“আমরা বাগানের শ্রমিক বলে কি আমাদের কোন সম্মান নেই?”
Published : 05 Nov 2024, 10:21 PM
“আমাদের পেটে ভাত না পড়লে কাজ করব কিভাবে? সাত সপ্তাহের বেতন বন্ধ রয়েছে। যেই সরকার থাকে না কেন; তারা যাতে আমাদের দিকে খিয়াল রাখেন, যেন আমরা ভালো করে চলতে পারি।
কথাগুলো বলছিলেন, সিলেটের লাক্কাতুরা চা-বাগানের নারী শ্রমিক ঝরনা বেগম।
মঙ্গলবার বিকালে সিলেট নগরীর এয়ারপোর্ট সড়ক এলাকার বিভাগীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রধান গেইটে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ‘ন্যাশনাল টি কোম্পানির’ অধীন সিলেটের তিনটি চা বাগানের শ্রমিকরা সাত সপ্তাহ ধরে বেতন না পাওয়ার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন।
কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার আগে শ্রমিকরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে নিজের দুর্দশার কথাগুলো বলেন।
মানববন্ধনে ‘আমাদের বেতন না দিলে, রাজপথ ছাড়ব না’, ‘চা শ্রমিকের সংগ্রাম, চলছে-চলবে’, ‘আট সপ্তার বেতন, দিতে হবে দিয়ে দাও’, ‘আমাদের বেতন না দিলে, রাজপথ ছাড়ব না’, ‘আমাদের ন্যায্য বেতন, দিতে হবে দিয়ে দাও’, ‘রুটি-রুজির সংগ্রাম, চলছে চলব-’ স্লোগান দেন শ্রমিকরা।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী-সারাদেশে ন্যাশনাল টি কোম্পানির ফাঁড়ি বাগানসহ ১৬টি চা বাগান রয়েছে। এসব বাগানে প্রায় ১৭ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাদের উপর হাজার নির্ভর করে আরও ৩০ হাজার মানুষের ভরণপোষণ। ন্যাশনাল টি কোম্পানির আওতাধীন সিলেট বিভাগের আওতাধীন সব চা বাগানেই বেতন বকেয়া পড়েছে।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাজু গোয়ালা বলেন, “সিলেটে এনটিসি মালিকানাধীন লাক্কাতুরা, দলদলি ও কেওয়াছড়া চা বাগানে চলতি সপ্তাহসহ আট সপ্তাহ ধরে শ্রমিকদের বেতন বন্ধ রয়েছে।
“বকেয়া বেতনের দাবিতে আজ আবার লাক্কাতুরা এলাকায় শ্রমিকরা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। তবে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের কিছু জানাচ্ছে না। তারা শুধু অপেক্ষা করতে বলছে। শ্রমিকেরা না খেয়ে কতদিন থাকবে”?
লাক্কাতুরা চা বাগানে গিয়ে দেখা গেছে, বিভাগীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রধান গেইটে নারী চা শ্রমিকদের কেউ-কেউ বসে আছেন; কেউ বা আবার দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাদের চোখে-মুখে রয়েছে অসহায়ত্বের ছাপ আর কপালে চিন্তার ভাঁজ।
মানববন্ধনে অংশ নিতে অনেক শ্রমিককে বাগান থেকে হেঁটে আসতে দেখা গেল। আবার বাগানের চা-পাতা পরিবহনের গাড়িতে করেও আসেন অনেকে।
ঝরনা বেগম বলছিলেন বলছিলেন, “আমাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারি না। তাদের চারটা ভাত ঠিক মত খাওয়াতে পারি না। বেতন বন্ধ হওয়ার পর না পেরে আমরা ডিসির অফিসে গিয়ে সাহায্য চাইলাম, তিনি আমাদের ২০ কেজি করে চাল দিয়েছেন।
“এই চালের লগে কি আমাদের ডাল, তেল, মসলা লাগে না?। পরে আমরা না পেরে চা-বাগান থেকে কচু শাক এনে, লবণ ছাড়া এই কচু শাক দিয়ে ভাত খেয়েছি পরিবারের সবাইকে নিয়ে। দুঃখের কথা কি বলব, বলতে গেলে কান্না আসে। এভাবে দিন যাচ্ছে আমাদের।”
৭ সপ্তাহ বেতন নাই, কেউ শোনেও না, ভাবেও না: ক্ষোভ চা শ্রমিকের
মজুরি না পেয়ে ন্যাশনাল টির শ্রমিকদের দিন কাটছে 'খেয়ে না খেয়ে'
কথাগুলো বলতে গিয়ে চোখ ছলছল করে ওঠে ঝরনার। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, “আমাদের প্রতিমাসে ৩০০ টাকার মত কাটে ফান্ডের জন্য। এ ফান্ডের টাকাও খোঁজ নেই; আমরা পাব কি-না, তাও জানি না। টাকার জন্য ডাক্তার দেখাতে পারছি না। ছয় হাজার টাকা বাকি খেয়েছি দোকান থেকে, এখন টাকার জন্য দোকানদারও চাপ দিচ্ছে।”
এ অবস্থায় শ্রমিকদের প্রতি নজর দিতে সরকারের প্রতি অনুরোধও জানিয়েছেন তিনি।
ঝরনা বলেন, “বেতন দিলে কাজে যাবো, বেতন না দিলে যাব না। আন্দোলন করব, রাস্তা ব্লক করব। এতে যদি গুলি চালাতে হয়, চালাক; গুলি করে সবাইকে মেরে ফেলুক। আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’’
নারী চা শ্রমিক কুলবতি লোহার বলেন, “আমরা রাস্তায় নামছি বেতনের জন্য, কিভাবে আমরা ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকমু? আমাদের বেতন বন্ধ। খেয়ে, না খেয়ে আন্দোলন করছি। সরকার আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না। আমরা তো কারও ক্ষতি করিনি। তাহলে আমরা কেন রাস্তায় থাকব? আমাদের কান্না কেউ দেখে না।”
ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, “আমাদেরও খেয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তাহলে আমরা কেন বঞ্চিত হচ্ছি। আমরা চাই বাচ্চাদের মুখে ভাত দিতে। এই অবস্থা কেন আমাদের?। যদি না পারে বেতন দিতে, তাহলে বলে দিলেই হয়। যদি আমাদের মেরে ফেলে তাহলে শান্তি। আমাদের গুলি করে মেরে দিলেই হয়। আমরা এ রকম ধুকে-ধুকে মরতে চাই না।’’
ঝরনা আর কুলবতীর পাশে যুমনা বেগম নামে আরেক নারী শ্রমিক দাঁড়িয়ে ছিলেন। কুলবতির কথা শেষ না হতেই তিনিও বলতে শুরু করেন চা শ্রমিকদের কষ্টের কথা।
পরিবারের আট সদস্য নিয়ে কোনো রকমে তার সংসার চলছে জানিয়ে যমুনা বলেন, “আমারা বেতন চাইলে কোম্পানি দেয় না, আজকাল দোকানদারও বাকি দিতে চায় না। এখন বুঝেন, কিভাবে চলছি আমরা। কেন আমরা এত অবহেলিত? আমরা বাগানের শ্রমিক বলে কি আমাদের কোন সম্মান নেই? আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়েও সম্মান পাই না।”
পারুল লোহার বলেন, “আট সপ্তাহ ধরে বেতন বন্ধ। বাচ্চাদের স্কুলে দিতে পারছি না। সংসার চলছে ধারদেনা করে। আমাদের বেতন দেওয়ার হলে দিয়ে দেন; না হলে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন।
অর্থের অভাবে পরিবারের আট সদস্য নিয়ে খুব কষ্টে কাটছে যাচ্ছে শিল্পী মুদির। লবণ ছাড়া ভাত খেয়ে কোনোমতে পেট চালিয়ে নেওয়া এ শ্রমিক বলেন, “বেতন দিলে হাট-বাজার করতে পারব।”
একই ভাষ্য, অমিরন গোয়ালা, মজন উরাওসহ উপস্থিত অন্য শ্রমিকদের।
চা শ্রমিকদের বকেয়া বেতনের বিষয়ে ন্যাশনাল টি কোম্পানি-এনটিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহমুদ হাসানের মোবাইল কল করা হলে তিনি সাড়া দেননি।
তবে এর আগে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ হচ্ছে। চা শ্রমিকরা তাদের বকেয়া মজুরি পাবেন; আশা করছি, দ্রুতই আমরা এ সমস্যার সমাধান করতে পারব।”