উখিয়ার ক্যাম্পে আগুনের ঘটনায় ‘আরসা’, সন্দেহ রোহিঙ্গাদের

“আগুন লাগার কিছুক্ষণ পরই অপরিচিত কয়েকজন সি-ব্লকে আগুন লাগিয়ে দিয়ে মানুষের হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে ঢুকে পালিয়ে যায়,” বলেন এক রোহিঙ্গা নারী।

শংকর বড়ুয়া রুমি, কক্সবাজার প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 March 2023, 07:23 AM
Updated : 9 March 2023, 07:23 AM

কক্সবাজারের উখিয়ায় বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি ব্লকের ঘরগুলো যখন জ্বলছিল, জীবন বাঁচাতে দিগ্বিদক ছোটাছুটির মধ্যে ‘অপরিচিত কয়েকজনকে’ সি ব্লকে আগুন দিয়ে ভিড়ের মধ্যে হাওয়া হয়ে যেতে দেখার কথা বলেছেন অগ্নিকাণ্ডে সর্বস্ব হারানো এক রোহিঙ্গা নারী।

জহুরা বেগম নামে ওই নারী দাবি করেন, “যারা আগুন লাগিয়েছে তারা ক্যাম্পের বাসিন্দা নয়, বহিরাগত।” আগুন দেওয়ার পরই তাদের ‘পালিয়ে যেতে দেখেছেন’ তিনি।

বালুখালী ১১ নম্বর আশ্রয় শিবিরে রোববার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই ওই ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত’ হিসেবে বর্ণনা করে স্থানীয় রোহিঙ্গারা দাবি করছেন, ‘আধিপত্য বিস্তার করতে’ মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসা তাদের ক্যাম্পে আগুন দিয়েছে।

তবে ঘটনা তদন্তে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনে গঠিত কমিটি বলছে, ওই অগ্নিকাণ্ড নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা, তদন্তের পরেই তা বলা যাবে।

রোববার বালুখালী ১১ নম্বর আশ্রয় শিবিরের ব্লি ব্লকে হঠাৎ আগুনের সূত্রপাত হলে লাগোয়া আরো কয়েকটি ব্লকে তা ছড়িয়ে পড়ে। তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। এ ঘটনায় দুই হাজারের বেশি ঘর পুড়ে যায়, আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে প্রায় ১২ হাজার রোহিঙ্গা।

ঘটনার পরদিন অতিরিক্ত জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু সুফিয়ানকে প্রধান করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তিন কার্য দিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাম্পগুলোর বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, তাদের সন্দেহ ‘আরসার দিকেই’। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আগুন লাগানো হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা তাদের।

বালুখালী ১১ নম্বর আশ্রয় শিবিরের সি ব্লকের ৪৮ বছর বয়সী নারী জহুরা বেগম বলেন, ঘটনার সময় তিনি তার ঘরেই ছিলেন। রোববার দুপুরে হঠাৎ করে চারদিকে আগুন আগুন বলে শোরগোল শুনতে পান। ঘর থেকে বের হয়ে তার ব্লকের পাশেই ডি-ব্লকের ঘরগুলো জ্বলতে দেখেন। জীবন বাঁচাতে সেসময় দিগ্বিদিক ছুটছিল মানুষ।

“এর কিছুক্ষণ পরই সি-ব্লকে অপরিচিত কয়েকজন লোক আগুন লাগিয়ে দিয়ে মানুষের হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে ঢুকে পালিয়ে যেতে দেখেছি।”

আগুনে নিজের ঘর হারানো এ নারী দাবি করেন, “যারা আগুন লাগিয়েছে তারা ক্যাম্পের বাসিন্দা নয়, তারা বহিরাগত দূর্বৃত্ত। সি-ব্লকের আব্দুল হামিদের ঘরে আগুন দিয়ে এসব দুর্বৃত্তরা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।”

আগুন লাগানোর ঘটনাটি ‘পরিকল্পিত’ বর্ণনা করে এর পেছনে ‘আরসার হাত রয়েছে’ বলে দাবি করেন একই ব্লকের আরেক বাসিন্দা মো. ইলিয়াছ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সি-ব্লকে আরসার সদস্য এহসানসহ ৩-৪ জন অস্ত্র দেখিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ভয় দেখায়। ঘটনার সময় কয়েকটি ফাঁকা গুলি ছুড়ে আব্দুল হামিদের ঘরে তারা আগুন লাগিয়ে দেয়।”

“যদি ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা হত, তাহলে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে একইসাথে আগুন লাগার ঘটনা ঘটত না”, বলেন তিনি।

মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগঠন 'আরসা ও আরএসও' এর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আগুন লাগানো হয়েছে বলে দাবি করেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ইলিয়াছ।

এদিকে ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ঘটনার দিনই এক রোহিঙ্গাকে আটকের কথা জানিয়েছিলেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।

তবে আটক ওই রোহিঙ্গা সম্পর্কে কোনো তথ্য না থাকার কথা জানিয়েছে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এবং উখিয়া থানা পুলিশ।

বুধবার সন্ধ্যায় ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমানের কাছে আটক রোহিঙ্গা যুবকের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি দায়িত্বরত এপিবিএন পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

এ বিষয়ে ১৪ এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফারুক আহমেদ বলেন, “ঘটনায় জড়িত সন্দেহে কোনো যুবক আটক হওয়ার ব্যাপারে এপিবিএন অবহিত নয়। কোন সংস্থার সংশ্লিষ্ট কেউ আটক কাউকে এপিবিএনের কাছে হস্তান্তর করেনি।”

উখিয়া থানা পুলিশের ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী ও একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন।

আশ্রয় শিবিরে অগ্নিকাণ্ডের পেছনে আরসার হাত রয়েছে- স্থানীয় রোহিঙ্গাদের এমন দাবির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবু সুফিয়ান বলেন, “তদন্তে সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে কাজ চলছে। ঘটনার তদন্তে সংশ্লিষ্ট যাদের সঙ্গে কথা বলা দরকার, তাদের বক্তব্য নেওয়া হচ্ছে।

“ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা– তদন্তে কোনো দিক বাদ যাচ্ছে না। তদন্তকাজ শেষ হলে আগুনের সূত্রপাতের পাশাপাশি নেপথ্যের রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে।”

তদন্ত প্রতিবেদন কমে জমা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বুধবার সরকারি ছুটি থাকায় বৃহস্পতিবারের মধ্যে তদন্তকাজ শেষ করা হবে। পরে তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত প্রতিবেদন আকারে তৈরির পর রোববারের মধ্যে জমা দেওয়া হবে।”

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে। আশ্রয় শিবিরটির সহায়তায় ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএম এর জনসংযোগ কর্মকর্তা তারেক মাহমুদ বলেন, ঘটনার পরপরই বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে আইওএম ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও তাৎক্ষণিকসহ জরুরি সহায়তা দেয়।

পরে আশ্রয় শিবির প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা মতে পুনর্বাসন কার্যক্রম চলছে। দেওয়া হয়েছে নানা সহায়তা।

তিনি বলেন, “বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের মাঝে ৮০ হাজার ৫০০ লিটার সুপেয় পানি, ২ হাজার ৫১৪ পরিবারকে ইমার্জেন্সি হাইজিন কিট, ২ হাজার ৫১৪ পরিবারকে নন-ফুড আইটেম এবং ২ হাজার ৫৬২ পরিবারকে ইমার্জেন্সি শেল্টার কিট বিতরণ করা হয়েছে।

“এছাড়া ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা দলের মাধ্যমে ৬৬০ জন রোহিঙ্গাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার হয়েছে এবং ৪৬৪টি নলকূপ মেরামত করা হয়েছে।”

পুরনো খবর:

Also Read: কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, নিয়ন্ত্রণে ৭ ইউনিট

Also Read: ৩ ঘণ্টা পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আগুন নিয়ন্ত্রণে

Also Read: রোহিঙ্গা শিবিরে আগুনের কারণ খুঁজতে তদন্ত কমিটি

Also Read: ‘আরসা-আরএসও’র সংঘাত: শূন্যরেখা থেকে পালিয়ে এসেছে ৩ হাজার রোহিঙ্গা

Also Read: উখিয়ার ক্যাম্পে আরেক রোহিঙ্গা নেতাকে গুলি করে হত্যা