপ আছে কি-না দেখে নিতে হবে।
শোয়ার ঘরের সঙ্গে ধান-চাল, হাঁস-মুরগি, কবুতর না রাখা ভালো।
চিকিৎসা সংকট ও অ্যান্টিভেনম
গত বছর মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের বৌলতলী গ্রামের বাসিন্দা ও ছাত্রলীগ নেতা মো. পারভেজ বেপারীকে সাপে কামড়ানোর পর স্বজনরা তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখান থেকে তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকায় পৌঁছানোর আগেই তিনি মারা যান।
চিকিৎসকরা স্বজনদের জানিয়েছিলেন, অ্যান্টিভেনম দিলে রোগীর অবস্থা অনেক সময় খারাপ হয়। লাইফ সাপোর্ট দিতে হয়; কিন্তু সেখানে সেই ব্যবস্থা নেই। সে কারণে অ্যান্টিভেনম থাকার পরও তারা রোগীকে না দিয়ে ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেন।
পারভেজের ছোট ভাই মো. পলাশ বেপারী আফসোস করে বলছিলেন, সেদিন যদি তার ভাইকে অ্যান্টিভেনম দেওয়া যেত, তাহলে হয়ত বাঁচানো যেত।
সম্প্রতি রাজবাড়ীর যে দুজন মারা গেছেন, তারাও অ্যান্টিভেনম পাননি। তাদেরকে ঢাকায় ও কুষ্টিয়ায় পাঠানো হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজবাড়ীর সিভিল সার্জন ইব্রাহিম টিটোন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে সরকারি হাসপাতালগুলোতে যে সাপের বিষের প্রতিষেধক ছিল, তার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। আমরা নতুন প্রতিষেধক সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি।
“এর মধ্যে যদি কেউ বিষাক্ত সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়, তাহলে আমরা ফরিদপুর অথবা কুষ্টিয়ায় পাঠিয়ে দেব। আর সাপের বিষের প্রতিষেধক চলে এলে আমরাই চিকিৎসা দিতে পারব।”
এক প্রশ্নের জবাবে ইব্রাহিম টিটোন বলেন, দেশে একটি বেসরকারি ওষুধ কোম্পানি অ্যান্টিভেনম বাজারে ছাড়ে, যা বিভিন্ন ফার্মেসিতে পাওয়া যায়। সরকারি হাসপাতালে না পেলে সেখান থেকে কেনা যায়।
তবে উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীকে অ্যান্টিভেনমের অন্তত একটি ডোজ যেন দেওয়া হয়, সে বিষয়ে চিকিৎসকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে জানান সাপ বিশেষজ্ঞ ইব্রাহিম আল হায়দার।
তিনি বলেন, “এতে রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে যখন একজন রোগীকে প্রাথমিক ডোজ দেওয়া হয়, তখন জেলা সদরে যেতে সে একটু সময় পায়। সেখানে যাওয়ার পর সে আরও ভালো চিকিৎসা পেতে পারে।”
রাসেলস ভাইপার
রাসেলস ভাইপার সাপটি বাংলাদেশে চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া নামেও পরিচিত। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) একে ‘কম বিপদগ্রস্ত’ প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
ভেনম রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ এর কো-ইনভেস্টিগেটর ও সুপার ভাইজার এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী পিলু বলেন, সাপটি আগেও ছিল। এখন এর প্রাদুর্ভাব বেড়েছে।
“আগে উত্তরবঙ্গে মঙ্গা হত। ক্ষেত ফাঁকা পড়ে থাকত। গত ১০-১২ বছরে দুই-তিনটি ফসল হচ্ছে। সেই সুযোগে ক্ষেতে ইঁদুর আসছে। তাদের খাদ্যাভাস বেড়েছে। বাসস্থান মিলছে। সবমিলিয়ে বংশবিস্তার ভালো হচ্ছে। এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ব্যাপার।”
অনেকে সাপটিকে অজগরের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন জানিয়ে অধ্যাপক ওয়াহেদ বলেন, এর কারণ হচ্ছে, দুটি সাপেরই গায়ে ডোরাকাটা দাগ আছে। অনেকে অজগর ভেবে ধরতে গিয়ে ভুল করেন। কামড় খাওয়ার কিডনি বিকল হওয়া, চোখে কম দেখাসহ নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. ফিরোজ জামান বলেন, রাসেলস ভাইপার ভালো সাঁতরাতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে ৫-৬ বছরে এ সাপের সংখ্যা বেড়েছে, কারণ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা রাসেলস ভাইপারের বংশ বৃদ্ধির অনুকূলে।
“এ সাপের মেইন ডিস্ট্রিবিউশনটা রাজশাহীর পদ্মা এলাকায়। ভারত থেকে বন্যার সময় ভেসে আসে সেখানে। প্রজননের সময় বাচ্চাগুলো ভেসে আসে। এভাবে চাঁদপুর পর্যন্ত ছড়িয়েছে।”
তিনি জানান, রাসেলস ভাইপার বংশবিস্তার করে এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মধ্যে। প্রজনন হার তুলনামূলক বেশি।
“বাচ্চাগুলো যখন একটু বড় হয় তখন বন্যা শুরু হয়ে যায়। তখন ভেসে ভেসে যারা পারে ডাঙ্গায় ওঠে, আর যারা পারে না তারা দক্ষিণ-পূর্বে চলে আসে,” বলেন অধ্যাপক ফিরোজ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক ও সাপ গবেষক ইব্রাহিম আল হায়দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০০০ সালের পর বাংলাদেশে এ সাপ অনেকটা কমে গেলেও ২০১২ সাল থেকে আবার বেড়েছে।
“পদ্মা ও যমুনা নদী এবং এর শাখা নদী দিয়ে সেগুলো আসছে। চরাঞ্চলে বেশি দেখা যাচ্ছে। বছর দুই আগে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী ব্রিজেও এ সাপ পাওয়া গেছে। পদ্মার ওপারে রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর অঞ্চল এবং এপারে ঢাকার মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জে পাওয়া যাচ্ছে। চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীতেও চিহ্নিত হয়েছে। এখন পটুয়াখালীসহ উপকূলেও দেখা মিলছে।
“মনে হচ্ছে, উজান থেকে ভেসে আসা কচুরিপানার সঙ্গে নিচু অঞ্চলে এসে এ সাপ মাটি পাচ্ছে। পানিতে শরীর বেঁকিয়ে সাপটি ভেসে থাকতে পারে। ফসলি জমিতে যেহেতু প্রচুর ইঁদুর থাকে, ফলে সেখানে এর দেখা মেলে। ইঁদুর ছাড়াও এরা ছোট পাখি ধরে খায়।”
তিনি বলেন, “রাসেলস ভাইপারের ডিম থেকে বাচ্চা রূপান্তরের কাজটি শরীরের ভেতরেই হয়। সব কিছু ঠিক থাকলে একটি রাসেলস ভাইপার ৬০টি পর্যন্ত বাচ্চা দিতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, একবার মিলনের পর এক বছর বাচ্চা দিল। সেই স্পার্ম সে শরীরে ধরে রেখে পরের বছরও আবার বাচ্চা দিতে পারে।
“আরও একটি ব্যাপার হচ্ছে, তাপমাত্রা বেড়ে গেলে সাপ যে বাচ্চা দেয়, তার মধ্যে স্ত্রী সাপের সংখ্যা বেশি থাকে। এটাও রাসেলস ভাইপার সাপের বংশ বিস্তার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে।”
সুখবরের অপেক্ষা
বাংলাদেশে যেসব অ্যান্টিভেনম পাওয়া যায়, তার সবই আমদানি করা। বেশিরভাগ অ্যান্টিভেনম দক্ষিণ ভারতে তৈরি; বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রতিবেশের সঙ্গে যার পার্থক্য রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক ও সাপ গবেষক ইব্রাহিম আল হায়দার বলেন, মাস ছয়েক হয়, তারা অ্যান্টিভেনম তৈরির একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। প্রথমেই রাসলেস ভাইপারের অ্যান্টিভেনাম তৈরির চেষ্টা করছেন। দুই বছরের এ প্রকল্পের ছয় মাস এরই মধ্যে পার হয়েছে। প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যেতে আরও সময় লাগবে।
“সারাদেশে বছরে প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়। আমাদের উদ্যোগ সফল হলে হয়ত অনেক মানুষের প্রাণ বেঁচে যাবে। আমরা আশাবাদী, দেড় বছর পর একটি সুখবর দিতে পারব।”
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন রাজবাড়ী প্রতিনিধি শামিম রেজা, ফরিদপুর প্রতিনিধি মফিজুর রহমান শিপন, কুষ্টিয়া প্রতিনিধি হাসান আলী, বিশেষ প্রতিবেদক মঈনুল হক চৌধুরী এবং জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মিন্টু চৌধুরী]