সাপেকাটা রোগীর প্রথম ১০০ মিনিট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওঝা বা কবিরাজের কাছে গিয়ে কোনো লাভ নেই। তাদের কাছে কোনো চিকিৎসা নেই; বলছিলেন চিকিৎসক।
Published : 30 Jun 2024, 09:17 AM
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার নুরুল ইসলাম নুহকে এক বছর আগে রাসেলস ভাইপারে কামড় দেওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে ভাল হলেও; এখনও তিনি নানা শারীরিক সমস্যা রয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তবে তিনি এটাও বলছেন, একটু দেরিতে হলেও হাসপাতালে এসেছিলেন বলেই তিনি চিকিৎসকদের সেবায় বেঁচে আছেন।
নুরুল ইসলাম নুহ কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। সেখানকার চিকিৎসক সাপেকাটা রোগী ও স্বজনদের উদ্দেশে বলেছেন, যে সাপেই কামড়াক তাকে অবশ্যই যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে।
সাপেকাটা রোগীর প্রথম ১০০ মিনিট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওঝা বা কবিরাজের কাছে গিয়ে কোনো লাভ নেই। তাদের কাছে কোনো চিকিৎসা নেই। সাপেকাটা রোগীর সময়ক্ষেপণ করার মানে হচ্ছে, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা।
গত দু বছর ধরে পদ্মা অববাহিকা অঞ্চলে চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সাপের উপদ্রব বেড়েছে। এতে মানুষের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। চিকিৎসকদের ভাষায়, বর্ষাকালে এমনিতেই সাপের উপদ্রব বাড়ে; কিন্তু রাসেলস ভাইপারের ব্যাপক মাত্রায় উপস্থিতি এখন ‘আলোচিত ঘটনা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মোট ৮১ জন সাপেকাটা রোগী চিকিৎসা নিতে এসেছেন। গত বছর কয়েকজনের মৃত্যু হলেও এ বছর কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, এ বছর হাসপাতালে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম আছে।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার যুগিয়া দরগাপাড়ার বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব নুরুল ইসলাম নুহকেও রাসেলস ভাইপার সাপে কামড়েছিল গত বছর বোরো মৌসুমে। নুরুল পেশায় মূলত ভ্যানচালক। তবে বাড়িতে গরু-ছাগল আছে। সেই গবাদিপশুর জন্য ঘাস কাটতে গিয়ে তিনি রাসেলস ভাইপারের কামড় খান।
বুধবার বিকালে কুষ্টিয়া জেলা সদরে নুরুল ইসলাম নুহের সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে নুরুল ইসলাম বলছিলেন, দুপুরে প্রতিদিনের মতোই বাড়ির পাশে গরুর জন্য ঘাস কাটতে যান। সেটা ধান কাটার সময়; ফলে আশপাশের ক্ষেতে আরও লোকজন ছিল।
তিনি বলছিলেন, “এক গোছা ঘাস কেটে আরেক গোছা কাটার জন্য সামনে পা ফেলছি। পা-টা গিয়ে একটা ধানের ছড়ার উপর পড়ল। আর তখনি ডান পায়ের আঙ্গুলে (বুড়ো আঙ্গুলের পাশের তর্জনিতে) কামড় বসিয়ে দিল। এক সেকেন্ডও পার হয়নি; পায়ে জ্বালা শুরু হয়ে গেছে। নিচে চেয়ে দেখি সাপে কামড় দিছে। আঙ্গুলে কামড় দিয়ে ধরে সাপ একেবারে উল্টে গেছে।
“আমি পা ঝাড়া দিতেই সাপ গিয়ে ধানের ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে গেল। আমি সেখান থেকে চলে আসলাম। পা কিন্তু জ্বলে যাচ্ছে। পাশে ছোট ভাই ছিল, আরেক ক্ষেতে বাড়ির পাশের আরও দুজন ধান কাটতেছে। আমি তাদেরকে ডেকে বললাম, ওরে আমারে তো সাপে কামড়েছে, মাইট্যা সাপ।”
নুরুল ইসলাম নুহ বলেন, “পরে মনে হল, মাইট্যা সাপই যদি কামড়াবে তাহলে এত জ্বলবে কেন? দেড়-দুই ফুট হবে সাপটা দেখছি, আঙ্গুলের মতো মোটা আর মুখটা বড়। যেহেতু সাপটা উল্টায়ে গেছে বুঝতে পারলাম না ভালভাবে।”
এই অবস্থায় হেঁটেই বাড়ি চলে আসেন নুরুল। বাড়ি এসে পরিবারকে সাপে কামড়ের কথা জানান। প্যান্ট পরা ছিল, বদলে লুঙ্গি পরলেন। বাড়িতে নুরুলের বড় ছেলে ছিল, সে গামছা দিয়ে কামড়ের জায়গাটা বেঁধে দিল।
পরে পাশের চাড়োল এলাকায় পরিচিত এক কবিরাজ (ওঝা) ছিল, তার এখানে নিয়ে যাওয়া হয় নুরুলকে। সন্ধ্যা পর্যন্ত কবিরাজ চিকিৎসা দিয়ে বললেন, বিষ নেমে গেছে, বাড়ি চলে যেতে। নুরুল ইসলাম ছেলেকে নিয়ে বাড়ি চলে আসেন।
সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। রাত ৮টার দিকে তিনি পায়ে প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া অনুভব করতে লাগলেন।
নুরুল ইসলাম বলছিলেন, “পা জ্বলা তো কমছে না। চরম জ্বলা জ্বলছে। প্রশ্রাব করার জন্য বাইরে যাব, তখন পরিবার বলল, বাইরে যাওয়ার দরকার নাই, বারান্দাতেই প্রশ্রাব করেন। প্রশ্রাবে পুরা রক্তই গেল। দুই থেকে আড়াই কেজির মতো রক্ত গেল, এত রক্ত। এটা দেখে পরিবারের সবাই খুব ভয় পেয়ে গেল। বলল, না আর দেরি করা যাবে না, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”
বৃষ্টির মধ্যে রাতেই কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় নুরুল ইসলামকে। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পথে তার ‘মাঝে মাঝে হুঁশ ছিল আর মাঝে মাঝে জ্ঞান ছিল না’।
“হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার বলতিছেন, ঘুম যেন আসে না। বসায় রাখছে। আর ডাক্তাররা কী সব ইনজেকশান দিচ্ছে। যখন খুব জোরে ঝাঁকি দিচ্ছে, তখন আবার বুঝতে পারছি। এইভাবেই সারারাত গেল। সকালে ডাক্তার বলল, এখনও যেহেতু রক্ত বন্ধ হয়নি তাই রাজশাহী নিয়ে চলে যান”, বলেন নুরুল ইসলাম।
পরের দিন পরিবারের লোকজন তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। গাড়িতে যেতে যেতে কিছু সময় তিনি সবকিছুই বুঝতে পারছিলেন। আবার কখনও কখনও ঘুমের ঘোরের মধ্যে ছিলেন।
নুরুল ইসলাম বলেন, “সেখানকার ডাক্তাররা ইনজেকশান দেওয়া শুরু করল। ওষুধ দিচ্ছে আর রক্ত পরীক্ষা করছে। দুই ঘণ্টা পর পর রক্ত পরীক্ষা করল। এইভাবে টানা ছয়দিন চলল। ছয়দিন পর ডাক্তার বলল সুস্থ, তারপর বাড়ি আসছি।”
রাসেলস ভাইপার সাপে কামড়েছে এটা কীভাবে বুঝলেন- উত্তরের তিনি বলেন, “রাজশাহী মেডিকেলের ডাক্তাররাই বলছেন, সাপটা রাসেলস ভাইপার ছিল। তারা সেই চিকিৎসা করেছেন।”
বাড়ি আসার পর প্রাথমিকভাবে এক মাস নুরুল ইসলাম খুব দুর্বল ছিলেন। কোনো কাজকর্ম করতে পারেননি। প্রায় দেড় মাস পর তিনি কাজে যোগ দেন।
বর্তমান শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে বলেন, “শহরে কাজ করতে আসি। কিন্তু শরীরে আগের মত আর বল পাই না, আগের মত কাজ করতে পারি না। একটু এদিক-সেদিক হলেই জ্বর আসে, নাহলে ঠান্ডা লাগে, মাথা ঘোরায়। ঈদের পরে কাজে আসলাম, দেখলাম শরীর কাঁপছে। আগের মতো স্বাভাবিক শক্তি নাই।”
‘ওঝার কাছে চিকিৎসা নেই, হাসপাতালে আসুন’
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক মাহফুজুর রহমান দীর্ঘদিন ধরেই সাপেকাটা রোগীদের নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলছিলেন, আগে হয়ত বছরে তিনি একটা-দুটো সাপেকাটা রোগী পেতেন। কিন্তু গত দুই বছর ধরে সেটি বেড়েছে। তার মতে, এটি এখন ‘বার্নিং ইস্যু’ বা আলোচিত ঘটনা।
তিনি বলছিলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৮১ জন সাপের কামড়ের রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তার মধ্যে পুরুষ ৫৮ জন; নারী ও শিশু ২৩ জন। এর মধ্যে ১০ পুরুষ এবং তিন নারীকে অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয়েছে।
“দুজনকে রাসেলস ভাইপার সাপে কামড়েছিল। এর মধ্যে একজনের প্রবল কিডনি সমস্যা দেখা দেওয়ায় তাকে স্থানান্তর করা হয়। আরেকজনকে অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয়। তিনিসহ বাকিরা সুস্থ হয়ে বাড়ি গেছেন। এ বছর আমাদের এখানে কেউ মারা যাননি।”
বাংলাদেশে যে অ্যান্টিভেনম পাওয়া যায় সেটা খুব কাজ করে না জানিয়ে চিকিৎসক বলেন, “কিন্তু এবার দেখলাম যে, সেগুলো খুব কাজ করেছে।
“গত বছর আমাদের এখানে কয়েকটি মৃত্যু ছিল। হয় এখানে চিকিৎসাধীন মারা গেছেন; নাহলে স্থানান্তর করা হলে রাস্তায় মারা গেছেন। এ বছর সেটা হয়নি। এটার কারণ হচ্ছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। শুধু সাপে না, যেকোনো কিছু কামড়ালেই মানুষ এখন প্রথমে হাসপাতালে চলে আসেন। এক্ষেত্রে চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে সুবিধা হচ্ছে।”
সাপেকাটার পর প্রথম ১০০ মিনিট রোগীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে মাহফুজুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশে রাজগোখরা (কিং কোরবা) ও কেউটের (ক্রেট) কামড়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হলেও সাম্প্রতিককালে রাসেলস ভাইপার এই অঞ্চলের জন্য ভয়ানক হয়ে উঠেছে। এটা তো মূলত মরুভূমির আবহাওয়ার সাপ। জলবায়ু পরিবর্তনগত কারণে নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। বালি ও গরম মিলিয়ে তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
“এরা সাঁতার কাটতে পারে। অন্য সাপ ডিমের মাধ্যমে বাচ্চা দেয়। ফলে কিছু ডিম নানা কারণে নষ্ট হয়ে যায়, বা পাখি খেয়ে ফেলে। রাসেলস ভাইপার ডিম পেটের মধ্যে রেখে বাচ্চাকে পরিপূর্ণ করে, পরে প্রসব করে। ফলে এদের বাচ্চা নষ্ট হয় না। ফলে এদের বংশবৃদ্ধি বেশি হচ্ছে। এখন পদ্মায় পানি, ফলে সাপ ডাঙ্গায় উঠে আসছে।”
সাপে কাটলে অন্য কোথাও না গিয়ে সরাসরি হাসপাতালে আসার পরামর্শ দিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, “ওঝা বা কবিরাজের কাছে গিয়ে কোনো লাভ নেই। এখানে এলে আমরা তাদের সুস্থ করে বাড়ি পাঠাব। কারণ, আমি নিজেই সাপেকাটা অনেক ওঝার চিকিৎসা করেছি। তারাও সুস্থ হয়ে বলেছেন, তারা এতদিন যা করেছেন সেগুলো ভুয়া।
“শুধু রাসেলস ভাইপার না, ধান ক্ষেতে কোবরার সংখ্যাও কিন্তু বেড়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, মানুষ সাপের বাসস্থান ধ্বংস করে ফেলছে। সাপ খায় এমন প্রাণী যেমন, বাজপাখি, গুইসাপ, বেজি- এসব আমরা মেরে ফেলছি।”
তিনি বলেন, “সারা বছরের জন্য আমাদের অ্যান্টিভেনমের একটি চাহিদা থাকে। গত বছর শেষ দিকে এসে কম পড়েছিল। এবার কিন্তু অ্যান্টিভেনমের কোনো সঙ্কট নেই। পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম আছে।”