রঙিন ফুলকপির পুষ্টিগুণ আর স্বাদ নিয়ে যা বলছে কৃষি বিভাগ

দাম ও লাভ ভালো হওয়ায় ‘ইউরোপে সালাদ’ হিসেবে ব্যবহৃত সবজিটি আবাদে আগ্রহী হচ্ছেন বাংলার চাষিরা।

লাভলু পাল চৌধুরীনেত্রকোণা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Feb 2023, 03:28 AM
Updated : 13 Feb 2023, 03:28 AM

যুগ যুগ ধরে বাজারে প্রচলিত সাদা ফুলকপির পাশাপাশি নতুনমাত্রা যোগ করেছে সবজিটির নানা রঙের জাত; যার পুষ্টিগুণ ও স্বাদ তুলনামূলক বেশি বলে জানাচ্ছে কৃষি বিভাগ। এ ছাড়া দাম ও লাভ ভালো হওয়ায় ‘ইউরোপে সালাদ’ হিসেবে ব্যবহৃত সবজিটি আবাদে আগ্রহী হচ্ছেন বাংলার চাষিরা। 

গত কয়েক বছর ধরেই দেশের বিভিন্ন স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে কমলা ও রক্তবর্ণের ফুলকপি চাষে কৃষকদের উৎসাহ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। চাষিরাও আবাদ করে ভালো ফলন পাচ্ছেন। আর ক্রেতারা বলছেন, এর স্বাদ প্রচলিত সাদা ফুলকপির চেয়ে একটু বেশি। 

নেত্রকোণা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাজারে নতুন আসা কমলা রংয়ের ফুলকপিতে রয়েছে বিটা কেরোটিন; যা শরীরে ভিটামিন ‘এ’-তে পরিণত হয়। আর রক্তবর্ণ ফুলকপিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্থোসাইয়ানিন; যা শরীরে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া ভিটামিন ‘সি’-এর প্রাচুর্যসহ সাধারণ ফুলকপির (সাদা ফুলকপি) সব পুষ্টিগুণ উপাদানই রয়েছে।“

সারাদেশের মতো বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির প্রকল্পের আওতায় আধুনিক জাত সম্প্রসারণ প্রদর্শনী হিসেবে প্রথমবারের মতো নেত্রকোণা জেলার আটপাড়া উপজেলায় রঙিন ফুলকপি চাষ করা হয়েছে বলে জানান ফয়জুন নাহার নিপা।

আটপাড়া উপজেলার এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, উপজেলার বানিয়াজান ইউনিয়নের কদিমপাহাড়পুর গ্রামের পলাশ চন্দ্র সরকার ১৫ শতক জমিতে এই বাহারি ফুলকপির পরীক্ষামূলক আবাদ করেছেন। তিনি সফল হয়েছেন। এলাকার অন্য কৃষকও আগামী মৌসুমে চাষ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

তিনি আরও বলেন, “সাদা ফুলকপি থেকে এই রঙিন ফুলকপির পার্থক্য হলো এর পুষ্টিগুণ বেশি। এই কপিতে বিটা কেরোটিন থাকে। চোখ এবং ত্বককে ভাল রাখে। এ ছাড়া অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে; যেটি ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। সাদা কপির মতোই আবাদের সময় একই লাগে। চাষ পদ্ধতিও একই।“

সরজমিনে পলাশ চন্দ্র সরকারের জমিতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ি-লাগোয় অনেকটা উঁচু জমিতে তিনি রঙিন কপি চাষ করা হয়। অনেকটা দূর থেকে দেখলে মনে হয়, কমলা আর বেগুনি রংয়ের ফুল ফুটে রয়েছে জমিতে। জমির একপাশে কমলা আর অপরপাশে বেগুনি রংয়ের কপি চাষ করেছেন তিনি। পাশেই অন্য এক টুকরো জমিতে আবাদ করেছেন শালগম। পাশের আরেকটি জমিতে আবাদ করেছেন টমেটো। টমেটো ক্ষেতেও থোকা থোকা টমেটো ঝুলে আছে।

জমির পাশে দাঁড়িয়ে পলাশ সরকার বলেন, ফসলের নতুন জাতের প্রতি তার ঝোঁক বেশি। আগে নতুন জাতের তরমুজ করে লাভবান হয়েছেন।

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “নতুন ফসলের প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকে বেশি। বাজারমূল্যও বেশি পাওয়া যায়।”

কৃষি অধিদপ্তরের কাছ থেকে দুই হাজার চারা ও প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ পেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “১৪ নভেম্বর জমিতে চারা রোপণ করি। দুইটি রংয়ের দুই হাজার কপি আবাদ করেছি। আমার হাত থেকে মোট ১৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে, সেচ, শ্রমিক, কীটনাশক বাবদ।

“গত কয়েকদিন ধরে কপি বিক্রি করছি। বাজারে প্রচলিত সাদা রংয়ের কপি থেকে প্রায় তিনগুণ দাম পাচ্ছি। বর্তমানে একেক পিস কপি ৭০ টাকা দরে বিক্রি করছি। জমি থেকে কপি তুলে নেত্রকোণা সদরের পাইকারি বাজারে এই কপি বিক্রি করছি। তাছাড়া অনেকেই জমি দেখতে ভিড় করছেন। তারাও কপি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। সব কপি বেচা শেষ হলে আশা করছি অন্তত ৭০ হাজার টাকা লাভ পাবো।”

একই গ্রামের কৃষক প্রজল সরকার নতুন জাতের ফুলকপি আবাদ নিয়ে বলেন, “পলাশ চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে, বাম্পার ফলন হয়েছে। দেখতেও যেমন কপি সুন্দর তেমনি স্বাদও কিন্তু বেশি, পুষ্টিগুণও বেশি। এই চাষ দেখে এলাকার অন্য চাষিরাও উৎসাহিত হয়েছেন। আগামীতে আমিও এই নতুন জাতের ফুলকপি আবাদ করব।”

আরেক চাষি বিনয় ভূষণ সরকার বলেন, “পলাশ চাষ করাতে আমরা মনে করি, এটা আসলেই একটা ভাল দিক। সেও উপকৃত হইছে। আমরা এলাকাবাসীও জানতে পারছি। আমরাও চাষ করতে পারবাম।”

কৃষক পলাশের সাফল্য দেখে অনেকেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে যোগাযোগ করছেন এবং আগামীতে ফলসটি করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন বলে জানান উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান। তিনি বলেন, আমরা নতুন ফসলের ব্যাপারে সবসময় কৃষকদের উৎসাহিত করি।

শীতের সবজি ফুলকপি খাদ্য হিসেবে অসাধারণ ও সবার প্রিয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “ফুলকপিতে যথেষ্ট পরিমাণে সালফার, পটাশিয়াম ও ফসফরাস জাতীয় খনিজ উপাদান রয়েছে। এ ছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম খাবারযোগ্য কপিতে ৯০ দশমিক ৮ গ্রাম পানি, ২ দশমিক ৬ গ্রাম আমিষ, শূন্য দশমিক ৪ গ্রাম চর্বি, শূন্য দশমিক ৪ গ্রাম শ্বেতসার, এক দশমিক ৯ গ্রাম খনিজ লবণ রয়েছে।”

নেত্রকোণা জেলা শহরের ছোট বাজারের পাইকারি সবজি বাজারসহ বিভিন্ন খুচরা বাজারে রঙিন ফুলকপি পাওয়া যাচ্ছে। ক্রেতারা প্রথমবারের মতো সবজিটি দেখে থমকে দাঁড়াচ্ছেন। এর গুণাগুণ সম্পর্কে বিক্রেতাকে নানা প্রশ্ন করছেন। দাম তুলনামূলক বেশি হলেও দেখতে সুন্দর হওয়ায় আগ্রহী হয়ে অনেকেই কিনে নিচ্ছেন।   

সাতপাই এলাকার গৃহিনী শিল্পী রাণী সরকার শহরের মাছবাজার থেকে গত ১৫ দিনে রঙিন ফুলকপি কিনেছেন তিনবার। কমলা ও বেগুনি দুই রংয়ের কপিই নিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মনে হচ্ছে, সাদা ফুলকপির চেয়ে অল্প একটু স্বাদ বেশি রঙিন ফুলকপির। তরকারি রান্না করার পর সাধারণ কপির মতো এতোটা গুড়ো হয়ে যায় না। তাছাড়া রান্নার পরও কপির রঙ অনেকাটাই অটুট থাকে। এতে তরকারিটা রান্নার পর ভাল দেখায়।“

একই বাজার থেকে দুই রংয়েরই কপি কিনে খেয়েছেন জানিয়ে শহরের নিউটাউন এলাকার বাসিন্দা আলিম উদ্দিন বলেন, “এই কপি সাধারণ কপির চেয়ে অনেকটাই ভাল লেগেছে। কপি রঙিন হওয়ায় পুষ্টিগুণ বেশি। সাদা কপির চেয়ে স্বাদ, পুষ্টিগুণ বেশি থাকায় এখন রঙিন কপিই বাজার থেকে কিনে আনছি।”  

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, রঙিন ফুলকপি চীন এবং ইউরোপে সালাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ময়মনসিংহ বিভাগের ৩০ উপজেলায় এবার পরীক্ষামূলকভাবে এই কপির আবাদ করা হয়েছে। ফুলকপির নতুন আবাদ নিয়ে জমির পাশে মাঠ দিবস পালন করেছে আটপাড়া উপজেলা কৃষি কার্যালয়। এতে অতিথি ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য অসীম কুমার উকিল ও আটপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খায়রুল ইসলাম।

Also Read: গোলাপি, হলুদ, বেগুনি ফুলকপিতে রঙিন কৃষকের আশা