Published : 24 Feb 2025, 09:28 AM
উঁচু-রুক্ষ বরেন্দ্র অঞ্চলের চিহ্নিত পানিসংকট পূর্ণ এলাকায় এবার চাষিদের বোরো আবাদে নিরুৎসাহিত করেছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। তাতে সাড়া দিয়ে এ বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে কমেছে বোরো চাষাবাদ।
ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব এলাকায় কৃষকদেরকে স্বল্প সেচের অন্যান্য ফসল উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। ফলে এবার এ অঞ্চলে রবিশস্যের আবাদ বেড়েছে।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চাঁপাইনবাবগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুনুর রশিদ বলেন, “আমাদের এ অনুরোধে কৃষকরা ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছেন। এ বছর ৮ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। গত বছর আবাদ হয়েছিল ১৫ হাজার ২৭৫ হেক্টর জমিতে।”
তিনি বলেন, “জেলা জুড়ে বিএমডিএর ১ হাজার ৬৫০টি গভীর নলকূপ রয়েছে। এরমধ্যে রুক্ষ বরেন্দ্র অঞ্চলের চিহ্নিত 'পানি সংকটপূর্ণ' এলাকায় আছে ৭১৫টি গভীর নলকূপ। এই নলকূপের সেচ প্রকল্পের আওতায় থাকা কৃষককে এবার বোরো আবাদ না করার অনুরোধ জানান হয়েছে।”
'পানি সংকটপূর্ণ' এই এলাকার মধ্যে আছে সদর উপজেলার আমনূরা এলাকা, নাচোল উপজেলার অধিকাংশ এলাকা ও গোমস্তাপুরের উপজেলার কিছু অংশ।
প্রকৌশলী মামুনুর রশিদ আরও বলেন, এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১ কেজি বোরো ধান উৎপাদনে, ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ লিটার পানি খরচ হয়। তার জন্য এ অঞ্চলের চাষিদের পুরোটাই গভীর নলকূপের সেচের ওপর নির্ভর করতে হয়। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়াসহ পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে।
‘পানির অপর নাম জীবন’- একথা মনে রেখে পানি সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবহারে সবার সহযোগিতা কামনা করেন এ প্রকৌশলী।
ক্ষতির মুখে বীজের চারা উৎপাদনকারীরা
এদিকে চাষাবাদ কমে যাওয়ায় কমে গেছে বোরো ধানের বীজের চারার চাহিদাও। গত বছরের তুলনায় দামও নেমে এসেছে অর্ধেকে। এই দরপতনে আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বীজের চারা উৎপাদনকারী চাষীরা।
তারা বলছেন, আগে থেকে জানলে তারা এ বছর সেভাবে প্রস্তুতি নিতে পারতেন, ফলে তাদের এভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে হত না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের একমাত্র বোরো বীজের চারার বাজার আমনুরা-শিমুলতলায় চারা বিক্রি করতে আসা শহিদুল ইসলাম বলেন, “আড়াই বিঘা জমিতে বিছন (বীজের চারা) করেছি। প্রতি বিঘা জমিতে চার মণ ধান, সার ও পানি বাবদ খরচ হয়েছে বারো হাজার টাকা। বিঘাতে ৩০-৩৫ পণ চারা হয়।”
রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার আতা নারায়ণপুর গ্রামের এই চাষি বলেন, “এক বিঘা চারা বিক্রি করে পাঁচ হাজার ২০০ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা পাচ্ছি। লাভ তো দূরের কথা, বিঘাতে লস হচ্ছে সাত হাজার টাকা।”
আমনুরা-শিমুলতলা বাজারটি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত দুমাস বসে। পার্শ্ববর্তী জেলা রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকা থেকে চারা বিক্রি করতে আসেন উৎপাদনকারী চাষীরা।
আর ক্রেতা বরেন্দ্র এলাকাসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা বোরো আবাদে আগ্রহী চাষীরা। ভরা মৌসুমে সকাল থেকে সন্ধ্যা রাত পর্যন্ত চলে কেনা বেচা।
তবে বৃহস্পতিবার বিকালে এই বাজার ঘুরে বীজ চারা বিক্রি করতে আসা চাষিদের মুখে শুধু হতাশার কথাই শোনা গেল।
চারা বিক্রি করতে আসা রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার ঘাসিগ্রাম এলাকার মো. কুরবান আলী বলেন, “এই বছর বোরো আবাদ কম, চারার চাহিদাও কম। দেড়শো-একশো ষাট টাকা পণ চারা বিক্রি করতে হচ্ছে। গত বছর এই চারার দাম ছিল তিনশ-চারশ টাকা। এবার বোরো চারার দাম নেমে এসেছে অর্ধেকে।”
দশ কাঠা জমিতে বোরো আবাদের জন্য চারা কিনতে এসেছেন নাচোলের আহুরা এলাকার আমিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, “এক বিঘা বোরো লাগাতে তিন থেকে চার পণ চারা লাগে। দশ কাঠা জমিতে লাগানোর জন্য দুই পণ চারা কিনেছি তিনশ' কুড়ি টাকায়। এত কম দামে চারা পাব ভাবতেই পারিনি।”
নাচোল উপজেলার নেজামপুর এলাকার রমজান আলী বলেন, তার সাত বিঘা জমি আছে। আগে এ জমিতে পুরোটাই বোরের চাষ করতেন। কিন্তু এবার মাত্র দুই বিঘায় বোরো চাষ করছেন। বাকি পাঁচ বিঘায় অন্যান্য ফসলের চাষাবাদ করেছেন।
কারণ হিসাবে তিনি বলেন, এবার গভীর নলকূপের সেচ প্রকল্পের আওতায় বোরো চাষ সীমিত করার নির্দেশনা দিয়েছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। তাই বাজারে বেরো চারার দাম কম হলেও বিএমডিএর নির্দেশনা মেনে কম জমিতে বোরোর চাষ করছেন।
বেড়েছে রবিশস্যর চাষ, লাভবান হবে কৃষকরা
এদিকে বোরো আবাদ কমে যাওয়ায় বিএমডিএর সেচ প্রকল্পের আওতাধীন এলাকায় স্বল্প সেচে রবিশস্য সহ অন্যান্য ফসলের আবাদ বেড়েছে বলে জানান বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চাঁপাইনবাবগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুনুর রশিদ ।
বিএমডিএর তথ্য মতে- গত বছর ৭৯৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হলেও এ বছর হয়েছে ৯২০ হেক্টরে। গম চাষ হয়েছিল ১ হাজার ১৫৫ হেক্টরে; এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৭৯৫ হেক্টরে। আলু চাষ ছিল ৭৫৫ হেক্টর; এ বছর চাষ হয়েছে ১২ হাজার ৭৫ হেক্টর জমিতে।
এছাড়া গতবছর সরিষার আবাদ ছিল ১৪ হাজার ৭০০ হেক্টর; এ বছর চাষ হয়েছে ১৪ হাজার ৪০০ হেক্টরে। মসুরের আবাদ হয়েছিল ৮১৫ হেক্টর; এ বছর হয়েছে ৫৬৫ হেক্টর এবং অন্যান্য চাষাবাদ হয়েছিল ৫ হাজার ৫০ হেক্টর; এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২৭৫ হেক্টরে।
তবে বরেন্দ্র এলাকায় বোরো চাষ কমায় দেশের ধানের উৎপাদনের কোনো প্রভাব পড়বে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডক্টর পলাশ সরকার বলেন, “কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দশ-বারো বছর আগে থেকেই একুশ থেকে ত্রিশ সেচের ফসল উৎপাদনে নিষেধ করে আসছে। পানি সংকট মোকাবেলায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সেচে বোরো আবাদ কমানোর উদ্যোগ আরও আগে নেওয়া দরকার ছিল।”
তিনি আরও বলেন, “বরেন্দ্র এলাকার এসব জমিতে বোরো আবাদ সুইচ করে ডাল, গম, ভুট্টা, তৈল জাতীয় ফসল উৎপাদন হচ্ছে। এ সবই অর্থকরী ফসল। ডাল, গম, সরিষা এ জাতীয় যে ফসলের উৎপাদন বাড়বে; সেই ফসলের আমদানি নির্ভরতা কমবে।”
পরিবর্তিত এসব ফসল উৎপাদনের মধ্যদিয়ে কৃষকরা ব্যাপকভাবে লাভবান হবে জানিয়ে তিনি বলেন, অর্থকরী ফসল উৎপাদনের মাধ্যমেও কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তা বজায় থাকবে। তবে এক বছর আগে থেকে কৃষকদের বোরো আবাদ না করার নির্দেশনা দেওয়া হলে তারা মানসিকভাবে প্রস্তুতির সময় পেত।