‘সরকারের একজন প্রতিনিধি হিসেবে দায় আছে’ বলেন ডিসি
Published : 07 Nov 2022, 11:46 PM
গাজীপুরে পরিবেশবিষয়ক এক গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরিবেশ দূষণের ফলে গাজীপুর মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার বিষয়টি সামনে এসেছে। দাবি করা হচ্ছে- গাজীপুরের একটি জলাশয়ও আর দূষণমুক্ত নেই।
সোমবার দুপুরে গাজীপুরের পিটিআই ক্যাম্পাসের শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার অডিটোরিয়ামে এ গণশুনানি হয়।
পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা, নদী পরিব্রাজক দল, সিএএফওডি, সুইডেন স্ভেরিজ এর আয়োজন করে।
জলাশয়গুলো সংকুচিত, দখল, কারখানা ও গৃহস্থালী বর্জ্য ফেলা, বনের জমিতে কল-কারখানা, বসতবাড়ি, পার্ক নির্মাণ, শালসহ প্রাকৃতিক বনজ গাছ কেটে ভিন্ন প্রজাতির গাছ রোপণসহ নানা কারণে দূষণের এসব ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন শুনানিতে অংশ নেওয়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের অধ্যাপক অসীম বিভাকর বলেন, “গাজীপুরের পরিবেশ স্বাভাবকি করতে হলে জনগণের অংশগ্রহণে প্রশাসনের নিয়মিত মনিটরিং, আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে হবে। শিল্পায়ন যেমনিভাবে অর্থনীতির জন্য বড় ভূমিকা রাখে তেমনি পরিবেশ দূষণ বন্ধ করা অর্থনীতির অন্যতম সহায়ক।”
জলাশয়ের কারণে হাতিরঝিলের বিজিএমইএ ভবন ভেঙে ফেলার উদাহরণ টানেন গাজীপুর ইতিহাস ঐতিহ্য উন্নয়ন’র চেয়ারম্যান প্রকেশৗশলী মো. শামসুল হক।
তিনি আরও বলেন, “কাগজেপত্রে গাজীপুরের জনসংখ্যা দেখানো হয় ২৬ লাখ; কিন্তু বাস্তবে ৭০ লাখ। ২৬ লাখ জনগোষ্ঠীর বর্জ্যের জন্য প্রতিদিন ৭০ শতক জায়গার প্রয়োজন। অথচ এখন পর্যন্ত অপরিকিল্পতভাবে সড়ক ও জনপদের জায়গায় দিনের পর দিন বর্জ্য ফেলে যাচ্ছে সিটি করপোরেশন।”
নদী পরিব্রাজক দলের গাজীপুরের সভাপতি মোশারফ হোসেন বলেন, “মোগরখালের পাড়ে মাদ্রাসা-মসজিদসহ স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। মোগরখালটি নয়টি গ্রামের বুক চিরে প্রবাহিত। খালের দুই পাশে ২০টি গ্রামের উপকারভোগী মানুষ আছেন। হাজার হাজার একর জমি আবাদ হয় খালের পানি দিয়ে। যদিও আমরা এখন আর কৃষিজমি আবাদ করতে পারছি না। অতি সম্প্রতি খালের ওপর একটি ব্রিজ নির্মাণ করে খালের প্রবাহ উল্টো দিকে ঘোরানো হয়েছে।”
ব্রিজটি খালের পানি প্রবাহের দিকে করার অনুরোধ জানান তিনি।
রোভারপল্লী ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক আমীর হোসেন বলেন, “বন বিভাগের স্থানীয় লোকজনই মনিপুরের বন ধ্বংস করছে। তারা ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকার বিনিময়ে বনের ১৫-২০ ফুট জমিতে বাড়ি করার অনুমতি দিচ্ছে। শিল্প মালিক যারা বন দখল করছে, রিসোর্ট-পার্ক তৈরি করছে সেসব রাঘব বোয়ালদের বিরুদ্ধে মামলা হয় না। মামলার শিকার হচ্ছেন এলাকার নিরীহ সাধারণ মানুষ, যারা দখলের প্রতিবাদ করেন।”
এ সময় তিনি বলেন, “এলাকার লোকজন দখলের প্রতিবাদ করেন; বাইরে থেকে এসে কেউ বন দখলের প্রতিবাদ করেন না।”
গাজীপুরের মারিয়ালী এলাকার বাসিন্দা নাঈমা সুলতানা বলেন, “ময়লার কারণে গাজীপুর শহরের শিববাড়ী থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত নাক খুলে শ্বাস নেওয়া যায় না।”
গণশুনানিতে ছিলেন গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আব্দুল্লাহ মৃধা।
তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে খালের পানিতে বিষাক্ত বর্জ্য প্রবাহিত হচ্ছে। তার প্রভাবে গবেষণাগারের মাছের মধ্যে এমন রোগ হয় যা টেস্ট করে পাওয়া যায় না। অর্গানিক পরিবর্তন করে এমনটি হয়েছে। গরুর জন্য চাষ করা ঘাসের মধ্যে এমন কিছু বিষ দেখা গেছে যা গাভী খাওয়ার পর দুধ পর্যন্ত বিষাক্ত হয়ে উঠেছে।”
তিনি এসবের প্রতিকার দাবি করেন।
শ্রীপুর উপজেলা নদী পরিব্রাজক দলের সহ-সভাপতি মো. মহসীন বলেন, “ব্যাটারি কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া ও বর্জ্যে কেওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ ওই এলাকার মানুষ অসহনীয় দুর্ভোগে। ওই কারখানার আশপাশের লোকদের পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সেখানকার ২০ ভাগ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত।”
সাহাপাড়া এলাকার বাসিন্দা কাজী বদরুত আলম মনির বলেন, “গাজীপুর শহরের জোড়পুকুর, সিটি করপোরেশন ভবনের উত্তর পাশের পুকুর, ফায়ার সার্ভিস অফিস সংলগ্ন টাঙ্কিরপাড়া পুকুর, কালীবাড়ী পুকুর, রাণী বিলাসমনি পুকুরের মধ্যে বেশ কয়েকটি দখল এবং কিছু মৃতপ্রায় হয়ে উঠেছে।”
‘পরিবেশ দূষণে বিপর্যস্ত গাজীপুর’ শিরোনামে শুনানি পরিচালনা করেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
এতে প্রধান অতিথি ছিলেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আনিসুর রহমান।
গাজীপুরে জলাশয়ের যে প্রবাহ আগে খালে-বিলে ছিল এখন আর তা নেই জানিয়ে আনিসুর রহমান বলেন, “সরকারের একজন প্রতিনিধি হিসেবে আমার অনেক দায় আছে।”
একটি গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, “সিটি করপোরেশনের ২০৬টি পুকুর বেদখল হয়ে গিয়েছিল। সেখানে ইতোমধ্যে আমরা আটটি পুকুর উদ্ধার করেছি। আমার কাছে এনফোর্স করার মতো সুযোগ আছে কিন্তু সাসটেইন করার মতো বাজেট নেই।”
সাসটেইন করার দায়িত্ব তিনি জনসাধারণকে নেওয়ার আহ্বান জানান।
মানুষের সম্পৃক্ততা ছাড়া গাজীপুরের সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় বলেও তার অভিমত।
গণশুনানিতে আরও বক্তব্য দেন গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রীণা পারভীন, ভাষা শহীদ কলেজের অধ্যক্ষ মুকুল কুমার মল্লিক, বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন।