নির্বাহী প্রকৌশলী জামিল বলেন, “এখন প্রকল্প শেষ হওয়ার আগে সেই বাঁধ খুলে দিলে পানির স্রোতে সব ভেঙে বের হয়ে যাবে।”
Published : 25 Apr 2025, 09:29 AM
উচ্চতা নিয়ে জটিলতা দেখা দেওয়ায় গোপালগঞ্জ শহরের পাঁচুড়িয়া খালে সেতু নির্মাণকাজ দুই বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে। কিন্তু নির্মাণকাজের জন্য খালে দেওয়া অস্থায়ী বাঁধের কারণে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন খাল পাড়ের অর্ধ লাখ মানুষ।
পৌরবাসীর সুবিধার্থে আট কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৪০ মিটার প্রস্থের পাঁচুড়িয়া খালটিকে ২০২২ সালে শহর মধুমতি নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করা হলেও বাঁধের কারণে মানুষ সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বরং প্রবাহ বন্ধ হয়ে খালের পানি পচে যাওয়ায় দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন স্থানীয়রা।
গোপালগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজহারুল ইসলাম বলেন, “শহর মধুমতি নদী ও পাঁচুড়িয়া খালের সংযোগস্থলে একটি ব্রিজ নির্মাণের প্রকল্প রয়েছে। তবে বিআইডব্লিউটিএ যে ভার্টিকাল ক্লিয়ারেন্স হিসাব করে ব্রিজের ডিজাইন করেছে তাতে নির্মাণে জটিলতা দেখা দিয়েছে। তাই খাল ও নদীর মধ্যে দীর্ঘ ২ বছর ধরে পানি প্রবাহ বন্ধ রয়েছে।”
পাঁচুড়িয়া খালপাড়ের বাসিন্দা সমর বাইন বলেন, “এক সময়ের খরস্রোতা এই খালের পানি এখন পচে যাওয়ায় কোনো কাজে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। দূষণের কারণে খালের পানি এখন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। খালে মশা, মাছির জন্ম দিচ্ছে। মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছেন।”
পাঁচুড়িয়ার বাসিন্দা মোল্লা মহিউদ্দিন বলেন, “পাঁচুড়িয়া বেইলি ব্রিজটিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ভারি যানবাহন চলাচল করতে পারে না। যে কোনো সময় ব্রিজটি ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটতে পরে। তাই পাঁচুড়িয়া সেতুর কাজ দ্রুত শুরু করার দাবি জানাচ্ছি।”
পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর হাজী মো. হুমায়ুন কবির শিকদার বলেন, “আমরা পচা পানির দুর্ভোগ থেকে মুক্তি চাই। দ্রুত খালের পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করা হলে স্বচ্ছ পানি পাওয়া যাবে। দুপাড়ে বসবাস করা ১৬ হাজার পরিবার এ খালের পানি ওজু, গোসল, রান্নাসহ গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার করতে পারবে।”
পানি উন্নয়ন বোর্ডের গোপালগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম রেফাত জামিল বলেন, গোপালগঞ্জ শহরের মধ্য দিয়ে যাওয়া পাঁচুড়িয়া খালটির এক প্রান্তে বর্ণি বাওড় অপর প্রান্তে শহর মধুমতি নদী। একসময় নদী ও খালের সংযোগ স্থলে প্রচণ্ড স্রোত ছিল।
পাকিস্তান আমলে পাঁচুড়িয়া খালপাড়ে সরকার খাদ্য গুদাম নির্মাণ করে। স্রোতের কারণে খাদ্যগুদাম ভাঙনের কবলে পড়তে পারে এমন আশঙ্কা দেখা দিলে ১৯৫৯ সালে খালটির মুখে বাঁধ দেয় তৎকালীন সরকার। ফলে শহর মধুমতি নদীর সঙ্গে পাঁচুড়িয়া খালের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
পরে ওই বাঁধ ঘেঁষে মার্কেট ও সড়ক নির্মাণ করা হয়। দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে পানি প্রবাহ বন্ধ থাকায় দূষণ আর দখলে পাঁচুড়িয়া খালটি সংকীর্ণ হয়ে পড়লে স্থানীয়রা এ খালটি রক্ষার দাবি জানান।
তাদের দাবির মুখে ২০২২ সালের ২১ নভেম্বরে বিভিন্ন স্থাপনা উচ্ছেদ করে এবং গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট-ঘোনাপাড়া সড়ক কেটে পাঁচুড়িয়া খালের সঙ্গে শহর মধুমতি নদীর সংযোগ পুনঃস্থাপন করে দেওয়া হয়। এতে প্রাণ ফেরে পাঁচুড়িয়া খালে।
কিন্তু সিসি ব্লক স্থাপন, গাইড ওয়াল নির্মাণ, পাড় বাঁধানো, সেতু নির্মাণসহ অন্যান্য কাজের জন্য ২০২৩ সালের মে মাসে খাল ও নদীর সংযোগ স্থলে অস্থায়ী বাঁধ দেওয়া হয়। তারপর সিসি ব্লক দিয়ে পাড় বাঁধানোসহ সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
নির্বাহী প্রকৌশলী জামিল বলেন, “এখন প্রকল্প শেষ হওয়ার আগে সেই বাঁধ খুলে দিলে পানির স্রোতে সব ভেঙে বের হয়ে যাবে। তাই বাঁধ খুলে দেওয়া যাচ্ছে না।”
গোপালগঞ্জ সড়ক বিভাগের কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, শহর মধুমতি নদীর সঙ্গে পাঁচুড়িয়া খালের সংযোগ স্থাপন করার সময় সড়কে কেটে অস্থায়ী বেইলি ব্রিজ দেওয়া হয়। পরে গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট-ঘোনাপাড়া সড়ক প্রকল্পের আওতায় বেইলি ব্রিজের স্থানে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।
সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজহারুল ইসলাম বলেন, গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট-ঘোনাপাড়া সড়ক প্রকল্পের ৪৪ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৪৩ দশমিক ৩ কিলোমিটার সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি রয়েছে মাত্র ৭০০ মিটারের কাজ। কিন্তু প্রকল্পে শহর মধুমতি নদী ও পাঁচুড়িয়া খালের সংযোগ স্থলে একটি ব্রিজ নির্মাণের প্রকল্প রয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ এ সেতুর ডিজাইন করেছে বন্যা লেভেল থেকে ৫ মিটার ভার্টিকাল ক্লিয়ারেন্স হিসাব করে৷ এতে ব্রিজটি অস্বাভাবিক উচ্চতা সম্পন্ন হবে। এ কারণে এপ্রোচ সড়কের সামঞ্জস্যতা ঠিক রাখতে আশপাশের স্কুল, পুলিশ কর্মকর্তা মেস, জেলা পরিষদ ডাকবাংলোসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি জমি অধিগ্রহণ ও একটি আন্ডারপাস নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
এ অবস্থার প্রেক্ষিতে বিআইডব্লিউটিএকে ভার্টিকাল ক্লিয়ারেন্স ১ দশমিক ৫ মিটার প্রদান করার অনুরোধ করা হয়।
তিনি বলেন, কিন্তু বিধিমালা অনুযায়ী তারা ভার্টিকাল ক্লিয়ারেন্স ৩ দশমিক ৫ মিটার নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু এতেও ব্রিজের উচ্চতা অস্বাভাবিক রয়েছে। ফলে এ ব্রিজ বাস্তবায়নে দেখা দিয়েছে জটিলতা।
ভার্টিকাল ক্লিয়ারেন্স ১ দশমিক ৫ মিটার নির্ধারণ করা হলে স্বাভাবিক উচ্চতায় ব্রিজটি নির্মাণ করা সম্ভব হবে বলে জানান ওই প্রকৌশলী ।
বিআইডব্লিউটিএ (মেরিন) বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আব্দুর রহিম বলেন, “নদী, খাল, বিল সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। তাই পাঁচুড়িয়া খাল ও শহর মধুমতি নদী যাতে নিরাপদ থাকে, সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এখন কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে।”
দ্রুত ব্রিজ নির্মাণে এ জটিলতা অপসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা ১৭ এপ্রিল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। আমরা দ্রুত মহাপরিচালক বরাবর প্রতিবেদন জমা দেব।”
গোপালগঞ্জ পৌরসভার প্রশাসক বিশ্বজিৎ কুমার পাল বলেন, “পাঁচুড়িয়া ব্রিজ নির্মাণের জটিলতা নিরসনে বিআইডব্লিউটিএ ও জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জমানের মধ্যে ১৭ এপ্রিল ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আশা করছি দ্রুত সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে। শহরবাসীর দুর্ভোগও কেটে যাবে।”
আরও পড়ুন-
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত পাঁচুড়িয়া খালের প্রাণ ফিরল ৬৩ বছর পর