পূণ্যস্নানের মেলা শেষে বিকালেই ব্যবসায়ীরা পসরা গুটিয়ে শাহ আরেফিনের আস্তানা লাউড়ের গড় চলে আসেন।
Published : 06 Apr 2024, 11:52 PM
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার সীমান্ত নদী যাদুকাটার দুই পাড়ে জড়ো হয়েছেন হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মের মানুষ। দুই ধর্মের দুই উৎসবকে কেন্দ্র করে সেখানে জমে উঠেছে মেলা। এসেছেন দেশ-বিদেশের পূর্ণার্থীরা।
নদীর পূর্বপাড়ে লাউড়ের গড় গ্রামে শনিবার সন্ধ্যায় শুরু হয়েছে মুসলমানদের কাছে ‘জিন্দাপির খ্যাত লোকসাধক’ হযরত শাহ আরেফিনের মাঝারের ওরস মোবারক। আর পশ্চিমপাড়ের রাজারগাঁওয়ে শ্রীশ্রী অদ্বৈত আচার্যের মন্দির ঘিরে দিনভর পূণ্যস্নান করেছেন হিন্দু ধর্মের লাখো মানুষ।
পূণ্যস্নান উপলক্ষে যাদুকাটা নদী তীরের প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মেলা বসে। এই মেলায় নানা ধরনের পণ্য নিয়ে হাজির হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। স্নান শেষে বিকালেই এই ব্যবসায়ীরা পসরা গুটিয়ে শাহ আরেফিনের আস্তানা লাউড়ের গড় চলে আসেন। সেখানেও কয়েক হাজার দোকান বসেছে। ওরস মূলত একদিনের হলেও মেলার আমেজ চলে তিনদিন ধরে।
যাদুকাটা নদীর দুই তীরের প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকার গ্রামগুলো এখন লোকে-লোকারণ্য। সেখানে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। এ দুই মন্দিরে আচারাদি পালন করছেন তারা। শনিবার মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে সেখানে পূণ্যস্নান করেছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ। ভারতের গয়া, কাশি, বৃন্দাবন, মথুরাসহ বিভিন্ন স্থান থেকেও অদ্বৈত ভক্তরা এখানে এসেছেন।
বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রীশ্রী চৈতন্যের প্রধান সহকারী সাধকপুরুষ শ্রীশ্রী অদ্বৈত আচার্যের নবগ্রামে এই মন্দিরটি ছিল। নদীতে তা বিলীন হয়ে যায়। পরে রাজারগাঁওয়ে নতুন মন্দির তৈরি করা হয়।
মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সকাল ৭টা ৫২ মিনিট ১৬ সেকেন্ড থেকে শুরু হয়ে দুপুর ১টা ৪৯ মিনিট ২৪ সেকেন্ডের মধ্যে স্নান করেন পূর্ণার্থীরা।
মায়ের মনোবাসনা পূরণের জন্য যোগসাধনা বলে ‘পণ’ করে ‘তীর্থ’ এনেছিলেন শ্রীশ্রী অদ্বৈত আচার্য; তাই এটাকে ‘পণতীর্থ’ বলা হয়।
শ্রীশ্রী অদ্বৈত মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, “শুক্রবার সকাল থেকেই দেশ-বিদেশের পূণ্যার্থীরা এসে পৌঁছেছেন। তারা নদী তীরের গ্রামগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে অদ্বৈত মন্দির ও ইসকন মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছেন।”
সারারাত দুটি মন্দিরে লীলা সংকীর্তন হয়েছে। ধর্মগুরুরা ধর্মীয় বাণী প্রচার করেন। সাধক অদ্বৈতের জীবন ও সাধনার কথা প্রচার করেন। মঙ্গল আরতি, ভজন লীলা, কীর্তন, গঙ্গাপূজাসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়েছে।
ওইদিন সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় হযরত শাহ আরেফিনের ওরস। রাতভর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ভক্তরা বাউল গান পরিবেশন করবেন। মানবধর্ম নিয়ে আলোচনা করবেন তারা। গানে গানে প্রভুকে ডাকবেন।
তবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ অন্যান্য ধর্মের লোকজনও শাহ আরেফিনের মাজারে এসে প্রার্থনা করেন। মনোবাসনা পূরণের জন্য মানতের বস্তু দান করেন।
হযরত শাহ আরেফিনের মাজার ও ওরস উদযাপন কমিটির সদস্যসচিব আল সাব্বির বলেন, “ওরসে প্রায় লক্ষাধিক ভক্ত আসেন। তারা আসতে শুরু করেছেন। তারা মাজারের আশপাশে গানে মশগুল হয়েছেন। মানত পূরণে দান-দক্ষিণা করছেন।
“এ ছাড়া সাধক অদ্বৈত ভক্তরাও এসে শাহ আরেফিনের মাজারে দর্শন দিয়ে যাচ্ছেন। দুই ধর্মের দুই সাধকের অনুষ্ঠান উপলক্ষে মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে পুরো এলাকা। মানুষের এই সম্মিলনের ঐতিহ্য আমরা ধরে রাখতে চাই।”
শ্রীমঙ্গল থেকে মা-বাবার অস্থি বিসর্জন দিতে ‘পণতীর্থে’ সপরিবারে এসেছেন চম্পাকলি পাল। তিনি বলছিলেন, “অনেক কষ্ট করে বোন ও ভাইকে নিয়ে এসে স্নান করেছি। অস্থি বিসর্জন করে বাবা-মায়ের আত্মার শান্তি কামনা করেছি। মনোবাসনা পূরণের জন্য মানত দিয়েছি।”
তবে ‘পণতীর্থে’ যাওয়ার রাস্তাটি বড় করলে ভক্তদের কষ্ট লাগব হত বলে জানান চম্পাকলি পাল।
জগন্নাথপুরের বেতাউকা গ্রামের আব্দুল মজিদ বলেন, “আমার হিন্দু বন্ধুরা এসেছেন পূণ্যস্নানে। আমি তাদের সঙ্গে এসে দেখেছি লাখো মানুষ পূণ্যস্নান করছে। পরে তারা আমার সঙ্গে সাধক শাহ আরেফিনের মাজারে এসে দর্শন দিয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক মিলনমেলায় মেতেছে এই সীমান্ত এলাকা।”
সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাজন কুমার দাস বলেন, “পুলিশ, আনসার ও বিজিবির নেতৃত্বে চারটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছে। দুজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত রয়েছে। পথে পথে রয়েছে সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
“আব্দুজ জহুর সেতু থেকে বারুণী স্থল পর্যন্ত তিন স্তরের নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে। যাতে পূণ্যার্থীরা নির্বিঘ্নে আচারাদি পালন করতে পারেন। অন্যদিকে শাহ আরেফিনের ওরসও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে প্রশাসনের নজরদারি রয়েছে”, বলেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।