চার দশক ধরে ভাষা আন্দোলনের গল্প শোনাচ্ছেন তারা

কুমিল্লার গোমতী, মেঘনা ও তিতাস পাড়ের সংস্কৃতিচর্চা বিকশিত করতে জন্ম হয় ‘তিননদী পরিষদ’।

আবদুর রহমান, কুমিল্লা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Feb 2023, 04:06 PM
Updated : 20 Feb 2023, 04:06 PM

১৯৮৩ সাল। কিছু সংস্কৃতিকর্মী উদ্যোগ নেন কুমিল্লার গোমতী, মেঘনা ও তিতাস- এই তিন নদীপাড়ের সংস্কৃতিচর্চাকে বিকশিত করার। সেই ভাবনা থেকে জন্ম নেওয়া ‘তিননদী পরিষদ’ চার দশক ধরে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।  

কুমিল্লার অন্যতম এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনটি প্রতিবছর ২১ দিন ধরে ‘নগর উদ্যানের’ ঐতিহ্যবাহী ‘জামতলা’য় ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরছে মানুষের কাছে। সংগঠনের এই মঞ্চকে ব্যবহার করে হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামও। 

পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আবুল হাসানাত বাবুল বলেন, ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ১৯৮৪ সালে সর্বপ্রথম ২১ দিনব্যাপী আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো কুমিল্লা পৌর পার্কের জাম গাছের তলায়। গাছটি এখনও আছে। এখন সেটি ‘জামতলা’ নামে পরিচিত। 

“মা, মাতৃভূমি ও ভাষার প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে সূচনা হয়েছিল তিননদী পরিষদের। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লার তৎকালীন জেলা প্রশাসক সৈয়দ আমিনুর রহমানের কাছে গেলাম। তিনি পৌরসভার মাধ্যমে ২১শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে অনুষ্ঠান করার জন্য পৌর পার্কের জাম গাছের নিচে একটি পাকা মঞ্চ করে দিলেন।“ 

এরপর থেকে প্রতিকূলতার মধ্যেও চার দশক ধরে অনুষ্ঠান চলছে জানিয়ে আবুল হাসানাত বাবুল বলেন,   এই মঞ্চেই কুমিল্লার ভাষা সৈনিকদের মধ্যে প্রয়াত অ্যাডভোকেট আহমেদ আলী, অধ্যাপিকা লায়লা নূর, আলী তাহের মজুমদার, মো. আবদুল জলিলসহ অসংখ্য গুণীজন তাদের সংগ্রামের কথা বলেছেন। তারা নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছেন ভাষার গল্প আর স্বাধীনতার ইতিহাস।” 

কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহসানুল কবীর জানান, ভাষা আন্দোলন নিয়ে কুমিল্লার রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। কুমিল্লার সন্তান শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উদ্যোক্তা রফিকুল ইসলামসহ অনেক গুণীজন বাংলা ভাষার সম্মানকে তুলে ধরতে কাজ করেছেন। কুমিল্লার অজিত গুহ, মেজর গণিও ভাষার সম্মান রক্ষায় ভূমিকা রেখেছেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই পাকিস্তান গণপরিষদে সর্ব প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ‘তিন নদী পরিষদ’ এসব গুণী মানুষের কথা, ভাষা আন্দোলনের কথা ও স্বাধীনতার কথাই নতুন প্রজন্মসহ সব মানুষকে শোনাচ্ছে গত ৪০ বছর ধরে। 

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক অধ্যাপক শান্তি রঞ্জন ভৌমিক বলেন, কুমিল্লার কৃতি সন্তান শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সর্বপ্রথম পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিলেন। তখন সমস্ত পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। তারা বাংলায় কথা বলতেন। কিন্তু শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সেই দাবি তখন তারা মেনে নেয়নি। 

“তিননদী পরিষদ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে ৪০ বছর ধরে পৌঁছে দিচ্ছে। প্রতি বছর একুশ এলেই সবাই ছুটে আসেন এই জামতলায়। এজন্য কাউকে নিমন্ত্রণও করতে হয় না। বাংলাদেশে আর কোথাও এ ধরনের অনুষ্ঠান হয় বলে আমার জানা নেই।”

প্রতি বছরের মতো এবারও ১ ফেব্রুয়ারি থেকে তিননদী পরিষদের ২১ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার শুরু হয়েছে। এবার অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন অধ্যাপক আমীর আলী চৌধুরী, অতিথি ছিলেন কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার মো. আব্দুল মান্নান। 

অধ্যাপক আমীর আলী চৌধুরী বলেন, “কুমিল্লার ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেক গৌরব আছে। সেই ইতিহাস ৪০ বছর ধরে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে তিননদী পরিষদ। এটা অনেক গৌরবের।” 

পুলিশ সুপার বলেন, “এটি ব্যতিক্রম আয়োজন এবং বিরল দৃষ্টান্ত। আমরা যদি ভাষার ইতিহাস না জানি, স্বাধীনতার ইতিহাস না জানি এবং বঙ্গবন্ধুকে আগামী প্রজন্মের নিকট তুলে ধরতে না পারি- তাহলে স্মার্ট বাংলাদেশ সার্থক হবে না। তাই ইতিহাস চর্চার মঞ্চ এই তিননদী পরিষদের মঞ্চ।“ 

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আমির আলী চৌধুরী বলেন, “২১ দিনব্যাপী একুশের অনুষ্ঠান দেশের আর কোথাও হয় বলে আমার জানা নেই। বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা থাকলেই এমন কাজ করা সম্ভব। ভাষা আন্দোলনে কুমিল্লার অনেক অবদান রয়েছে।”

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, “৪০ বছর ধরে তিননদী পরিষদ ২১ দিনব্যাপী এই আয়োজন করছে জেনে অবাক হয়েছি। এটা সত্যিই একটি গৌরবের বিষয়। এজন্য সংগঠনটির সকলকে ধন্যবাদ জানাই।”  

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর জমির উদ্দীন খান জম্পি বলেন, “স্বৈরাচার এরশাদ যখন সারাদেশে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছিল, তখন এই তিননদী পরিষদের মঞ্চ থেকেই কুমিল্লার মানুষ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়। এরপর থেকে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে এই মঞ্চের মাধ্যমেই। 

“কুমিল্লাকে বলা হয় ‘শিক্ষা-সাংস্কৃতির’ রাজধানী। সেই ঐতিহ্য রক্ষায় তিননদী পরিষদের পথচলা অব্যাহত থাকবে।”