জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুই বিভাগের হিসাবে প্রায় দেড় বছরে লাগানো হয়েছে মাত্র আট হাজার বৃক্ষ।
Published : 02 Mar 2025, 09:41 AM
জলবায়ুর ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে হাওর জেলা সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলায় প্রায় ৭৯ হাজার বৃক্ষ রোপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে নেওয়া প্রকল্পটির আওতায় বনায়নের জন্য বাছাই করা হয়েছে শাল্লা উপজেলার বাহাড়া ইউনিয়নের মেদা-মুসাপুর গ্রামের রাস্তাটিও।
বৃহস্পতিবার ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কুশিয়ারা নদীর তীরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত বাঁধটিই এখন সড়কে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু নদী তীর ধরে সবুজ মাঠের বুক চিরে চলে যাওয়া মেঠো সড়কটির দুপাশে ঘাস ছাড়া দেখা মেলেনি আর কোনো বৃক্ষের।
মুসাপুর গ্রামের কৃষক রাজীব বৈষ্ণব বলেন, “আমাদের বাঁধ ও সড়কটি গাছ লাগানোর জন্য উপযুক্ত। নদীর তীরে হওয়ায় গাছ লাগালে ভাঙন প্রতিরোধেও কাজ করতো। শুনেছি, পাউবো এখানে গাছ লাগাবে। কিন্তু এখনও তারা একটি গাছও লাগায়নি।”
অথচ শাল্লা উপজেলায় বৃক্ষ রোপণের দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো বিভাগ-২) জানিয়েছে, জায়গা সংকটের কারণে তারা বৃক্ষ লাগাতে পারছে না।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বন্যা সহায়তা পুনর্নির্মাণ জরুরি প্রকল্পে (এফআরইএপি) জেলার স্থায়ী ফসলরক্ষা বাঁধ, নদী ভাঙন প্রতিরোধ ও বৃক্ষ রোপণের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)।
হাওরকে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বনায়নের জন্য এ সহায়তা প্রকল্পে ১২ উপজেলায় প্রায় ৭৯ হাজার বৃক্ষ রোপনের কথা। যার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় দুই কোটি ৮১ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এই প্রকল্পে স্থায়ী ফসল রক্ষা বাঁধ, সরকারি সড়ক, সরকারি খাস ভূমিসহ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হাওরের জলসহিষ্ণু বৃক্ষ হিজল-কড়চ রোপণের নির্দেশনা রয়েছে।
হাওরের জলাবন হিসাবে পরিচিত হিজল-কড়চকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও বিশেষ কিছু এলাকায় জায়গার সংকট হলে অন্যান্য ফলজ ও বনজ বৃক্ষও লাগানোর নির্দেশনা আছে।
প্রকল্পের আওতায় চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে প্রায় ৭৯ হাজার বৃক্ষ রোপণ শেষ করার কথা থাকলেও জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুই বিভাগের হিসাবে প্রায় দেড় বছরে লাগানো হয়েছে মাত্র আট হাজার বৃক্ষ।
বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে পাউবো বিভাগ-১ ছয়টি উপজেলায় এক কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয়ে ৪২ হাজার বৃক্ষ লাগানোর কথা। বিভাগ-১ এ সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা ও মধ্যনগর উপজেলা অবস্থিত।
তবে সংশ্লিষ্ট এলাকায় এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচ হাজার বৃক্ষ রোপণ করতে পেরেছে পাউবো বিভাগ-১। তবে উপযুক্ত মৌসুম ছাড়া রোপণ করায় অধিকাংশ বৃক্ষই বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না।
অন্যদিকে পাউবো বিভাগ-২ প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে ছয়টি উপজেলায় ৩৭ হাজার বৃক্ষ লাগানোর কথা। বিভাগ-২ এর অধীনে দিরাই, শাল্লা, জগন্নাথপুর, শান্তিগঞ্জ, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার অবস্থান।
এ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তারা এখন পর্যন্ত মাত্র তিন হাজার বৃক্ষ লাগিয়েছেন। জায়গা সংকটের কারণে বৃক্ষ লাগাতে বিলম্ব হচ্ছে। এই বৃক্ষ লাগানোর যুতসই জায়গা তারা খুঁজে পাচ্ছেন না।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-২ ইমদাদুল হক বলেন, “আমরা বৃক্ষ লাগানোর পর্যাপ্ত জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না। যে কারণে বিলম্ব হচ্ছে।”
২০২৫ সালের জুন মাসে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সব বৃক্ষ লাগানো সম্ভব হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, “সময় বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হবে।”
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-১ মামুন হাওলাদার বলেন, “বৃক্ষ লাগানোর জন্য আমার বিভাগে জায়গার সমস্যা নেই। সমস্যা হলো মৌসুমের। এখন বৃক্ষ লাগানোর মৌসুম নয়। যে কারণে বিলম্ব হচ্ছে।”
তবে নির্দিষ্ট অর্থবছরে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না বলে জানান তিনিও।
শাল্লা উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেকশন অফিসার মো. রিপন আলী বলেন, “গাছ লাগানোর জন্য আমরা ফয়জুল্লাহপুর, মেদা-মুসাপুরসহ কিছু আবুরা রাস্তা বাছাই করেছি। এ ছাড়া সাবমারসিবল সড়কের দুই পাশেও হিজল-কড়চ লাগানোর জন্য স্থান নির্বাচন করেছি। তবে এখনো গাছ লাগানো শুরু হয়নি।”
অন্যদিকে মৌসুম ছাড়া যেসব বৃক্ষ লাগানো হচ্ছে তাও বাঁচানো সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন পরিবেশকর্মীরা।
এ ছাড়া লাগানোর পর ছয় মাস বৃক্ষ বেঁচে থাকলে তবেই ঠিকাদার বিল পাওয়ার কথা। কিন্তু এখানেও সঠিক নজরদারি হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে বলে পরিবেশকর্মীরা জানান।
সুনামগঞ্জ হাওর উন্নয়ন সংসদের (হাউস) নির্বাহী পরিচালক সালেহীন চৌধুরী শুভ বলেন, “ভুল সময়ে ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতিতে রোপণ করায় ফসল রক্ষা বাঁধে এসব বৃক্ষ বাঁচার সম্ভাবনা নেই। এর আগেও অন্যান্য প্রকল্পে তারা বৃক্ষ লাগিয়েছিল। কোথাও বৃক্ষ বাঁচেনি।”
তিনি বলেন, “চারা লাগিয়ে কেবল দায় সারলেই হবে না, পরবর্তীতে গাছের পরিচর্চাও করতে হবে। অন্যথায় প্রতিবছরই সরকারি তহবিলের অপচয় হবে।”
সুনামগঞ্জ জেলা পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সহসভাপতি সাইফুল আলম সদরুল বলেন, “হাওরে কান্দাসহ (তীর) প্রচুর খাস জমি রয়েছে। যেখানে সহজে হাওরের জলজ উদ্ভিদ হিজল-কড়চ লাগানো যাবে।
“জায়গা সংকটের কারণে বৃক্ষ লাগাতে বিলম্ব হচ্ছে- এটা ঠিক না। তবে লাগানোর পর নজরদারি বা পরিচর্যা না করলে কেনো বৃক্ষই বাঁচানো সম্ভব হবে না।”
শাল্লা উপজেলার কৃষকদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আকরামুল হক বলেন, “বৃক্ষ লাগানোর মতো শাল্লায় জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি খাস জায়গা রয়েছে। তবে আমাদের এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বৃক্ষ লাগানোর চিত্র চোখে পড়েনি।”
তিনি বলেন, “বৃক্ষ রোপণের এ প্রকল্পে স্থানীয়দের সংযুক্ত করলে সফলতা আসবে। হাওরের প্রাণ ও প্রতিবেশ সুরক্ষিত হবে। যা জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে।”