একই নামে অভিহিত না হলেও এইদিন প্রায় সকল পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীই পানিতে ফুল ভাসানোর আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন।
Published : 12 Apr 2023, 12:06 PM
পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’ শুরু হয়েছে জলে ফুল ভাসিয়ে।
বুধবার ভোরে পাহাড় জুড়ে এই ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে বর্ষবরণের গত কয়েকদিনের আনুষ্ঠানিকতাগুলো পূর্ণতা পেয়ে প্রবেশ করলো তিনদিনের ‘বৈসাবি’ উৎসবের আঙিনায়।
এই উৎসবের প্রথম দিনে চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমারা বন থেকে ফুল আর নিমপাতা সংগ্রহ করে এবং কলাপাতা করে পবিত্র এই ফুল ভাসিয়ে দেয় পানিতে, তাই একে বলা হয় ‘ফুল বিজু’।
ঠিক ‘ফুলবিজু’ নামে অভিহিত না হলেও এইদিন প্রায় সকল পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীই পানিতে ফুল ভাসানোর আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন প্রায় একই নিয়মে।
এদিন চাকমা জনগোষ্ঠীর ‘ফুল বিজু’, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ‘হাঁড়িবৈসু’ আর মারমা সম্প্রদায়ের ‘সূচিকাজ’। পাশাপাশি ত্রিপুরারা এদিন বয়স্কদের স্নান করান, সংবর্ধিত করেন এবং নতুন কাপড় উপহার দেন।
বুধবার রাঙামাটিতেও মহাসমারোহে কাপ্তাই হ্রদের নানান প্রান্তে নানা এলাকার মানুষ জলে ফুল ভাসানোর মধ্যদিয়ে নতুন বছরের জন্য শুভকামনা জানিয়ে গঙ্গা দেবীর নিকট প্রার্থনা করেন।
ভোরে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে রাঙামাটি শহরের রাজবনবিহার ঘাট, পলওয়েল পার্ক, কেরানী পাহাড়সহ বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইন্সস্টিটিউট, বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, সাংক্রান, বিহু-২০২৩ উদযাপন কমিটি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে পানিতে ফুল ভাসানো হয়।
পানিতে ফুল ভাসিয়ে নিজ পরিবার এবং দেশ তথা সমগ্র জীবের মুক্তির জন্য গঙ্গা দেবীর নিকট প্রার্থনা করেন পাহাড়ের বাসিন্দারা। ফুলের সঙ্গে পুরনো বছরের দুঃখ বেদনাই যেনো ভাসিয়ে দিয়ে নতুন দিনের সম্ভাবনার আলো জ্বালান তারা।
রাঙামাটির রাজ বনবিহার ঘাটে হ্রদের পানিতে ফুল ভাসিয়ে চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশিষ রায় বলেন, “ফুল বিজু হলো আমাদের বিজু উৎসবের সূচনার দিন। এই দিন আমরা গঙ্গা দেবীকে ফুল নিবেদন করি। যাতে করে আমাদের সমগ্র দুঃখ-কষ্ট মুছে যায় এবং নতুন বছরকে যাতে আমরা আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারি।”
পুরনো দিনের বেদনা ভুলে নতুন দিনের প্রত্যয়ের কথা জানান ফুল ভাসাতে আসা পাহাড়ি তরুণ-তরুণীরাও।
ফুল ভাসিয়ে আনন্দ চাকমা নামের এক তরুণ বলেন, “আমরা এই দিনে পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত হই। পাশাপাশি পানি যেহেতু আমাদের মানব জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই জলের দেবীকে গঙ্গার উদ্দেশ্যে আমরা ফুল নিবেদন করি।
এন্টি চাকমা নামের এক তরুণী বলেন, “এটা আমাদের একটি চাকমা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। মূলত আমরা ফুলটা গঙ্গা দেবীকে দান করি সকল জীবের মঙ্গল কামনায়। অনেকে বিহারে ফুল দান করলেও সবাই একসাথে ফুল ভাসানোটাই এখন মূল আনন্দে রূপ নিয়েছে।”
শহরের কেরানী পাহাড় এলাকায় রাঙামাটি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সাংষ্কৃতিক ইন্সস্টিটিউট কতৃক আয়োজিত ফুল ভাসানো অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
তিনি নিজের আনন্দের কথা জানিয়ে বলেন, “চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ পাহাড়ের বসবাসরত সমগ্র ক্ষু-নৃগোষ্ঠীকে আমি আমার রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বৈসাবির শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।
“আমি আশা করি এই উৎসব আমাদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনকে আরও দৃঢ় করবে।”
বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, সাংক্রান, বিহু-২০২৩ উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ইন্টু মনি তালুকদার বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সবচে বড় এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমরা কিছুদিন আগ থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছি।
“আজ (বুধবার) ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে তিন দিনের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। সবাই যাতে নতুন বছর ভালোভাবে কাটাতে পারে সেই কামনা করি।”
পার্বত্য চট্টগ্রামের ১২টি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলা বর্ষকে বিদায় জানানোর এ অনুষ্ঠান তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব হিসেবে বিবেচিত।
এই উৎসব চাকমা জনগোষ্ঠী বিজু নামে, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী মানুষ সাংগ্রাই, মারমা জনগোষ্ঠী মানুষ বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী বিষু, কোনো কোনো জনগোষ্ঠী বিহু নামে পালন করে থাকে। বৈসুকের ‘বৈ’, সাংগ্রাইয়ের ‘সা’ ও বিজু, বিষু ও বিহুর ‘বি’ নিয়ে উৎসবটিকে সংক্ষেপে ‘বৈসাবি’ নামে পালন করা হয়।
পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদনের আগে থেকেই পাহাড়ের সকল জনগোষ্ঠীকে সম্মিলিতভাবে উৎসবে একীভূত করার জন্য এই সংক্ষিপ্ত নামটি প্রচলিত হলেও নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর কাছে নিজেদের নামেই আয়োজিত হয় নিজস্ব এই উৎসবের।