ভোর রাতে লৌহজং উপজেলার বড়নওপাড়া গ্রামে এক বাড়ি ঘিরে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
Published : 24 Jul 2023, 11:11 AM
মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে এক বাড়ি ঘিরে অভিযান চালিয়ে নতুন জঙ্গি দল জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার কথিত আমির মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদসহ তিনজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে র্যাব।
রোববার রাত ৩টা থেকে লৌহজং উপজেলার বড় নওপাড়া গ্রামে এই অভিযানে ওই বাড়ি থেকে দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, উগ্রবাদী পুস্তিকা ও নগদ টাকা জব্দ করার কথা জানিয়েছেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক আ ন ম ইমরান খান।
ওই বাড়ির মালিক আনোয়ারা বেগমের স্বামী বদিউর রহমান মারা গেছেন, ছেলেরা আলাদা থাকায় ওই বাড়ি তিনিই দেখভাল করেন।
আনোয়ারা বেগম জানান, তার একতলা ভবনের দুটি কক্ষ তিন দিন আগে ভাড়া নেন হাসান নামের একজন। এক পরিবারের সদস্য পরিচয় দিয়ে তিনজন পুরুষ বাসায় ওঠেন, পরিবারের নারী সদস্যরা পরে আসবেন বলে সে সময় তারা জানান।
“ভাড়া ঠিক হয়েছিল এক হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিলসহ মোট ৫ হাজার টাকা। নতুন ভাড়াটেরা বলেছিল, জাতীয় পরিচয়পত্র দুই দিন পরে দেবে।”
আনোয়ারা বলেন, রাত ৩টার দিকে হঠাৎ তার বাড়ি ঘেরাও করে অভিযান শুরু করে র্যাব। পরে নতুন ভাড়াটেদের তিনজনকেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।
র্যাব কর্মকর্তা ইমরান খান বলেন, “ওই বাড়িতে জঙ্গিরা অবস্থান করছে এমন খবর আমাদের কাছে ছিল। এর ভিত্তিতে সেখানে অভিযান পরিচালনা করে র্যাব।”
সোমবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন এই র্যাব কর্মকর্তা।
এর আগে ২৩ জুন রাতে ঢাকার ডেমরা থেকে এই জঙ্গি দলের নেতা শামিন মাহফুজ ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করার কথা জানায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।
পুলিশের এই বিশেষায়িত বাহিনীর ভাষ্য, শামিন মাহফুজই জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ‘প্রতিষ্ঠাতা’।
তবে র্যাবের ভাষ্য, এ সংগঠনের ‘প্রধান ব্যক্তি’ বা আমির হচ্ছেন কুমিল্লার আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ। শামিন মাহফুজ এই সংগঠনের ছয় নম্বর শুরা সদস্য।
কে এই আনিসুর?
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য বলছে, ৩২ বছর বয়সী আনিসুর রহমান মাহমুদের বাড়ি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার হরকল গ্রামে। তার বাবার নাম মোখলেছুর রহমান।
স্থানীয় একটি মাদ্রাসা থেকে হাফেজি পড়া শেষ করে সেখানেই একটি সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনে কাজ করা শুরু করেন তিনি। ২০২১ সালে পৈত্রিক কিছু সম্পদ বিক্রি করে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান।
র্যাব বলছে, আনিসুর তার বাড়ি থেকে আনা টাকা সংগঠনে দিয়েছেন।
কারা এই জামাতুল আনসার
কুমিল্লা ও ঢাকার সাত কলেজছাত্র গত ২৩ অগাস্ট বাসা থেকে বেরিয়ে আর না ফেরায় থানায় জিডি করেছিল পরিবার। পরে জানা যায়, নিরুদ্দেশ ওই তরুণদের কয়েকজনকে শেষবার দেখা গিয়েছিল চাঁদপুরে।
অক্টোবরের শুরুতে কয়েকজনকে উদ্ধার করে র্যাব জানায়, ওই তরুণরা নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ায় যুক্ত হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য ঘর ছেড়েছিলেন। আলোচনায় আসা জঙ্গি সংগঠনটি নিয়ে এরপর নানা ধরনের তথ্য দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
র্যাব বলছে, হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি এবং আনসার আল ইসলামের বেশ কিছু সদস্য ২০১৭ সালে নতুন এই উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। পরে ২০১৯ সালে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে।
এদিকে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ নামে পাহাড়ের একটি সশস্ত্র দলের তৎপরতার খবর বেশ কয়েক মাস ধরেই আলোচনায় আসছিল। পাহাড়িরা কেএনএফ সংগঠনটিকে ‘বম পার্টি’ নামে চেনে। নিজেদের তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক অঞ্চলের অনগ্রসর জনজাতিগুলোর ‘প্রতিনিধিত্বকারী’ হিসেবে তুলে ধরে।
এ সংগঠন ‘কুকি-চিন রাজ্যে’ নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল চায়; যেখানে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা থাকবে না; থাকবে বম, খিয়াং, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি ও ম্রোরা।
দুই দফায় জামাতুল আনসারের ১২ জনকে গ্রেপ্তারের পর র্যাবের তরফ থেকে বলা হয়, নতুন এ জঙ্গি সংগঠনকে পাহাড়ের দল বম পার্টি পৃষ্ঠপোষকতা করছে। পাহাড়ে তাদের প্রশিক্ষণও চলছে।
নতুন জঙ্গি দলের ‘পাহাড়ি যোগের’ তথ্য সামনে আসার পর অক্টোবরে পার্বত্য চট্টগ্রামে সমন্বিত অভিযান শুরু করার কথা জানায় র্যাব; যার অংশ হিসেবে দুর্গম এলাকায় প্রচারপত্র বিলি, মাইকিংও শুরু হয়।
জঙ্গিদের অবস্থানের তথ্য প্রদানকারীকে এক লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয় ওই লিফলেট। পাশাপাশি জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয় সেখানে।
এর মধ্যে বান্দরবান ও রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে গ্রেপ্তারের পর ২১ অক্টোবর র্যাবের এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কেএনএফ এর প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের সাথে ২০২১ সালে জামাতুল আনসারের আমিরের সমঝোতা হয়। পার্বত্য অঞ্চলে কেএনএফ’র ছত্রছায়ায় জামাতুল আনসার সদস্যদের ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তাদের মধ্যে চুক্তিও হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা দেওয়ার পাশাপাশি কেএনএফ সদস্যদের খাবার খরচ বহন করে জামাতুল আনসার।
আর ২৭ অক্টোবর সিটিটিসির তরফ থেকে বলা হয়, জামাতুল আনসারের মূল ব্যক্তি শামিন মাহফুজ, যিনি রংপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে বহিষ্কৃত একজন সাবেক শিবির কর্মী।
সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান সেদিন বলেন, কেএনএফ বা বমপার্টির প্রধান নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। অন্যদিকে জামাতুল আনসারের বর্তমান আমীর শামিন মাহফুজ ছিলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তারা খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
“জামাতুল আনসারের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে যখন দুর্গম জায়গা খোঁজা হচ্ছিল তখন শামিন মাহফুজ জানতে পারে তার বন্ধুই বমপার্টির প্রধান। এরপরে তারা যোগাযোগ শুরু করে এবং কক্সবাজারের একটি হোটেলে বসে টাকার বিনিময়ে প্রশিক্ষণের বিষয়ে চুক্তি হয়।”
এ বছর জুনে শামিন মাহফুজকে গ্রেপ্তারের ওপর সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানান, ২০১৪ সালে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর বন্দি থাকা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, হুজি, আনসার আল ইসলামের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে শামিনের সখ্য গড়ে ওঠে। ২০১৮ সালে জামিনে মুক্তি পেয়েই শামিন নতুন সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করেন। ২০২২ সালের শুরুতে পাহাড়ের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে বসে তিনি সংগঠনের নাম দেন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া'।
সিটিটিসি যে শামিন মাহফুজকে সংগঠনের প্রধান হিসেবে বর্ণনা করেছে, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন গত ২ মার্চ বলেছিলেন, “আপনারা হয়ত ভুল শুনেছেন। সিটিটিসি কখনও বলে নাই যে শামিন মাহফুজ এই সংগঠনের আমির। উনি (শামিন) পাহাড়ে প্রশিক্ষণের বিষয়ে প্রধান সমন্বয়কারী।
“আনিছুর রহমান মাহমুদই এই সংগঠনের প্রধান। এর আগে মাইনুল ইসলাম রক্সি যখন সংগঠনটির প্রধান ছিলেন, তখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংগঠনটির বিষয়ে জানত না। রক্সি গ্রেপ্তার হওয়ার পর ২০২২ সালে সংগঠনটির নিয়ম অনুযায়ী আনিছুর রহমান মাহমুদকে আমির নির্বাচিত করা হয়।”