ঘূর্ণিঝড় মোখা: ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধে দক্ষিণ উপকূলে শঙ্কা

সাবেক জনপ্রতিনিধি আবদুস সালাম খান বলেন, “ঝড়ের চেয়ে আমাদের বড় ভয় বেড়িবাঁধ। অর্ধশত বছরেরও আগে নির্মিত বেড়িবাঁধ এখন আর সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা সামাল দিতে পারছে না।”

শুভ্র শচীনখুলনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 May 2023, 05:44 AM
Updated : 13 May 2023, 05:44 AM

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র গতি বাড়ছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের দিকে ধেয়ে আসা অতি প্রবল এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের উপকূলীয় এলাকাগুলো বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। 

তাই ‘মোখা’ শঙ্কিত করে তুলেছে গত কয়েক বছরের একাধিক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না পারা দেশের দক্ষিণ উপকূলের বাসিন্দাদেরও। ঝুঁকিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধগুলোর কারণে আবারও লোকালয়ে প্লাবনের শঙ্কায় রয়েছেন উপকূলবাসী। 

বিশেষ করে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এবং বাগেরহাটের শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ ও মোংলা উপজেলার অনেক বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকায় এখানকার বাসিন্দাদের শঙ্কা বেড়েছে। 

খোদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য বলছে, ওই তিন জেলার প্রায় ৬০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত বা বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাস হলে বাঁধ উপচে পানি ঢোকার আশঙ্কা করা হচ্ছে এসব জেলার উপকূলে। 

বেড়িবাঁধ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা এই বোর্ডের তথ্য বলছে, খুলনা অঞ্চলে এর আগে ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় ৬৮৩ কিলোমিটার এবং ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় ৪৭৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যার ক্ষত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলবাসী। 

খুলনার কয়রা উপজেলার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ৬ নম্বর ও ৪ নম্বর রিং বাঁধ, গাজীপাড়া, গোলখালী, হাজতখালী, জোড়শিং, মহেশপুর, ঘাটাখালী, হরিণখোলা ও মদিনাবাদ লঞ্চঘাট সংলগ্ন এলাকা এবং মঠবাড়িয়া ও হোগলা এলাকাসহ প্রায় ১২ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। 

কয়রার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, “সাকবাড়িয়া নদীর পানির চাপ বেশি হলে আমাদের বাঁধ কোনভাবেই টিকবে না। আম্পানের পর আমাদের গ্রামসহ আশপাশের এলাকার কয়েক শ’ পরিবারের সবকিছু প্রায় দুই বছর ধরে পানির নিচে ডুবে ছিল। 

“সাকবাড়িয়া এবং কপোতাক্ষ নদ যখন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে তখন এই দুর্বল বেড়িবাঁধ কোনো কাজে আসে না। যতবারই ঝড় হয়েছে বাঁধের কোনো না কোনো জায়গা ভেঙে আমাদের গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।” 

নুরুল বলেন, “আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত গাজীপাড়া ও গাতিরঘেরী এলাকায় গতবছর বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। তবে তা এখনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।” 

দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) আবদুস সালাম খান বলেন, “ঝড়ের চেয়ে আমাদের বড় ভয় বেড়িবাঁধ। উপকূল সুরক্ষায় অর্ধশত বছরেরও আগে নির্মিত বেড়িবাঁধ এখন আর সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা সামাল দিতে পারছে না। বারবার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো জিও ব্যাগের বালুর বস্তা আর রিং বাঁধ দিয়ে কোনোরকম টিকিয়ে রাখা হয়েছে।” 

সালাম বলেন, “দুর্যোগ থেকে বাঁচতে এলাকার মানুষ বারবারই কংক্রিটের নদী বাঁধের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু তা আর হয়নি।” 

মহেশ্বরীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারি বলেন, “জোয়ার বাড়লে বাঁধের ধসে যাওয়া জায়গাগুলো দিয়ে পানি ঢুকবে। তাতে গোটা ইউনিয়ন তলিয়ে যেতে পারে।” 

বেড়িবাঁধ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২। ওই কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, “আমাদের আওতাধীন ৬৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ১০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। আর অতিঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ আছে ৩ কিলোমিটার।” 

আশরাফুল আরও বলেন, “এরমধ্যে কয়রা উপজেলায় আমাদের বেশি নজর রাখতে হচ্ছে। ওই এলাকাটি সুন্দরবনসংলগ্ন ও এর ৩ দিকে কপোতাক্ষ এবং শাকবাড়িয়া নদী। বড় আকারের জলোচ্ছ্বাস হলে ভালো বাঁধও ধসে যেতে পারে। তবে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সরাঞ্জামাদি প্রস্তুত রাখা হয়েছে।”

এদিকে গত সপ্তাহে দাকোপ উপজেলার মোজামনগর, ঝালবুনিয়া, দক্ষিণ কামিনিবাসিয়া, জালিয়াখালী, মধ্যপানখালী, কালাবগী, সুতারখালী, চুনকুড়ি, ঢাংমারি, জাবেরের খেয়াঘাট, খোনা, গড়খালী, উত্তর কামিনিবাসিয়া, বটবুনিয়া, শিবসার পাড়, ভিটেভাঙ্গা, শ্রীনগর, কালীবাড়ি, গুনারী, খলিশা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব জায়গার বাঁধের বেশিরভাগ অংশই ঝুঁকিপূর্ণ।

কামারখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পঞ্চানন কুমার মণ্ডল বলেন, “কালাবগী, নলিয়ান ফরেস্ট স্টেশনের পাশের এলাকা ও গুনারীসহ বাঁধের ৬-৭টি জায়গা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। 

“বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় ২২০ কোটি টাকা ব্যয়ে এখানে যে বাঁধ নির্মিত হয়েছিল, তা এখনই ভেঙে যাচ্ছে শিবসার পানির প্রবল চাপে। আর পাউবো যে বাঁধ নির্মাণ করে, তা তো কাজ শেষ হওয়ার আগেই ভেঙে যায়।” 

ওই এলাকার বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১। এ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রহমান তাজকিয়া বলেন, “তার দায়িত্বের অধীনে ৩৭৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৩ কিলোমিটার অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং ছয় কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।” 

এদিকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, আটুলিয়া, কাশিমাড়ী এলাকার কয়েকটি বেড়িবাঁধ অতিঝূঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে বুড়িগোয়ালিনী এলাকা। 

বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ভবতোষ মণ্ডল বলেন, “বুড়িগোয়ালিনীর দুর্গাবাটি ও দাতিনাখালীর তিনটি জায়গায় বাঁধের অবস্থা ভালো না। গত আম্পানে জায়গাগুলো ভেঙে গিয়েছিল। পরে মেরামত করা হলেও তা পুরোপুরি ঠিক হয়নি।” 

গাবুরা ইউনিয়নের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য আবদুর রহিম বলেন, “হরিষখালী, পার্শেমারী টেকেরহাট, গাবুরা, চকবারা ও লেবুবুনিয়াসহ পাঁচটি জায়গায় বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ হয়ে আছে। এমনিতেই প্রতিনিয়ত সেখানে বাঁধ ভাঙছে।” 

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন বলেন, “আমাদের আওতাধীন ৩৮০ কিলোমিটার বাঁধের ২০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ ও ৩ কিলোমিটার অতিঝুঁকিপূর্ণ। অতিঝুঁকিপূর্ণ তিন কিলোমিটার বাঁধ সংস্কার করা হচ্ছে।” 

সাতক্ষীরা ডিভিশন-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহনেওয়াজ জানান, “তার আওতাধীন এলাকায় ৩০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে তিন কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এই বাঁধ দ্রুত মেরামতের জন্য চেষ্টা চলছে।” 

বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুম বিল্লাহ জানান, “জেলার ৩৩৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে শ্যামনগর ও মোড়েলগঞ্জ উপজেলায় ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অর্থ বরাদ্দ না থাকায় তা মেরামত করা সম্ভব হয়নি।” 

মাসুম বলেন, “ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ এলাকা আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি।”

নদীতে পানির উচ্চতা খুব বেশি না বাড়লে অসুবিধা হবে না বলে ধারণা এই প্রকৌশলীর। 

শনিবার প্রথম প্রহরে ঘূর্ণিঝড় মোখা বাংলাদেশের কক্সবাজার উপকূল থেকে ৭৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে এবং মিয়ানমারের সিত্তে উপকূল থেকে ৭০০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে ছিল। সেটি শক্তি আরও বাড়িয়ে ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার গতিতে বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং মিয়ানমার উপকূলের দিকে এগোচ্ছে।

এটি এরই মধ্যে চরম প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে বলে ভারতের আবহাওয়া বিভাগ শনিবার জানিয়েছে। অর্থাৎ সুপার সাইক্লোনের ঠিক আগের ধাপে পরিণত হয়েছে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়টি।

ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ঘূর্ণিঝড়টি কেন্দ্রে বাতাসের একটানা গতিবেগ এখন ঘণ্টায় ১৮০ থেকে ১৯০ কিলোমিটার, যা দমকা হাওয়ার আকারে ২১০ কিলোমিটারে উঠছে। চরম প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত হানার আগে আরও শক্তি সঞ্চয় করবে। তবে যখন উপকূল অতিক্রম করবে, তখন এর শক্তি কিছুটা কমে আসবে। 

আরও পড়ুন 

Also Read: শক্তি আরও বাড়িয়েছে মোখা, এগোচ্ছে ১০ কিলোমিটার গতিতে

Also Read: ঘূর্ণিঝড় মোখা: মহাবিপদ সংকেত, ৫ লাখ মানুষকে সরানোর প্রস্তুতি

Also Read: রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা ‘মোখা’ সামলাবেন কীভাবে?

Also Read: ঘূর্ণিঝড় মোখা: ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় যে প্রস্তুতি

Also Read: ঘূর্ণিঝড়ে কী করবেন

Also Read: মৃত্যু আর ধ্বংস নিয়ে ঘূর্ণিঝড় এসেছে বার বার