ম্রোদের ভালবাসায় টিকে আছে যে বন

গ্রীষ্মকালে যেখানে তীব্র পানির সংকটে ভোগে গোটা চিম্বুক পাহাড়বাসী, সেখানে সারাবছরই পানি থাকে এই প্রাকৃতিক বনে।

উসিথোয়াই মারমাবান্দরবান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 March 2023, 07:33 PM
Updated : 20 March 2023, 07:33 PM

দিন দিন বন ধ্বংসের ফলে বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে পাহাড়। ফলে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, জলের আধার। এমন অবস্থার মধ্যে নিজেদের উদ্যোগে একটি শতবর্ষী প্রাকৃতিক বন টিকিয়ে রেখেছেন বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে ম্রো জনগোষ্ঠীর এক পাড়াবাসী।

জেলা শহরে থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে বান্দরবান-থানচি সড়কের পাশে লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লেমুপালং মৌজায় কাপ্রু ম্রো পাড়ায় রয়েছে এই প্রাকৃতিক বন। এর আয়তন প্রায় ২০০ একর।

আশপাশে এ ধরনের প্রাকৃতিক বন আর কোথাও নেই। নানা প্রজাতির গাছগাছালি ও উদ্ভিদ রয়েছে এই প্রাকৃতিক বনে। রয়েছে কয়েক প্রজাতির শতবর্ষী গাছও। গ্রীষ্মকালে যেখানে তীব্র পানির সংকটে ভোগে গোটা চিম্বুক পাহাড়বাসী, সেখানে সারাবছরই পানি থাকে একমাত্র এই প্রাকৃতিক বনের কারণে।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই হাজার ফুট উপরে পাহাড়ের এই কাপ্রু ম্রো পাড়ায় বসবাস করছে ৫২টি পরিবার। পাড়াটি ঠিক কত সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছে সঠিকভাবে বলতে পারেননি বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরাও।

তাদের ধারণা, পাড়ার বয়স দেড় থেকে দুইশ বছর হতে পারে। এই বন থেকে পাড়াবাসীর কারও গাছ কাটার নিয়ম নেই। তবে ঘর নির্মাণ ও সামাজিক কাজের প্রয়োজনে পাড়াপ্রধান অনুমতির মাধ্যমে প্রয়োজনমত বাঁশ কাটতে পারে পাড়াবাসী।

রোববার কাপ্রু ম্রো পাড়ার প্রাকৃতিক বনের ভিতরে গিয়ে দেখা যায়, শতবর্ষী বিশাল গাছগুলো নিচের দিকে শেকড় গেঁড়ে যেন একটি বিশাল বটবৃক্ষ হয়ে আছে। সব গাছের নামও জানাতে পারেননি পাড়াবাসী। শুকনো কাঠের মত ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে অনেক বড় মৃত গাছও।

পাড়াবাসী জানালেন, বেশি বয়স হওয়ায় মারা গেছে গাছগুলো। তবু কাটার নিয়ম নেই। অন্যদিকে গোটা পাহাড়টাই বড় বড় পাথরে ঢাকা। শুষ্ক মৌসুমেও পাথরে ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে পানির প্রবাহ।

পাড়ার বাসিন্দা লংঙি ম্রো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০১৬ সালে ঢাকা থেকে পরিবেশ কর্মীদের একটি দল এই প্রাকৃতিক বনে জরিপ করতে আসছিল। কয়েকদিন জরিপ শেষে তারা ৯৯টি প্রজাতির গাছ পাওয়ার কথা জানিয়েছিল।

তার মধ্যে রয়েছে- সিভিট, ছাতিম, ধারমারা, গোদা, কড়ই, গর্জন, গুটগুইট্যা, ডুমুর, বন, শিমুল, চাপালিশ, চাঁপা, চালতা, বন আতা, হরিতকি ও তুন গাছ। আর কিছু গাছের কথা বলা হয়েছে, যেসব গাছের নাম পাড়াবাসী নিজেরাও জানে না।

পাড়াবাসী জানান, বাড়িঘর নির্মাণের জন্য অন্য কোনো বন থেকে গাছ কাটা হয়। অথবা কারও ব্যক্তিগত বাগান থেকে গাছ কিনে নেওয়া হয়। তবুও এ বন থেকে কেউ গাছ কাটবে না। যেহেতু গাছ কাটা নিষেধ। শুধু গাছ নয়, এখান থেকে কোনো পাথরও তুলতে পারবে না। যে যার মত গাছ কাটতে দিলে ও পাথর তুলতে দেওয়া হলে এরকম প্রাকৃতিক বন আর পাওয়া যাবে না বলে জানান তারা।

একসময় এই বনে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী ছিল জানিয়ে লংঙি ম্রো আরও বলেন, “তিন বছর আগেও এখানে বাঘের সন্ধান মিলেছিল। বাঘটা পাড়ার একজনের ঘরে রাতে শুকরের ওপর আক্রমণ করে বসে। বাড়ির মালিকসহ কয়েকজন ব্যক্তি ওই বাঘটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। হঠাৎ করে ওই বাঘটা কোথা থেকে আসছে বুঝা যায়নি। একসময় এই প্রাকৃতিক বনে কত হরিণ ও ভালুক দেখা যেত। তবে এখন আর দেখা যায় না।”

পাড়ার ৬৯ বছর বয়সী সংলে ম্রো নামে বলেন, “৩০-৪০ বছর আগে আরও ঘন বনজঙ্গল ছিল। এমন বড় বড় গাছে ঢাকা থাকত দিনে সূর্যের আলো পর্যন্ত দেখা যেত না। বয়স হয়ে অনেক গাছ মারা গেছে। আবার কিছু গাছ তখনকার সময় না বুঝে অনেকে কেটে ফেলছে। তখন থেকে গাছ কাটা নিষেধ থাকলে এই বনটা আরও বড় থাকত। নানা রকম গাছে ভরপুর থাকত।”

এই প্রাকৃতিক বনের কথা চিন্তা করে পাড়াবাসী আশপাশে জুমচাষ করে না জানিয়ে কাপ্রু ম্রো নামে এক পাড়াবাসী জানান, জুমচাষ করতে গেলে জঙ্গল কাটার পর আগুন দিতে হয়। ‘ফায়ার রোড’ করার পরও অনেক সময় বনে এসে আগুন লাগতে পারে। বনে পশুপাখি বিরক্ত হতে পারে। এ কারণে বনের আশপাশে কাউকে জুমচাষ করতে দেওয়া হয় না। বন থেকে অনেক দূরে গিয়ে জুমচাষ করা হয়।

শুষ্ক মৌসুম এলে চিম্বুক পাহাড় এলাকার পাড়ায় পাড়ায় পানির সংকট তৈরি হয়। সব ঝিরি-ঝর্ণা ও ছড়া শুকিয়ে যায়। এক কলসির পানির জন্য এক-দেড় কিলোমিটার হেঁটে সংগ্রহ করতে হয় পাড়ার নারীদের। কিন্তু এই প্রাকৃতিক বনের কারণে পাড়াবাসীদের পানির কষ্টে এতটা ভুগতে হয় না। শুষ্ক মৌসুমেও পাথরের ফাঁকে ফাঁকে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ থাকে।

পানি সংগ্রহ করতে আসা চামরুং ম্রো নামে এক নারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চিম্বুক পাহাড়ে অনেক পাড়ায় শুষ্ক মৌসুমে তিন মাস পানির জন্য খুব কষ্ট পেতে হয়। অনেক দূরে গিয়ে পানি আনতে হয়। কিন্তু এখানে শুষ্ক মৌসুমেও পানি পাওয়া যায়।“

সংলে ম্রো নামে আরেক নারী বলেন, “পাড়া থেকে আরেকটু নীচে নেমে একটা ছোট কুয়ায় কাপড় ধোয়া যায় ও গোসল করতে পারি। কিন্তু আগের মত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বছরে বছরে একটু কমে আসে।”

কাপ্রু পাড়া কারবারী (পাড়াপ্রধান) ইংচং ম্রো বলেন, প্রাকৃতিক বনটি টিকিয়ে রাখার জন্য একটা এনজিওর উদ্যোগে কমিটি করা হয়েছিল। পাড়াপ্রধান ও ওই কমিটি সব দেখভাল করছে। শুষ্ক মৌসুমে চিম্বুক পাহাড় এলাকায় প্রত্যেক পাড়ায় ছড়া ও ঝিরি পানি শুকিয়ে যায়। পানির কষ্ট বেড়ে যায়। প্রাকৃতিক বন না থাকলে পানির উৎস শুকিয়ে যাবে। এ কারণে এই বন থেকে কাউকে গাছ কাটতে দেওয়া হয় না।

এ বিষয়ে স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন ‘হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’-এর নির্বাহী পরিচালক মংমংসি মারমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০০৯ সালের দিকে কাপ্রু পাড়া প্রাকৃতিক বন নিয়ে আরণ্যক ফাউন্ডেশনের একটা প্রকল্প ছিল। এই প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। এই প্রাকৃতিক বন রক্ষার জন্য নানাভাবে পাড়াবাসীদের বুঝানো হত। বিশেষভাবে দেখভাল করার জন্য একটা কমিটিও করে দেওয়া হয়েছিল।

“তা নাহলে এই প্রাকৃতিক বন অন্য দশটা বনের মত বৃক্ষশূন্য হয়ে যেত। এতদিনে ধ্বংস হয়ে যেত। সেখানকার একটা অসাধু চক্র এখনও আশপাশে প্রাকৃতিক বন থেকে গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে অনেক বন ধ্বংস করে ফেলেছে তারা। পাড়াবাসী কেউ যাতে এসবের লোভে না পড়ে সে ব্যাপারে সতর্ক রাখতে হবে। একমাত্র পাড়াবাসীদের সচেতনতার কারণে টিকে থাকবে শতবর্ষী প্রাকৃতিক এই বনটি।“

যোগাযোগ করা হলে লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আরিফুল হক বেলাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক মৌজায় পাড়াবাসীরা নিজেদের প্রয়োজনে পাড়াবন সৃষ্টি করেছে। পাড়াবন সৃষ্টির মাধ্যমে বাস্তুসংস্থান তৈরি হচ্ছে। পরিবেশ ভারসাম্য ফিরে আসছে।

“পাড়াবাসীদের আন্তরিক চেষ্টায় শতবর্ষী একটি প্রাকৃতিক বন টিকিয়ে রাখা খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। গাছ না কেটে ও পরিবেশ ভারসাম্য নষ্ট না করলে পাহাড়ে পানির উৎস এমনিতে ফিরে আসবে। পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থলও ফিরে আসবে।”