তিন দশক ধরে লাঙ্গলের বাঁধাধরা এ আসনের ভোট জমেছে নতুন হিসাব-নিকাশে; ত্রিমুখী প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়েছেন তিনবারের এমপি রাঙ্গাঁ।
Published : 02 Jan 2024, 04:51 PM
প্রথমবারের মতো লাঙ্গল ছেড়ে ট্রাক নিয়ে নির্বাচন করছেন বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ। রাজনীতির মারপ্যাচে ভোটের মাঠে যেমন নিজ দলের বাইরে ছিটকে পড়েছেন, তেমনি স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা উঠে পড়ে লেগেছেন ‘স্থানীয় বাসিন্দার’ বিষয়টি সামনে এনে তাকে কোনঠাসা করার চেষ্টায়।
রংপুর-১ এর এ আসন থেকে তিনবার নির্বাচিত এই সংসদ সদস্যের জন্য যে কারণে এবারের নির্বাচন আর আগেরগুলোর মতো নির্ভেজাল নেই। জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর রওশনপন্থি নেতা রাঙ্গাঁ এমনিতেই স্বস্তিতে ছিলেন না; দলের মনোনয়ন না পেয়ে হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আরেক স্বতন্ত্র কেটলি প্রতীকের প্রার্থী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার প্রতিযোগিতার।
এতে করে তিন দশক ধরে লাঙ্গলের বাঁধাধরা এ আসনের ভোট জমতে শুরু করেছে; ত্রিমুখী প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়েছেন তিনবারের এমপি রাঙ্গাঁ।
জাতীয় পার্টির লাঙ্গলকে আসন সমঝোতার অংশ হিসেবে উত্তরের এ আসন ছেড়ে দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। রাঙ্গাঁর বদলে জাতীয় পার্টি মনোনয়ন দেয় এরশাদের ভাতিজা, এ আসনেরই সাবেক সংসদ সদস্য হুসেইন মকবুল শাহরিয়ার আসিফকে।
তবে নৌকার প্রার্থী না থাকলেও স্বতন্ত্র হওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত থাকায় ভোটে জোরেশোরে নেমেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবলু; যিনি আলোচনায় থাকা তিন প্রার্থীর মধ্যে একমাত্র স্থানীয়।
রংপুর নগরী থেকে কিছুটা দূরের গংগাচড়া ও সিটি করপোরেশনের আটটি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এ আসনে জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব রাঙ্গাঁ ও জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান আসিফ উভয়েই দূরের বাসিন্দা, তারা থাকেন শহরে।
এরশাদের লাঙ্গলের সুবাদে এ দুই নেতাই জাতীয় পার্টির হয়ে আগে সংসদ সংসদ হয়েছেন। তবে লাঙ্গলের প্রতি সেই টান ক্রমেই কমে আসায় আশাবাদী হয়ে উঠছেন আওয়ামী লীগ নেতা বাবলু। একই সঙ্গে 'স্থানীয় বাসিন্দার বিষয়টি' মাঠে এনে বেশ বেকায়দায় ফেলে দিয়েছেন রাঙ্গাঁকে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-১ আসনে চার স্বতন্ত্রসহ মোট নয়জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ভোটারদের আলোচনায় তাদের মধ্যে এ তিনজনই রয়েছেন ‘হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের’ তালিকায়।
১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সবগুলো সংসদ নির্বাচনে এ আসন বরাবরই জাতীয় পার্টির দখলে। এবার আসনটির নির্বাচনি এলাকায় (গংগাচড়া উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের ১ থেকে ৮ নম্বর ওয়ার্ড) বসবাস করেন এমন কোনো নেতাকে প্রার্থী করেনি দলটি।
একই সঙ্গে নৌকার প্রার্থী না থাকায় বাবলু গংগাচড়া উপজেলার বাসিন্দা বলে ‘স্থানীয় প্রার্থী’ হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটা অংশের।
সমর্থন নিয়ে দোটানায় নৌকার নেতাকর্মীরা
নিজেদের প্রার্থীর বদলে তা জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়ায় অনেকটা বেকায়দায় পড়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। তবে অধিকাংশই নৌকার মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া গংগাচড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবলুর সঙ্গে প্রচারে নেমেছেন।
এমন হিসাব নিকাশের মধ্যে ভোটের মাঠে আলোচনার গুরুত্বে প্রধান এ তিন প্রার্থী সমানতালে সক্রিয় রয়েছেন। পোস্টার আর প্রচারে কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছেন না। গণসংযোগের পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের পাশে পেতেও তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ তিন প্রার্থী ছাড়াও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির বখতিয়ার হোসেন (হাতুড়ি), তৃণমূল বিএনপির বদরুদ্দোজা চৌধুরী (সোনালী আঁশ), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির হাবিবুর রহমান (আম), বাংলাদেশ কংগ্রেসের শ্যামলী রায় (ডাব), স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মোশারফ হোসেন (মোড়া) এবং শাহীনুর আলম (ঈগল) লড়ছেন।
আগের হিসাব কী বলছে
গত তিন দশকের নির্বাচনি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, পঞ্চম থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবকটিতেই এ আসন জাতীয় পার্টির দখলে ছিল। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধানও ছিল অনেক বেশি। সেনাশাসক থেকে রাজনীতিতে নামা জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও এ আসন থেকে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
রংপুর পৌরসভা ২০১২ সালের মাঝামাঝিতে সিটি করপোরেশনে রূপান্তরিত হয়। তখন নগরীর চৌহদ্দি বাড়ে। পৌরসভার বাইরে থাকা কয়েকটি ইউনিয়ন সিটি করপোরেশনের ভেতরে চলে আসে। সে সময় গংগাচড়া উপজেলার পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের ১ থেকে ৮ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে রংপুর-১ এর সীমানা পুর্নবিন্যাস করা হয়।
এ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৩২ হাজার ৪৬। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৬৭ হাজার ২৪৮, নারী ভোটার ১ লাখ ৬৪ হাজার ৭৯৬ এবং তৃতীয় লিঙ্গের দুজন রয়েছেন।
এরশাদ রংপুর সদরের বাসিন্দা হলেও ১৯৯১ সালে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে এ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন তিনি এটিসহ পাঁচটি আসন থেকে জয়ী হয়েছিলেন। এ আসন ছেড়ে দিলে উপ-নির্বাচনে কাউনিয়ার উপজেলার হারাগাছের শিল্পপতি করিম উদ্দিন ভরসা জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত হন।
এরপর ১৯৯৬ সালে রংপুর সদরের গুপ্তপাড়ার বাসিন্দা সরফুদ্দিন আহম্মেদ ঝন্টু, ২০০১ সালে সদরের বাসিন্দা পরিবহন খাতের নেতা মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ, ২০০৮ সালে এরশাদের ভাতিজা শহরের বাসিন্দা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ লাঙ্গল নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে রাঙ্গাঁ ফের এখান থেকে সংসদ সদস্য হন। রওশন এরশাদপন্থি এ নেতার গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলার ভেলাগুড়ি ইউনিয়নের কাশিমবাজারে। তবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে রাঙ্গাঁ রংপুর-১ আসনের সীমার মধ্যে তার বসবাসের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। যদিও রংপুর শহরেই তিনি বেড়ে উঠেছেন।
‘এবার দেখিশুনি সৎ মানসোক ভোট দেমো’
স্থানীয় প্রার্থীর বিষয়টি ফুটে উঠল কাশিয়াবাড়ী এলাকার দিনমজুর সাদেকুল ইসলামের মন্তব্যে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাবুই হামরা চড় এলাকার মানুষ; হামারগুলার সাথে জায় নিয়মিত যোগাযোগ করমেন হামার সাধারণ মানুষের খোঁজখবর নেন এমন প্রার্থীকে ভোট দিতে চাই।
“অতীতে অন্য এলাকা থেকে আসা প্রার্থী এমপি হওয়ায় দুঃখ-দুর্দশায় তাদের কখনো পাশে পাইনি। কাছে যেতে পারিনি, কথা বলারও সুযোগ পাইনি।”
উপজেলার বেতগাড়ী বাজারে আবুল কাশেম বলেন, “আমাদের এই দিকে বাবলু ছাড়া কিছুই নেই। বাবলুর ভোটাররা মাঠে লাফালাফি করে না। ভোটের দিন তারা দেখিয়ে দেবে বাবলু কত জনপ্রিয়।”
তার প্রতিদ্বন্দ্বী কে হতে পারেন-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “রাঙ্গাঁ এলাকায় কিছুটা উন্নয়ন করেছেন, তাই তিনি এবার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন; তবে জয়ী হওয়ার মতো নয়।”
গংগাচড়া উপজেলা চত্বরে কথা হয় মোখলেছুর নামের এক ভোটারের সঙ্গে। তিনি বলেন, “নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে রাঙ্গাঁ না বাবলু, কে বিজয়ী হবেন; এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে বোঝা যাচ্ছে না। তবে এই দুজনের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে এবার।”
আলমবিদিতর ইউনিয়নের বাসিন্দা ফজলুর রহমান রাফি বলেন, “ভোটে যদি কোনো কারচুপি না হয় তাহলে কেটলি প্রতীকের প্রার্থী আসাদুজ্জামান বাবলু বিপুল ভোটে জয়ী হবেন। কেননা এ উপজেলায় অন্য দলগুলোতে ভালো কোনো প্রার্থী নেই।
“বিশেষ করে স্থানীয় প্রতিনিধির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন ভোটাররা। আর দীর্ঘদিন ধরে এখানে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। এবার জাতীয় পার্টির বিরোধের সুযোগ নেবেন অন্য প্রার্থী।”
বড়বিল ইউনিয়নের বকসিবগঞ্জ বাজারের আনোয়ার হোসেন বলেন, “ভোট আলছে, প্রার্থীরা বাড়ি আসি ভোট চাওছে, কওছো ভোট ওমাক দিলে হামার উন্নতি হইবে। কিন্তু ভোট গেইলে ওমরা ওগলা কথা মনে থোয় না, সগই ভুলে যায়। এবার দেখিশুনি সৎ মানসোক ভোট দেমো।”
মহিপুর হাটে কথা হয় চড় চল্লিমার চড়ের ভোটার রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, “ভোটের আরও কিছু দিন বাকি আছে; দেকি ভাই কাকে ভোট দেওয়া যায়। এখনও কোনো চিন্তাভাবনা করিন নাই।”
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর মহানগর সভাপতি খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রতীকের পাশাপাশি ভোটের মাঠে বড় ফ্যাক্টর হতে পারে স্থানীয় প্রার্থীর ইস্যুটি। প্রার্থীরা ভোটারদের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছেন। বিগত সময় যাদের ভূমিকা জনগণকে নিয়ে ছিল ভোটাররা এবার তাদের দিকেই ঝুঁকছেন।
প্রার্থীরা তাকিয়ে ভোটারদের দিকে
এরশাদের ভাতিজা ও সাবেক সংসদ সদস্য আসিফ জাতীয় পার্টি থেকে এ আসনে ১০ বছর আগে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন পর আবারও দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত হতে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন তিনি। তবে জাতীয় পার্টিতে বিভক্তির কারণে প্রচারে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছেন বলে যদিও দলের লোকজন বলছেন।
রংপুর জেলাকে জাতীয় পার্টির ঘাঁটি দাবি করে লাঙ্গলের এই প্রার্থী বলেন, “এর আগে গংগাচড়া থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। আবারও দলের প্রার্থী হয়েছি। গংগাচড়ার মানুষ লাঙ্গল প্রিয়।
“তারা আবারও লাঙ্গল মার্কায় ভোট দিয়ে আমাকে নির্বাচিত করবেন। মানুষ আগের মতো আর ভুল করবে না। জনগণের ভোটে যদি নির্বাচিত হতে পারি তাহলে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখব।”
জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব ট্রাক প্রতীকের প্রার্থী রাঙ্গাঁর আশা আগের মতো এবারও গংগাচড়ার মানুষ তাকে পছন্দ করে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন। ভোট সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে বলেও মনে করছেন তিনি।
তিনি বলেন, “ভোটের মধ্যদিয়ে নির্বাচিত হয়ে প্রমাণ করে দেব, জনগণ আবারও আমাকে চায়। এখানে ভোট ডাকাতির কোনো সুযোগ নেই। জনগণ যাকে ভোট দিবে গংগাচড়া দায়িত্ব তিনি পালন করবেন।”
কেটলি প্রতীকের বাবলু বলেন, “রংপুর-১ আসনের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি একজন স্থানীয় সংসদ সদস্য। তারা এবার সেই সুযোগ পেয়েছেন। ৭ জানুয়ারি ভোটের মাধ্যমে তারা বুঝিয়ে দেবে। সে দিনে বুঝতে পারবেন সাধারণ মানুষের মনের কথা।
“গংগাচড়ায় আমার জন্ম। আমি গংগাচড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলাম। আগে যেভাবে জনগণের পাশে ছিলাম এখনও জনগণের পাশে আছি, থাকব।”