বরিশাল মহনগরীর রাজনীতিতে সাদিক আব্দুল্লাহ ও জাহিদ ফারুক শামীমের পরষ্পরবিরোধী অবস্থান দীর্ঘদিন ধরেই ক্রিয়াশীল।
Published : 02 Dec 2023, 05:28 PM
নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে ‘আপত্তিকর বক্তব্য’ দেওয়ায় বরিশাল জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম জাহাঙ্গীরের অপসারণ দাবিতে বিক্ষোভ করেছে দলের নেতাকর্মীদের একাংশ।
বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগি সংগঠনের ব্যানারে নগরীর সদর রোড কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে শনিবার এ বিক্ষোভ সমাবেশ হয়।
জাহাঙ্গীর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। সেই কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিটি করপোরেশনের সদ্য বিদায়ী মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাদিক আব্দুল্লাহ নৌকা মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু সেখানে দলের মনোনয়ন নিয়ে মেয়র হয়েছেন সাদিকের আপন চাচা আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত।
পরে সাদিক দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনেও বরিশাল-৫ সদর আসনে নৌকার মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন। দল সেখানে আস্থা রেখেছে বর্তমান সংসদ সদস্য ও পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমের ওপর। যদিও বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর বড় ছেলে সাদিক আব্দুল্লাহ সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
বরিশাল মহনগরীর রাজনীতিতে সাদিক আব্দুল্লাহ ও জাহিদ ফারুক শামীমের পরষ্পরবিরোধী অবস্থান দীর্ঘদিন ধরেই ক্রিয়াশীল। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর রাজনীতিতে সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারী হিসেবেই পরিচিত। আবার জাহিদ ফারুক শামীম ও মেয়র খোকন সেরনিয়াবাত বিভিন্ন কর্মসূচিতে একসঙ্গে অংশ নিচ্ছেন।
এই অবস্থার মধ্যেই ২৮ নভেম্বর অশ্বিনী কুমার হলের সামনে এক শান্তি সমাবেশে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উদ্দেশে বলেন, “আমরা ফসল উৎপাদন করব, আর সেই ফসল রাতের আঁধারে কেটে নিয়ে যাবে, ঘরে তুলবে, জনগণকে বঞ্চিত করবে, আমরা সেটা চাই না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনকে উৎসবমুখর করতে, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হতে হবে। আমরা মনে করি, খালি মাঠে আর গোল দিতে দেওয়া হবে না। জনগণ ভোটকেন্দ্রে যাবেন, উৎসবমুখর পরিবেশে আপনার ভোট আপনি দেবেন।
“কোনো জালিয়াতির সুযোগ নাই। কোনো প্রশাসন ব্যবহার করে আপনারা বাক্স ভরবেন সেই সুযোগটি নেই। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমাদের অত্যাচার-নির্যাতন করেছেন, সেই সুযোগ এবার কিন্তু নেই। এবার ভোট হবে স্বচ্ছ, ভালভাবে, পরিচ্ছন্ন। পরিচ্ছন্ন ভোটের মধ্য দিয়ে আমরাই থাকব।”
সাদিক আব্দুল্লাহকে পাশে নিয়ে সেই সভায় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আরও বলেছিলেন, “আমরা সবসময় বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করতে কাজ করেছি। মহানগর আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে কাজ করেছেন সাদিক আব্দুল্লাহ। বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়ে ৫ বছরে বরিশালকে সমৃদ্ধ করেছেন সাদিক আব্দুল্লাহ, চাঁদাবাজমুক্ত করেছে। এবারে আমরা স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে প্রস্তুত।
তিনি আরও বলেন, “যাকে নৌকার মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তাকে আমরা কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে পাইনি। আমরা চাই যে জনগণের সঙ্গে থাকে তাকে। সাদিক আব্দুল্লাহ নির্বাচনে অংশ নিতে চাননি। তবে সেরনিয়াবাত ভবনে কান্নার রোল পড়েছিল। আমরা তাকে চেপে ধরেছি নির্বাচন করার জন্য।”
জাহাঙ্গীরের এ বক্তব্য নিয়ে বরিশালে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। আওয়ামী লীগের প্রার্থী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম অনুসারী নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়। যার জেরে শনিবার বেলা ১১টায় নগরীর সদর রোড কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন তারা।
এতে সভাপতিত্ব করেন মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম। সমাবেশে বক্তব্য দেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক অ্যাডভোকেট লস্কর নুরুল হক, বরিশাল মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক নিজামুল ইসলাম নিজাম, যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদুল হক খান মামুন, বরিশাল জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি শাহজাহান হাওলাদার, কাউন্সিলর সাহিন সিকদার, জিয়াউর রহমান বিপ্লব, এনামুল হক বাহার, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জসীমউদ্দীন ও সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ান।
বক্তারা অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীরের বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে তার অপসারণসহ মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি ভেঙে দেওয়ার দাবি করেছেন।
আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে এ কমিটি ভেঙে দেওয়া না হলে বরিশাল সদর আসনে নৌকার প্রার্থীর নির্বাচনে এর প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করেন বক্তারা।
শেষে জাহাঙ্গীরের অপসারণ দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এসে মিছিল শেষ হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট লস্কর নুরুল হক বলেন, “জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের একটি দায়িত্বশীল পদে রয়েছেন। এ ছাড়া তিনি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তার মত একজনের এ ধরনের বক্তব্যে দেওয়া ঠিক হয়নি।
“দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে এ ধরনের বক্তব্য দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের সামিল। আমরা কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আছি। তারা কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।”
তবে শনিবার বিকালে বিরোধীদের অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর বলেন, তিনি শান্তি সমাবেশে যা বলেছেন সঠিক বলেছেন। তার বক্তব্য শুনলেই বোঝা যাবে, তিনি কী বলতে চেয়েছেন। এ নিয়ে যারা তাকে হেয়-প্রতিপন্ন করতে চান তারা কারা এই প্রশ্ন তোলেন জাহাঙ্গীর।
তিনি বলেন, “সারাজীবন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে আসছি, দলের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো কথা আমি কী করে বলতে পারি? আমি যা বোঝাতে চেয়েছি, তা তারা ঠিকই বুঝেছেন এবং আমার বক্তব্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।”
মহানগর কমিটি ভেঙে দেওয়া নিয়ে বিরোধীদের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বর্তমান কমিটি মোটেও মেয়াদোত্তীর্ণ নয়। ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর মহানগরের সম্মেলন হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন হয়েছে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি।”