ব়্যাবের অভিযানে গুলিতে নিহত কাশেমের বাড়িতে শোক ছাপিয়ে আতঙ্ক

নিহত আবুল কাশেমের ছেলে, ভাতিজা ও নাতিসহ পাঁচজন র‌্যাবের মামলায় কারাগারে গেছেন।

সৌরভ হোসেন সিয়াম, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2023, 02:31 PM
Updated : 19 March 2023, 02:31 PM

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে আসামিকে ধরতে গিয়ে ব়্যাবের অভিযানের সময় গুলিতে নিহত আবুল কাসেমের পরিবারে সদস্যরা ‘ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে’ সময় অতিবাহিত করছেন বলে জানিয়েছেন।

পরিবারের সদস্যের মৃত্যুর শোকের মধ্যে অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আর কয়েকজন র‌্যাবের করা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আছেন কারাগারে। বাড়িতে পরিবারের নারী সদস্যরা ‘উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা’ নিয়ে আছেন।

শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টায় বরগাঁ এলাকায় র‌্যাবের ওই অভিযানের মধ্যে গোলাগুলিতে প্রয়াত কদম আলীর ছেলে আবুল কাশেম (৬৫) নিহত হন। তারপর রাতেই নিহতের ছেলে, তিন ভাতিজা ও নাতিসহ ২০ জনকে আটক করে নিয়ে যায় র‌্যাব।

এরপর রোববার ভোরে র‍্যাব ১১-এর আদমজী ক্যাম্পের ওয়ারেন্ট আফিসার মো. নাসিরউদ্দিন ২১ জনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলায় ব়্যাব তাদের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধার অভিযোগ আনা হয়।

আটকদের মধ্যে ১৫ জনকে ছেড়ে দিলেও নিহত আবুল কাশেমের ছেলে নজরুল ইসলাম (৪০), তিনি পেশায় জামদানি কারিগর, তার তিন ভাতিজা জাহাঙ্গীর আলম (৪৫), আমানুল্লাহ (৪২) হযরত আলী এবং ২৫ বছর বয়সী নাতি মো. রুবেল মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রোববার আদালতে পাঠানো হয়।

পরে জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম সানজিদা সারোয়ারের আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। এ ছাড়া হত্যা মামলার আসামি মো. সেলিমকেও এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

আবুল কাসেমের পাঁচ ছেলে আর এক মেয়ে। প্রথম স্ত্রীর চার ছেলে নজরুল ইসলাম, দ্বীন ইসলাম, জহিরুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম ও মেয়ে শিউলি বেগম এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে মাহফুজ ইসলাম।

বাবা মারা যাওয়ার খবর শুনে মেয়ে বাড়িতে এসেছেন, এসেছেন কাসেমের এক বোনও। শনিবার রাতে জানাজা শেষে বরগাঁ স্থানীয় কবরস্থানেই দাফন করা হয় আবুল কাসেমকে। জানাজায় চার ছেলে ও স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন। রোববার ছেলেদের আর বাড়ি পাওয়া যায়নি। বাড়িতে ছিলেন নারী সদস্যরা।

নিহতের ছেলে গ্রেপ্তার নজরুল ইসলামের স্ত্রী আমিনা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জানান, তার দশম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে শ্রাবণকেও র‌্যাব নিয়েছিল। শনিবার সন্ধ্যায় তাকে ছেড়েছে। পরে ছেলেকে খালার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তারা বাবা হত্যা মামলার আসামি হয়েছে।

নিহতের ঘটনায় পরিবার কোনো মামলা করবে কি-না জানতে চাইলে জবাবে আমিনা বলেন, “আমার শ্বশুর গুলিতে মারা গেলেন৷ স্বামী গ্রেপ্তার হইয়া আছে৷ বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই৷ তারাও গ্রেপ্তারের ভয়ে পালাইয়া আছে৷

“এখন মরার শোক করমু নাকি মামলা করমু কিছুই বুঝতে পারতেছি না৷ মামলা করলেই বা কার নামে করমু? মামলা করলেই কি পুলিশ নিব আমাগো মামলা?”

ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে বরগাঁ এসেছেন আবুল কাশেমের বোন মিনারা বেগম৷

Also Read: সোনারগাঁওয়ে র‍্যাবের অভিযানে হামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার ৬

Also Read: সোনারগাঁওয়ে ব়্যাবের অভিযানের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে বৃদ্ধ নিহত

তিনি বলেন, “মরছি মরছি আমরা মরছি৷ আমরা তো তাগো লগে পারমু না৷ তারা আইনের লোক৷ তাগো বিরুদ্ধে ক্যামনে মামলা করমু?”

র‌্যাব জানায়, শুক্রবার সোনারগাঁয়ে এক নারীর গলাকাটা লাশ পাওয়া গিয়েছিল৷ সেই মামলার আসামি মো. সেলিমকে ধরতেই মধ্যরাতে বরগাঁ এলাকায় অভিযান চালানো হয়। অভিযানে গিয়ে তারা আক্রান্ত হয়েছিলেন।

অভিযানে থাকা র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তানভীর মাহমুদ পাশা বলেছিলেন, “আমরা আসামিকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে আসার সময় কিছু দুষ্কৃতকারী আসামিকে ছিনিয়ে নিতে আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে ব়্যাবের ওপর হামলা করে, গুলি করে৷ তখন আত্মরক্ষার্থে র‌্যাব সদস্যরা পাল্টা গুলি ছুড়ে আসামিকে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে আসে ব়্যাব। পরে সকালে নিউজ পেয়েছি যে, একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন এবং একজন আহত আছেন।”

অভিযানে চার র‌্যাব সদস্যও আহত হয়েছেন বলে জানান কমান্ডার পাশা। তবে তাদের কেউ গুলিবিদ্ধ নন।

ঘটনার দুই ঘণ্টা পর র‍্যাব ওই এলাকায় ফের অভিযান চালিয়ে ২০ জনকে আটক করে। তাদের মধ্যে ১৫ জনকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের জিম্মায় শনিবার সন্ধ্যায় ছেড়ে দিয়ে বাকি পাঁচজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

প্রায় ১৮ ঘণ্টা হেফাজত থেকে যারা বাড়ি ফিরেছেন রোববার তারাও জানালেন উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কের কথা।

জামদানি কারিগর নূর হোসেনের বাড়ি নিহত আবুল কাশেমের বাড়ির পাশেই৷ তিনিও ব়্যাবের হেফাজত থেকে বাড়ি ফিরেছেন।

নূর হোসেন বলেন, “ডাকাত পড়ছে শুইন্যা ঘুম থেকে উঠি৷ পরে জানতে পারি, পাশের বাড়ির কাশেম চাচা গুলিতে মারা গেছেন৷ পরে আবারও বাসায় আইসা ঘুমিয়ে পড়ি৷ এরও দেড়-দুই ঘণ্টা পর ব়্যাব আবারও আসে৷ পরে অনেকরে ধইর‌্যা নেয়৷ অনেকরে মারধরও করে তখন৷ এগুলা দেইখা আমি আর নড়াচড়া করি নাই৷ পরে আমারেও ধইর‌্যা নেয়৷”

“ভোর পর্যন্ত গ্রামের পাশে একটি বালুর মাঠে রাখে৷ পরে আদমজীতে ব়্যাব-১১ এর ক্যাম্পে নেন৷ ওইখানে আমাগো ২০ জনরে একলগে একটা হাজতের মইধ্যে রাখে৷ আমাগোরে ৭-৮ জন একেকবার আইসা জেরা করে৷ আমাদের বক্তব্য ভিডিও করে৷ এরপর সন্ধ্যার দিকে এলাকার সাবেক এমপি (আব্দুল্লাহ আল কায়সার হাসনাত) ও আওয়ামী লীগের নেতাগো জিম্মায় আমাদের ছাড়ে৷ তাগো দুইটা গাড়িতেই আমরা ১৫ জন আসি৷ বাকি কাশেম চাচার পোলাসহ পাঁচজনকে ছাড়ে নাই৷”

নূর হোসেন বলেন, “কখনও জেলে যাইনি৷ আমরা কামের মানুষ৷ কাম না করলে ভাত হয় না৷ ব়্যাবের কাছে থাকাবস্থায় ভয় পাইছি৷”

নূর হোসেনের স্ত্রী রুবিনা বলেন, “আমার স্বামীরে অন্যায়ভাবে ধরে নিছিলো৷ হ্যায় তো কোনো অপরাধ করে নাই৷ সারাক্ষণ চিন্তা করছি, আত্মীয়-স্বজন হেরে তারে কল দিছি৷ কোনো কারণ ছাড়াই রাইত-বেরাইতে ধইরা নেওয়া, এইটা গরিব মানুষের লগে অন্যায় কাজ৷”

ব়্যাব ওই রাতে হেফাজতে নিয়েছিল ১৪ বছর বয়সী কিশোর মো. রাব্বিকেও৷ তার মা রাত ও সারাদিন ছিলেন ছেলেকে নিয়ে উৎকণ্ঠায়৷

রাব্বির মা রাবেয়া বলেন, “প্রতিটা সেকেন্ড কষ্টে কাটছে৷ একজন মানুষ মাইরা ফেলছে৷ পোলাডারে কী করে না করে তার ঠিক নাই৷ আমি গরিব মানুষ, আগে-পরে কিছু নাই৷ আমার পোলাডারে নিছে, সারাক্ষণ চিন্তায় ছিলাম৷ আমার পোলাডায় যে বাইর আইছে এইডায় আলহামদুলিল্লাহ৷”

তিন সন্তানের বড় রাব্বি৷ কাঁচপুরে নানার বাড়িতে থেকে সেখানে জামদানি তৈরির কাজ শেখে৷ সপ্তাহে শুক্রবার বাড়িতে আসে, বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকে আবার শনিবার চলে যায়৷

রাব্বির মা বলেন, “সপ্তাহে একটা দিন বাড়িত আহে পোলাডায়৷ কপালের শনি ওইরাতেই হইছে৷ পোলাডারে নেওয়ার সময় পায়ে ব়্যাব দুইটা বাড়ি মারছে লাঠি দিয়া৷ ফেরার পর রাতে ব্যাথার ওষুধ খাওয়াইছি৷ কী না কী ঝামেলা হয় নানার বাড়িতে পাঠাইয়া দিছি৷”