ক্ষত ঢেকে নানুয়ার দিঘির পাড়ে ফিরেছে ‘উৎসবের আমেজ’

কুমিল্লার দুর্গাপূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা বলছেন, এবার পূজা ঘিরে আইনশৃংখলা বাহিনী ও প্রশাসনের বাড়তি তৎপরতা দেখছেন তারা।

আবদুর রহমান, কুমিল্লা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Sept 2022, 07:26 AM
Updated : 30 Sept 2022, 07:26 AM

নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজা মণ্ডপে কোরআন শরিফ উদ্ধারের পর সারাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ক্ষত না শুকালেও সব ভুলে দুর্গাপূজার আনন্দে মেতে উঠতে চান কুমিল্লার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

কুমিল্লার পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা বলছেন, এবার আইনশৃংখলা বাহিনী ও প্রশাসনের বাড়তি তৎপরতা দেখছেন তারা। এতে অনেকটা ‘স্বস্তিতেই’ পূজা উদযাপনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ করেছেন। এখন উৎসবের রংয়ে নিজেদের রাঙাতে চলছে শেষ পর্যায়ের প্রস্তুতি।

মহামারীর কারণে ২০২০ সালের দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল সীমিত পরিসরে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসায় গত বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় এ উৎসব উদযাপনের প্রস্তুতিও ছিল ব্যাপক। কিন্তু কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের এক পূজা মণ্ডপে কোরআন শরিফ উদ্ধারের পর পূজার আনন্দ ম্লান হয়ে যায় মুহূর্তেই।

বছর ঘুরে আবারও এসেছে দুর্গাপূজা। উৎসবকে ঘিরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মনে যেমন আনন্দ ছিলো, তেমনই ঘিরে ছিলো চাপা আতঙ্ক। গত বছরের তাণ্ডবের পর এবার দুর্গোৎসব উদযাপন নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন অনেকেই।

কুমিল্লা মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্য দাশ টিটু এবার সেই নানুয়ার দিঘির পাড়ের ওই অস্থায়ী পূজামণ্ডপের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন।

Also Read: কুমিল্লা: মন্দিরে সংঘবদ্ধ হামলাকারীরা অচেনা, বলছেন স্থানীয়রা

গেল বছরের ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলেই ভাবতে চান জানিয়ে টিটু বলেন, “গত বছরের ওই ঘটনায় আমাদের উৎসব পরিণত হয়েছিলো বিষাদে। নিরাপদে উৎসব পালন করতে পারবো বলে এবার আইনশৃংখলা বাহিনী ও প্রশাসনের আশ্বাস পাচ্ছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে খুব বেশি আতঙ্ক না থাকলেও বাস্তবতায় বলতে গেলে- পুরোনো সেই ক্ষত এখনও শুকোয়নি।”

“তবে আমরা গেল বছরের ঘটনাকে একটি বিচ্ছিন ঘটনা বলেই ভাবতে চাই। আমরা আশাবাদী, শেষ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিমসহ সকলে মিলেমিশে আনন্দঘন অতীতের মতোই উৎসব পালন করতে পারবো।”

এবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকা ও জেলার ১৭টি উপজেলায় ৭৯৪টি মণ্ডপে শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপিত হবে। প্রতিটি মণ্ডপে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিতে আগ থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। এরই মধ্যে কয়েক দফা সকল ধর্মের মানুষদের নিয়ে প্রস্তুতিমূলক সভাও করা হয়েছে।

Also Read: গ্রেপ্তার ইকবালকে নেওয়া হয়েছে কুমিল্লায়

কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন এ বছর নানুয়ার দিঘির পাড়ের ওই অস্থায়ী দুর্গাপূজা মণ্ডপসহ প্রতিটি স্থানে সর্বোচ্চ সতর্কতায় পূজা উদযাপন করা হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এমপি বাহার বলেন, “এ বছর আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক আছি। নানুয়ার দিঘির পাড়ে এবার অবশ্যই জাঁকজমক ভাবে পূজা হবে। এবার যদি কেউ কোনো পূজামণ্ডপে হামলা করে, সে পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। এবার কোনো ষড়যন্ত্র হলে ষড়যন্ত্রকারীদের কঠোর হাতে দমন করা হবে। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের পক্ষ থেকে কুমিল্লা নগরীর প্রতিটি পূজামণ্ডপ এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী কাজ করবে।”

Also Read: ‘উসকানি’ দিয়ে মন্দিরে হামলা, আটক ৪৩

গত বছরের ১৩ অক্টোবর ভোরে কুমিল্লা নগরীর নানুয়া দিঘির পাড়ে শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে তৈরি অস্থায়ী পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ পাওয়া যায়। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নগরীর চারটি মন্দির ও সাতটি পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ঘটে। এ ছাড়া নগরীর ঠাকুরপাড়া এলাকায় রক্ষাকালী মন্দির, কাপড়িয়াপট্টি শ্রী শ্রী চান্দমনি রক্ষাকালী মন্দির, মনোহরপুর এলাকার রাজ রাজেশ্বরী কালীবাড়ি মন্দিরেও সহিংসতা হয়েছিলো সেদিন।

রাজেশ্বরী কালীবাড়ি মন্দিরে সহিংসতার সময় ইটের আঘাতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দিলীপ কুমার দাস নামে একজন মারা যান।

এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শঙ্কা ও আতঙ্ক থাকলেও প্রশাসনের আশ্বাসে পূজার আনন্দেই মেতে উঠতে চান বলে জানালেন কুমিল্লা জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি নির্মল পাল।

তিনি বলেন, “আমরা জনপ্রতিনিধি থেকে প্রশাসনের তৎপরতায় এখন পর্যন্ত সন্তুষ্ট। এবার জেলার মোট ৭৯৪টি মণ্ডপে পূজা উদযাপন হবে। এর মধ্যে গত বছর হামলার শিকার হওয়া প্রতিটি মণ্ডপেও পূজা হবে। গত বছরের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার আমরাও সতর্ক থাকার চেষ্টা করবো “

এ বছরের শারদীয় দুর্গোৎসবে নানুয়ার দিঘির পাড়সহ জেলার সবকটি পূজামণ্ডপে সর্বোচ্চ সতর্কতা থাকবে বলে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান জানিয়েছেন।

সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের পাশাপাশি পুলিশ ও আনসার সদস্যদের দিয়ে সার্বক্ষণিক পাহারাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা সকল ধর্মের মানুষজন নিয়ে বেশ কিছু প্রস্তুতি নিয়েছি। আমরা আশাবাদী, শেষ পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশেই শেষ হবে শারদীয় উৎসব।”

এবারের শারদীয় দুর্গোৎসব হবে আনন্দের এবং উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার মো. আব্দুল মান্নানেরও।

“প্রতিটি পূজামণ্ডপে নিরাপত্তা দিতে কয়েক স্তরে আইনশৃংখলা বাহিনী মোতায়েন থাকবে। কেউ কোনো ধরনের নাশকতা করে পালিয়ে যেতে পারবে না। আমরা এ বছর সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছি”, বলেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।

কুমিল্লা জেলায় মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মের মানুষের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনের বয়স প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো বলে জানালেন কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহসানুল কবীর। এ দীর্ঘ সময়ে এখানে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ হয়েছে কি-না এমন কোনো তথ্য জানতে পারেননি তিনি।

কুমিল্লা জেলায় স্থায়ীভাবে প্রথম মুসলমান পরিবার হিসেবে ১৬৬১ সালে বসবাস শুরু হয়েছিলো গোবিন্দপুর কাজী বাড়িতে। গোবিন্দপুর কাজী বাড়ির অবস্থান কুমিল্লা নগরীতে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে মুসলমানরা কুমিল্লা জেলায় বসতি গড়ে তোলেন বলে জানালেন এ ইতিহাসবিদ।

গত বছরের ওই ঘটনাটি কুমিল্লার ইতিহাসের সঙ্গে একেবারেই বেমানান উল্লেখ করে তিনি বলেন, “১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও কুমিল্লায় কোনো মন্দির বা মণ্ডপে হামলা হয়নি। ঐতিহ্যগতভাবেই এ জেলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নগরী। ফলে গত বছরের ওই ঘটনাটিকে দিয়ে কুমিল্লার সম্প্রীতির বন্ধন ভেঙে ফেলারও সুযোগ নেই। কুমিল্লার শত শত বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অতীতের মতোই ভবিষ্যতেও অটুট থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি।”

মুফতি মাসুদুর রহমান মজুমদার নামে কুমিল্লার এক মসজিদের খতিব বলেন, “প্রতিটি ধর্মের মানুষেরই নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব পালনের স্বাধীনতা রয়েছে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। মুসলমানদের দায়িত্ব অন্য ধর্মের মানুষের ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করা। প্রয়োজন মতো মুসলমানরা হিন্দুসহ অন্য ধর্মের মানুষের উৎসব পালনে নিরাপত্তা দিতে পারেন।

১২ মামলার ছয়টিতে অভিযোগপত্র:

কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কোরআন রাখা ও সহিংসতার গত বছরের ঘটনায় মোট ১২টি মামলা হয়েছিলো কুমিল্লার বিভিন্ন থানায়। ঘটনার পরপরই এসব মামলার মধ্যে ছয়টির তদন্তের দায়িত্ব পায় কুমিল্লার সিআইডি। বাকি ছয়টি মামলার মধ্যে কুমিল্লার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব পায় চারটি এবং কুমিল্লা কোতোয়ালী মডেল থানা পায় দুটি দুটি মামলার দায়িত্ব।

ওই ১২টি মামলার মধ্যে এরই মধ্যে ছয়টির তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে আইনশৃংখলা বাহিনী। এর মধ্যে পাঁচটি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে সিআইডি। আর পিবিআই দিয়েছে একটি মামলার। বাকি মামলাগুলোও তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

নগরীর নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ রাখার ঘটনার আসামি ইকবাল হোসেনের মামলাটির তদন্ত করছে সিআইডি। ইকবাল নগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের দ্বিতীয় মুরাদপুর-লস্করপুকুর এলাকার বাসিন্দা। এ ছাড়া ওই মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে আছেন নগরীর মৌলভীপাড়ার ইকরাম হোসেন ওরফে রেজাউল হক, দারোগাবাড়ির মাজারের সহকারী খাদেম নগরীর উত্তর চর্থা এলাকার আশিকুর রহমান ফয়সাল, তার সঙ্গী মো. হুমায়ন কবির ও কুমিল্লা সিটির সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচিত মহিউদ্দিন আহমেদ বাবু। এ মামলায় ইকবাল হোসেন ছাড়া বাকি আসামিরা জামিনে আছেন বলে জানিয়েছে সিআইডি।

মামলার সবশেষ অবস্থা জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার কুমিল্লা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, “আমাদের তদন্ত শেষ। তবে মামলাটি ঘটনার সময় সঠিক ধারায় থানায় রেকর্ড হয়নি। এ জন্য আমরা আদালত ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন শাখা ২-এর কাছে মামলার ধারা পরিবর্তনের আবেদন করেছি। সেখান থেকে আদেশের কপি পেলেই আমরা অভিযোগপত্র দাখিল করবো।”

তিনি আরও বলেন, তাদের কাছে থাকা বাকি পাঁচটি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। এই মামলাগুলোতে ১০৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।

পিবিআই, কুমিল্লার পরিদর্শক আবদুল্লাহ আল মাহফুজ বলেন, “আমাদের কাছে থাকা চারটি মামলার মধ্যে একটি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি মামলাগুলোরও তদন্ত প্রায় শেষ। দ্রুত সময়ের মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে বলে আশা করছি।”

কুমিল্লা কোতোয়ালী থানার ওসি মুহাম্মদ সহিদুর রহমান জানান, তাদের কাছে থাকা দুটি মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। পুরোপুরি শেষ হলে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করবেন।

এ প্রসঙ্গে কুমিল্লা মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্য দাশ টিটু বলেন, “বিচারহীনতা নতুন নতুন অপরাধ সৃষ্টি করতে অপরাধীদের উৎসাহিত করে। আমরা চাইবো দ্রুত সময়ের মধ্যে সকল মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ করবে আইনশৃংখলা বাহিনী। আর প্রত্যাশা থাকবে আদালতে দোষীদের উপযুক্ত বিচার হবে। আমার বিশ্বাস সঠিক বিচার হলে দেশে এমন ঘটনা অনেকাংশেই কমে যাবে।”