শেরপুরে গোড়া পচা রোগে নষ্ট হচ্ছে ব্রি-২৯ ধানের চারা, কৃষক দিশেহারা

শুরুর দিকেই ধানক্ষেত নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে ওই অঞ্চলের কৃষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।

মো. আব্দুর রহিম বাদলশেরপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2024, 04:10 AM
Updated : 28 Feb 2024, 04:10 AM

শেরপুরের বিভিন্ন এলাকার বিপুল জমিতে ব্রি-২৯ বোরো ধান রোপণের পর সদ্য সবুজ হওয়া চারায় গোড়া পচা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এতে ধানের সবুজ পাতা ক্রমে হলদে হয়ে মরে যাচ্ছে। সার-কীটনাশক প্রয়োগ করেও কোনো সুফল না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষক ও কৃষাণিরা।

ভালো ফলনের স্বপ্ন নিয়ে শেরপুরের যেসব জমিতে ব্রি-২৯ ধানের আবাদ হয়েছে, সেসব জমি থেকে শেষ পর্যন্ত আধো কোনো ধান গোলায় তুলতে পারবেন কিনা, সে চিন্তায় কৃষকের কপালে ভাঁজ পড়েছে।

ধানের চারার গোড়া পচে যাওয়ার কারণ হিসেবে কৃষি বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তাদের অবহেলা, সময়মতো পরামর্শ না দেওয়াকে দায়ী করছেন বেশ কয়েকজন কৃষক।

ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ কেউ বলছেন, সরকার অনুমোদিত ব্রি-২৯ ধানের বীজ বাজারে সরবরাহ করেছে ইস্পাহানিসহ বিভিন্ন কোম্পানি। নিম্নমানের সেই বীজ ডিলারদের কাছ থেকে কিনে উৎপাদিত চারা রোপণ করাতেও এ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

বীজবাহিত ও আবহাওয়াজনিত কারণ ছাড়াও একাধিক কারণে এমনটি হতে পারে জানিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক বলছেন, এ জন্য তারা কৃষকদের ব্রি-২৯ জাতের ধান চাষ না করার পরামর্শ দিচ্ছেন। পরিবর্তে ব্রি-৮৯ এবং ব্রি-২৮ এর পরিবর্তে ব্রি-৮৮ জাতের ধান চাষের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। চারা উৎপাদনের আগে যথাযথভাবে বীজ শোধন করে নেওয়ার পরামর্শও কৃষকদের দিচ্ছেন তারা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, এবার জেলায় এ পর্যন্ত প্রায় ৮৯ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ব্রি-২৯ আবাদ হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে।

উপজেলা ও মাঠ পর্যায়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কাজ করছেন বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও কৃষকদের অভিযোগ, কৃষি বিভাগসহ কেউ তাদের পাশে নেই।

সরেজমিনে দেখা যায়, শেরপুর সদর উপজেলার রোয়া বিল ও পাকুড়িয়া ইউনিয়নের খামারপাড়া, বাদাপাড়া, বাটিয়াপাড়া, পূর্বপাড়া, ফকিরপাড়া এলাকায় যেসব কৃষক এবার ব্রি-২৯ ধান আবাদ করেছেন তারাই বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন।

রোয়া বিলে দেড় একর জমিতে ২৯ ধান লাগিয়ে ছিলেন শেখহাটি গ্রামের কৃষক শরিয়তুল্লাহ। গোড়া পচে তার সম্পূর্ণ ক্ষেতের ধানের চারাই নষ্ট হয়ে গেছে।

কৃষক শরিয়তুল্লাহ বলেন, “বড় আশা কইরা দেড়কুর (দেড় একর) জমিতে ২৯ ধান লাগাইছিলাম। এহন দেহুইন ক্ষেত পইচ্চা আর কিছু নাই। সার, বিষ (কীটনাশক) দুইবার কইরা দিবার কইলো, দিলাম। কাজ অয় নাই। এহন কোনো বুদ্ধি নাই। ধার-কর্জ কইরা টেকা জোগাড় কইরা ক্ষেত লাগাইছি। আমার তো আর করার কিছু সাধ্য নাই। এহন কী করমু আমি?”

একই এলাকার কৃষক হাদু মিয়া বলেন, “পাতাডা সবুজ হয়া আসার পরপরই গাছের গোড়া পইচ্চা যাইতাছে। মেলা সার-বিষ দেওয়া অইলোও গাছ বাঁচতাছে না। সরকার কতকিছুই দেখে, ইডা দেখে না?”

একই এলাকার আরেক কৃষক লাল চাঁন মিয়া বলেন, “এই যে, আমরা ব্রি-২৯ ধান লাগাইলাম। এই ধানগুলা মরতাছে। বিষ (কীটনাশক) আইনা দিতাছি। আমরা সবকিছুই করতাছি। তারপরও যে মইরা যাইতাছে, এইডা তো সরকার দেখতাছে না। ধান যদি না অয়, খামুই কী, চলমুই কেমনে, কর্জ-ধার কেমনে দিমু। আমরা ত নিঃস্ব অইয়া যাইতাছি। এইডা সরকার দেহে না ক্যা (দেখে না কেন)? কৃষি অফিসার আছে বলে, হেরা এডা দেখতো না? আমরা যে মইরা যাইতেছি। আমগরে পেডো ভাত নাই, ধান যদি না অয় খামু কী (আমাদের পেটে ভাত নেই, ধান যদি না হয় তবে খাব কী?)”

শেখহাটি এলাকার কৃষানি রশিদা বেগম বলেন, “এককুর জমিতে ব্রি-২৯ ধান লাগাইছি। সম্পূর্ণ মনে করুন, লাল অইয়া যাইতাছে গা। সার-বিষ সব কিছুই দিছি। কাম অয় না। কী করুন যায়, আপনেরা এইডার সমাধান দেইন।”

কৃষক শরাফত আলী বলেন, এই ২৯ ধানগুলি নাগাইলাম। এত হার-বিষ দিলাম। ধানের গোছা নাল অইয়া মইরা গেতাছে গা। কত কিছু দিতাছি কোনো কামেই নাগতাছে না। অত টেহা-পয়সা খরচ কইরা ধান যদি না অয়, খামুই কী, দার-কর্জই দিমু ক্যামনে?

(ব্রি-২৯ ধান রোপণ করেছি। সার-কীটনাশক ছিটানোর পরও গোড়া পচে ধানগাছ লাল হয়ে মারা যাচ্ছে। কত কিছু দিচ্ছি, কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। এতো টাকা-পয়সা খরচ করার পরও যদি ধান না হয় তাহলে খাব কী আর ধারের টাকাই পরিশোধ করব কীভাবে?)

পাকুড়িয়া ইউনিয়নের খামারপাড়া, বাদাপাড়া, বাটিয়াপাড়া, পূর্বপাড়া, ফকিরপাড়া কৃষক সৌকত আলীর আড়াই একর, সোহাগ মিয়ার দুই একর, আজহার আলীর দুই একর, ইব্রাহীমের এক একর, আতর আলীর দেড় একর, মহেজ আলীর দুই একর, কাজলের পাঁচ কাঠা, মুরাদের দশ কাঠা, চুন্নুর দশ কাঠা, সোহেলের এক একর, লান্ডুর দেড় একর, মুসলিমের দেড় একর, আনসার আলীর এক একরসহ শতাধিক কৃষকের বিপুল জমির বোরো ধানের চারা গাছে পচন ধরেছে বলে তারা জানান।

গত দেড় মাস আগে স্থানীয় কৃষকরা তাদের জমিতে ব্রি-২৯ সহ অন্যান্য জাতের বোরো ধানের চারা রোপণ করেন।

কিন্তু গোড়া পচা রোগে শুধু ব্রি-২৯ জাতের ধানের চারাগুলোই বর্ধনশীল হয়নি। সেইসঙ্গে চারার গোড়ায় পচন ধরে পাতাগুলো হলুদ হয়ে যাচ্ছে।

অথচ এ সময়টাতে চারাগুলো থেকে একাধিক পয়ার বের হওয়ার কথা।

শুরুর দিকেই ধানক্ষেত নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে পাকুরিয়া ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের এবং রোয়া বিলের প্রায় শতাধিক কৃষকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।

ইউনিয়নটির কৃষকরা জানান, তাদের অনেকে ঋণ বা ধার-দেনা করে বোরোর আবাদ করেছেন। কথা ছিল, নতুন ধান পেয়ে তারা সেই দেনা পরিশোধ করবেন।

কারও আবার এ ফসলের ওপরই নির্ভর করছে বছরজুড়ে খোরাকির।

কিন্তু ভালো ফলন তো দূরের কথা, চারা রোপণের পর বাড়ন্ত সময়েই ধানক্ষেত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

এ অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্তরা সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা দাবি করছেন।

শেরপুর পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. রহমতউল্লাহ বলেন, “অনেক কষ্ট করে কৃষকরা ব্রি-২৯ ধান লাগাইছে। এবার ঠান্ডার পর থাইকা এই ধানে গোছা অইতাছে (পয়ার ছাড়ছে)। ধানে সবুজ পাতা অয়ার পর পাতা নাল লাইগা পইচ্চা গেতাছে গা (ধান গাছের পাতা সবুজ হওয়ার পর লাল হয়ে পচে যাচ্ছে)। 

“কৃষকরা কইতেছে, তারা ক্ষেতে কীটনাশক ছিটায়েও কোনোই লাভ দেখতেছে না।”

তিনি আরও বলেন, “শেখহাটি রোয়া বিলে একরের পর একর জমির ২৯ ধান নষ্ট অইলেও আমি পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসাবে কোনো কৃষি কর্মকর্তাকে ক্ষেতের গোড়ায় আইতে (মাঠে আসতে) দেখলাম না। ব্রি-২৯ ধান নষ্ট হয়ে কৃষক নিঃস্ব অইয়া যাইতাছে। বলা হয়, কৃষক বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে কিন্তু কৃষকের খোঁজ খবর কেই নিতাছে না। সরকার কর্ণপাত না করলে নিঃস্ব অইয়া এই কৃষকগুলা ‘ঠাইট মইরা যাইব’ (ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে)।  

বাংলাদেশ কৃষক সমিতি শেরপুর জেলা শাখার আহ্বায়ক সোলাইমান আহাম্মেদ বলেন, “কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হলে তারা বলছেন, নিম্নমানের বীজের কারণে এমনটা ঘটছে।

তাহলে আমাদের কথা হচ্ছে, এই নিম্নমানের বীজ বাজারে কেন বিক্রির অনুমতি দিল সরকার? তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি, ধানের চারা মরে যাওয়ার মূল কারণ উদ্ঘাটন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।”

পাকুরিয়া ইউনিয়নের দায়িত্বরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, “চারা রোপণে কৌশলগত ভুল এবং রোপণের সময় প্রচণ্ড শীত ছিল।”

এছাড়া ব্রি ধান-২৯ বীজের বিষয়েও তারা সন্দেহ করছেন। 

তবে তাদের পরামর্শ মেনে ব্যবস্থা নিলে পচনরোধ সম্ভব বলে মনে করছেন এই উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা।

শেরপুর শহরের নিউ মার্কেট এলাকার ইস্পাহানি ধান বীজের ডিলার জাফর আলী বলেন, “ব্রি ২৯ ধানের গাছে পচন রোগ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই পচন নিয়ন্ত্রণের জন্য গাছের পরিচর্যা সঠিকভাবে না করলে বিপর্যয় ঘটতে পারে। এ বিষয়ে কৃষক ভাইদের সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ মোতাবেক সঠিকভাবে মাঠে পদক্ষেপ নিতে হবে ।“

শেরপুর শহরের শেখহাটি বাজারের সার ও ধান বীজের ডিলার মনিরুজ্জামান বলেন, “ধানের বীজ শোধন করার জন্য পানির সঙ্গে ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু কৃষক ভাইয়েরা এটাতে অভ্যস্ত নন। তাই ব্রি ২৯ ধানে পচন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। এ ছাড়া ক্ষেতে পটাস ও জিংক ব্যবহার না করার কারণেও পচন রোগ হতে পারে। শুধুমাত্র বীজের জন্য এমন অবস্থা হয়েছে সেটা সঠিক নয়।”

শেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামের দেওয়া তথ্যমতে, জেলায় এ বছর ৯১ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৮৯ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৯৭ ভাগ।

অতিরিক্ত উপপরিচালকের ভাষ্য, “এ সময়ে দিনের তাপমাত্রা বেশি, রাতের তাপমাত্রা কম থাকছে। রাতে ও সকালে কুয়াশা পড়ার কারণে কিছু কিছু ধান গাছে ছত্রাকজাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। 

আমাদের মাঠ পর্যায়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছেন।”

তিনি বর্তমান আবহাওয়ায় সরকার অনুমোদিত কীটনাশক কার্বেনডাজিম গ্রুপের নাইম, ভেজিস্টিন ও ডাইথেন এম-৪৫ প্রয়োগে কৃষকদের পরামর্শ দেন।