ঝালকাঠিতে আগে বিস্ফোরণের শিকার সাগর নন্দিনী-২ ট্যাংকার থেকে তেল স্থানান্তরের সময় আবার ঘটল বিস্ফোরণ, তাতে আহত হলেন ১৪ জন।
Published : 04 Jul 2023, 12:19 AM
ঝালকাঠিতে সাগর নন্দিনী-২ ট্যাংকারে দ্বিতীয়বারের মত বিস্ফোরণের সময় সেখান থেকে জ্বালানি তেল অন্য একটি জাহাজে স্থানান্তর করা হচ্ছিল। বিস্ফোরণে আহত একজন দাবি করেছেন, তেল সরবরাহের সাবমারসিবল গরম হয়ে এই বিস্ফোরণ ঘটে।
সুগন্ধা নদীর দক্ষিণ পাড়ে রাজাপুর গ্রামের কাছে থাকা জাহাজটিতে সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ভাড়া করা নৌযান সাগর নন্দিনী-২ থেকে জ্বালানি তেল তখন সাগর নন্দিনী-৪ ট্যাংকারে স্থানান্তর করা হচ্ছিল।
বিস্ফোরণের পর সাগর নন্দিনী-৪ জাহাজেও আগুন ধরে যায়। এতে ১০ পুলিশ সদস্যসহ মোট ১৪ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে অন্তত ছয়জন দগ্ধ হয়েছেন।
গুরুতর আহত তিনজনকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে তার মধ্যে দুজনকে রাতে ঢাকায় পাঠানো হয় বলে জানিয়েছেন ঝালকাঠির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহিতুল ইসলাম। বাকি ১১ জনকে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
বিস্ফোরণের পর পরই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বরিশাল, ঝালকাঠি, কাউখালী ও নলছিটির চারটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করে। রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত জাহাজটিতে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে।
সাগর নন্দিনী-৪ জাহাজের বাবুচি মোহাম্মদ কাইয়ুম আহত অবস্থায় ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, চট্টগ্রাম থেকে খালি জাহাজ নিয়ে তারা ঝালকাঠি আসেন তেল স্থানান্তরের জন্য। জাহাজে তারা মোট ১২ জন কর্মচারী ছিলেন। তবে জাহাজে যখন তেল স্থানান্তর হচ্ছিল, তখন অবশ্য সবাই সেখানে ছিলেন না।
বাবুচি কাইয়ুম বলেন, “রোববার থেকে সাব-মারসিবল দিয়ে পেট্রোল নেওয়া শুরু করে। তারপর আজ সকাল থেকে ডিজেল নিছে। সাবমারসিবলের নিয়ম হচ্ছে তিন-চার ঘণ্টা নেওয়ার পর ঠাণ্ডা করতে হয়। কিন্তু এই সাবমারসিবল টানা ছয়-সাত ঘণ্টা ধরে চলছে।”
তিনি বলেন, “তেল তোলার সময় সাবমারসিবল আর্থিং করা লাগে। যেহেতু পাশে পেট্রোল আছে। কিন্তু এটা করে নাই। পজিটিভ-নেগেটিভ এক হইয়া এটা ব্লাস্ট হইছে।
“দ্রিম দ্রিম কইরা বিকট শব্দ হইছে। আমি তখন পেছনে ছিলাম। উঠে দেখি সামনে খালি আগুন আর আগুন। জাহাজে আগুন লাগছে দেইখা উপায় না দেইখা নদী ঝাঁপ দিলাম। পরে নৌক আইসা আমরারে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে।”
কাইয়ুম জানান, তখন জাহাজে মাস্টার-২ বুলবুল, গ্রিজারম্যান শওকত, সুকানি মিজানসহ কয়েকজন ছিলেন। তবে তাদের খবর জানেন না বলে জানান তিনি।
হাসপাতালে মোহাম্মদ কাইয়ুমের পাশে চিকিৎসা নিচ্ছেন নৌ-পুলিশের নায়েক সিদ্দিকুর রহমান। তিনি তখন ঘটনাস্থলে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাদের নৌকাটি সাগর নন্দিনী-৪ এর সঙ্গে বাঁধা ছিল।
নায়েক সিদ্দিকুর বলেন, “সন্ধ্যার দিকে বিকট শব্দে সাগর নন্দিনী-২ জাহাজে বিস্ফোরণ ঘটে। তারপরে আরেকটা জাহাজে আগুন লাগে। যখন আগুন লাগছে দেখে আমি নদীতে ঝাঁপ দিই। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিলেন। তীরের দিকে সাঁতরাতে থাকি। তখন অন্য একটা নৌকা এসে আমাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে।”
আহত সবাইকে আলাদা একটি ওয়ার্ডে রেখে বিশেষভাবে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান ঝালকাঠির সিভিল সার্জন এইচ এম জহিরুল ইসলাম।
বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এসআই রনু সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জাহাজে বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত তিনজনকে দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এদের মধ্যে দুজন পুলিশ সদস্য এবং একজন জাহাজের কর্মচারী।
তারা হলেন- ঝালকাঠি পুলিশ লাইনসের কনস্টেবল মো. শওকত জামিল, কনস্টেবল দ্বীপ এবং জাহাজের কেরানি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের বাসিন্দা মো. শরিফ আহমেদ (৩৫)।
চিকিৎসকদের বরাতে এসআই আরও বলেন, তাদের শরীরের ৫ থেকে ১০ শতাংশ পুড়ে গেছে।
এর মধ্যে কনস্টেবল দ্বীপ ও শওকতকে রাতে ঢাকায় পাঠানো হয়।তাদের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনিস্টিউটে ভর্তি করা হয়েছে। ইনস্টিউটের আবাসিক সার্জন ডা. তরিকুল ইসলাম বলেন, শওকতের শরীরের ৬ শতাংশ দগ্ধ, সাথে ইনহেলেশন বার্ন রয়েছে, দ্বীপের ৭ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।
দুর্ঘটনার পর ঝালকাঠি শহর ও নদীপাড়ের মানুষদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে তার পাশেই আরেকটি জাহাজ এবং কিছুটা দূরে বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজ ’নির্ভিক’কে দেখা গেছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহিতুল বলেছেন, কীভাবে আবার বিস্ফোরণ ঘটল, তা তদন্ত করা হবে।
ঝালকাঠির পদ্মা ডিপোর জন্য তেল নিয়ে আসা জাহাজটিতে শনিবার দুপুরে প্রথম বিস্ফোরণের পর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তাতে দগ্ধ পাঁচজন এখনও বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন।
এছাড়া বিস্ফোরণের পর নদীতে ভেঙে পড়া জাহাজের পেছনের অংশ থেকে সোমবার তিনজনের এবং আগের দিন রোববার ইঞ্জিন রুম থেকে আরও একজনের লাশ উদ্ধার করে কোস্ট গার্ডের ডুবুরি দল।
যাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে- তারা হলেন জাহাজের গ্রিজারম্যান আব্দুস সালাম হৃদয়, মাস্টার ইনচার্জ রুহুল আমীন খান, সুপারভাইজার মাসুদুর রহমান বেলাল এবং ড্রাইভার সারোয়ার হোসেন।
বিকালে জাহাজটির উদ্ধার অভিযান শেষ করা হয়েছিল। কিন্তু জাহাজের তেল খালাসের কাজ চলছিল। এর মধ্যেই সন্ধ্যায় আবার একই জাহাজে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল।
প্রায় নয় লাখ লিটার জ্বালানি তেলবাহী এ জাহাজটিতে বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে ব্যবস্থাপককে (অপারেশন) প্রধান করে চার সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করেছে পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড।
শনিবার দুর্ঘটনার পর থেকেই কমিটির সদস্যরা কাজ শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন পদ্মা অয়েলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাসুদুর রহমান।
সাগর নন্দিনী-২ নামের এই জাহাজটি মাত্র ছয় মাস আগে ২৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জ্বালানি তেল নিয়ে চাঁদপুরে পদ্মা অয়েল কোম্পানির ডিপোতে যাওয়ার পথে ভোলার তুলাতুলি কাঠিরমাথা এলাকায় ডুবে গিয়েছিল। তখন কুয়াশার মধ্যে বালুবাহী একটি বাল্কহেডের সঙ্গে সংঘর্ষে ট্যাংকারটির তলা ফেটে গিয়েছিল।
এর আগে, ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর সুগন্ধা নদীর একই স্থানে একই কোম্পানির সাগর নন্দিনী-৩ জাহাজটিতেও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই বিস্ফোরণে পাঁচজন নিহত হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন
ঝালকাঠির সেই তেলবাহী জাহাজে আবার বিস্ফোরণ-আগুন, আহত ১৪
ঝালকাঠিতে জাহাজে বিস্ফোরণে মৃত্যু বেড়ে ৪
ঝালকাঠিতে বিস্ফোরণে নদীতে পড়া জাহাজের অংশে মিলল আরও ২ লাশ
সাগর নন্দিনী-২ বিস্ফোরণ: পদ্মা অয়েলের তদন্ত কমিটি
সাগর নন্দিনীর ইঞ্জিনরুমে এক দিন পর মিলল লাশ
ঝালকাঠিতে নিখোঁজদের সন্ধান মেলেনি, সুগন্ধা পাড়ে স্বজনদের কান্না
ছয় মাস আগে মেঘনায় ডুবেছিল সাগর নন্দিনী-২, এবার বিস্ফোরণ
সাগর নন্দিনী-২ থেকে সরানো হচ্ছে তেল, নিখোঁজদের উদ্ধার
ঝালকাঠিতে বিস্ফোরণের পর তেলবাহী জাহাজে আগুন, দগ্ধ ৫, নিখোঁজ ৪