সোনারগাঁওয়ে ব়্যাবের অভিযানের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে বৃদ্ধ নিহত

গ্রামবাসী বলছে, কালো পোশাকের র‌্যাব সদস্যরা এসেছিল সাদা পোশাকে, ছুড়েছিল গুলি। র‌্যাব বলেছে, আক্রান্ত হয়ে তাদের গুলি ছুড়তে হয়েছিল।

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 March 2023, 09:54 AM
Updated : 18 March 2023, 09:54 AM

খুনের মামলার আসামি গ্রেপ্তারে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে র‌্যাবের অভিযানের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন এক বৃদ্ধ।

পুলিশ বলছে, অভিযানে যাওয়া র‌্যাব সদস্যদের স্থানীয়রা বাধা দিলে সেখানে সংঘর্ষ হয়। তখন দুই পক্ষই গুলি ছুড়েছিল।

র‌্যাবের গুলিতেই ওই বৃদ্ধ মারা গেছেন বলে দাবি করেছেন তার স্ত্রী। র‌্যাব দাবি করেছে, তারা আক্রান্ত হওয়ায় পাল্টা গুলি ছুড়েছিল।

শনিবার প্রথম প্রহরে (রাত সাড়ে ১২টা) সোনারগাঁও উপজেলার সাদিপুর ইউনিয়নের বরগাঁ এলাকায় এ ঘটনা বলে এলাকাবাসী, র‌্যাব ও পুলিশে কাছ থেকে জানা গেছে।

নিহত আবুল কাশেম (৬৫) ওই এলাকার প্রয়াত কদম আলীর ছেলে। হুমায়ূন কবির (৫০) নামে গুলিবিদ্ধ আরেকজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি ওই এলাকার প্রয়াত ছদরুদ্দিন ভূঁইয়ার ছেলে৷

স্থানীয়রা জানায়, গত রাতে গ্রামে ডাকাত পড়েছে শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলে সাদা পোশাকে থাকা ব়্যাবের সদস্যরা তাদের গুলি চালায়৷

সেখানে র‌্যাবের সঙ্গে সংঘর্ষের খবর দিলেও অভিযানের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু পুলিশ জানাতে পারেনি। র‌্যাব বলছে, এক আসামিকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালিয়েছিল তারা। 

তবে নিহত কিংবা আহত ব্যক্তি অপরাধী, এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

গুলিতে হতাহত

সোনারগাঁ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আহসান উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আবুল কাশেমের স্বজনরাই লাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসে। খবর পেয়ে ভোরে পুলিশ সেখানে যায়।

তিনি বলেন, “নিহতের পেটের দিকে গুলির আঘাতের চিহ্ন রয়েছে৷ ঘটনা কী ঘটেছে, তা বিস্তারিত ব়্যাব বলতে পারবে।”

সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘রাত ৩টা ১০ মিনিটে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ওই বৃদ্ধকে হাসাপাতালে নিয়ে আসেন৷ তাকে পরীক্ষা করে জানা যায়, আগেই তার মৃত্যু হয়েছে৷ তার নাভির উপরে একটি বুলেটের চিহ্ন আছে।”

হুমায়ূন কবির গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছেন বলে জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া৷ তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্বজনরাই তাকে রাতে হাসপাতালে নিয়ে আসে।

‘ডাকাত ভেবে’ প্রতিরোধ

গ্রামবাসী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাতে ‘ডাকাত পড়ছে’ শোর শুনে তারা বেরিয়েছিলেন। সাদা পোশাকে থাকা র‌্যাব সদস্যদের তারা চিনতে পারেননি।

নিহত আবুল কাশেম একজন বাঁশ ও বেতের হস্তশিল্পী। তার পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তার বাড়ির পাশেই চলে অভিযান।

কাশেমের স্ত্রী রমিজা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মধ্যরাতে তিনি ও তার স্বামী বাড়ির পাশে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি শুনতে পান। পরে তারা এগিয়ে গিয়ে দেখেন, শার্ট ও গেঞ্জি পরা একদল লোক তাদের পরিচিত গার্মেন্টস শ্রমিক সেলিমকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সেলিম তখন কাঁদছিলেন।

ওই ব্যক্তিরা যে র‌্যাব সদস্য, তা জানতেন না দাবি করে রমিজা বলেন, “আমার স্বামী এইটা দেইখা সামনে গিয়া কেন সেলিমরে ধইরা নিতাছে, তা জানতে চায়৷ তখন তারা লাঠি দিয়া আমার স্বামীরে মারে৷ হ্যায় তখন তাগোরে গালাগালি করতে থাকে। তখন একজন নিজেদের ব়্যাব পরিচয় দিয়া পেটের মধ্যে গুলি করে।”

আহত হুমায়ূন কবিরের স্থানীয় বাজারে একটি ওষুধের দোকান আছে৷ তার দুই ছেলে এবং তিন মেয়ে৷ রাতে গুলির শব্দ পেয়ে তিনিও বেরিয়েছিলেন। তার বাঁ পায়ে দুটি এবং ডান পায়ে একটি গুলি লেগেছে৷

হুমায়ূনের পরিবারের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রথমে তো বোঝে নাই যে তারা ডিবি না ব়্যাবের সদস্য৷ ওইটা জানলে তো আর যাইত না।

“ব়্যাব নাকি সেলিমরে একটা মার্ডার মামলায় ধরতে আইছিল৷ লোকজন ভাবছে ডাকাইত পড়ছে গ্রামে৷ ছয়-সাতটা গুলি চলছে৷ ব়্যাব মাইরা থুইয়া যাবার পর একটা মোটরসাইকেল সেইখানে পইড়া ছিল। ওই মোটরসাইকেল নিতে পরে রাত দুইটার পর চাইর-পাঁচটা গাড়িভর্তি পুলিশ আসে৷ তারা কয়েকটা ঘর ভাঙচুর কইরা গ্রামের অন্তত ২২ জনরে ধইরা নিয়া যায়।”

পুলিশ বলছে, তারা কিছু করেনি

এই ঘটনায় নিজেদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এটা ছিল র‌্যাবের অভিযান। পুলিশ কাউকে আটকও করেনি।

নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, “জানতে পেরেছি, শুক্রবার দিবাগত রাত আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে সোনারগাঁয়ে ব়্যাব-১১ এর একটি দল আসামি গ্রেপ্তারের জন্য যায়৷

“আসামি গ্রেপ্তার করে ফেরার পথে কিছু দুষ্কৃতকারী আসামিকে ছিনিয়ে নিতে ব়্যাবের উপর আক্রমণ করে৷ তখন দুষ্কৃতকারীদের আক্রমণে ব়্যাবের সদস্যরা আহত হয়৷ ব়্যাবের উপরে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করে বলেও জানতে পেরেছি৷ আত্মরক্ষার্থে ব়্যাব সদস্যরা পাল্টা গুলি করলে তাদের মধ্যে একটা সংঘর্ষ হয়।”

‘দুষ্কৃতকারীরা’ পালিয়ে গেলে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পায় জানিয়ে এসপি বলেন, “তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সে মারা যায়।”

ব়্যাবের দুজন সদস্যও গুরুতর আহত হয়েছেন জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা রাসেল বলেন, তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এ ঘটনায় ব়্যাব মামলা করবে জানিয়ে তিনি বলেন, “মামলার পর পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

২২ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সোনারগাঁও থানার পরিদর্শক আহসান উল্লাহ বলেন, “পুলিশ কাউকে আটক করেনি৷ ওইখানে ব়্যাবের অভিযান ছিল, পুলিশ কিছু করেনি।”

আক্রান্ত হওয়ায় গুলিবর্ষণ: র‌্যাব

অভিযানে যাওয়া র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তানভীর মাহমুদ পাশা বলছেন, খুনের আসামি গ্রেপ্তারে তারা অভিযানে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত শুক্রবার সোনারগাঁওয়ে এক নারীর গলাকাটা লাশ উদ্ধার পাওয়া গিয়েছিল৷ সেই হত্যাকারীকে আমরা শনাক্ত করি এবং সেই আসামি সেলিমকে ধরতেই সোনারগাঁয়ের বরগাঁ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ব়্যাব।

“আমরা আসামিকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে আসার সময় কিছু দুষ্কৃতকারী আসামিকে ছিনিয়ে নিতে আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে ব়্যাবের উপর হামলা করে, গুলি করে৷ তখন আত্মরক্ষার্থে র‌্যাব সদস্যরা পাল্টা গুলি ছুড়ে আসামিকে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে আসে ব়্যাব। ওই সময় কেউ হতাহত হয়েছেন কি না, আমরা জানি না৷ পরে সকালে নিউজ পেয়েছি যে একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন৷ এবং একজন আহত আছেন।”

চারজন র‌্যাব সদস্য আহত হয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা গুরুতর৷ তবে তারা গুলিবিদ্ধ নন, তাদের একজনের মাথার খুলিতে গভীর ক্ষত হয়েছে৷ তিনি পিলখানায় বিজিবি হাসপাতালে ভর্তি আছেন৷

সাদা পোশাকে অভিযানের বিষয়ে র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক তানভীর বলেন, “আমরা সর্বপ্রথম গিয়েছিলাম, ব়্যাব পরিচয় দেয়নি, এটা আসামিদের এক্সকিউজ৷ আমাদের পরে ডিবি ও জেলা পুলিশও গিয়েছিল৷ সকলেই জানে এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হত্যা মামলার আসামিকে ধরতে গিয়েছিল৷ তাকে ছিনিয়ে নিতেই স্বজনরা আমাদের উপর হামলা করে।”

কয়েকজনকে আটকের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, “যেহেতু ব়্যাবের উপর হামলা হয়েছে, সেহেতু আমরা পরে হামলাকারীদের কয়েকজনকে শনাক্ত করতে পেরে তাদের আটক করে নিয়ে এসেছি৷

“তবে ২০ জনই অ্যারেস্টেড না। আমরা যাদের কনফার্ম করতে পেরেছি, তাদের অ্যারেস্ট করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদ ও যাচাই-বাছাই চলছে৷ সন্ধ্যা নাগাদ যখন মামলা হবে, তখন নিশ্চিত করে অ্যারেস্টের সংখ্যাটা বলতে পারব।”