২০১৮ সালে হকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে; এতে মেয়র আইভীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন।
Published : 03 Feb 2024, 09:51 PM
নারায়ণগঞ্জ শহরকে ‘যানজট ও হকারমুক্ত’ করতে জেলা প্রশাসন ও রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধিরা একমত হয়েছেন।
শনিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাব আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে শহরের এই সমস্যা সমাধানে সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান ঐক্যমত পোষণ করেন।
এ সময় সেখানে উপস্থিত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক এবং জেলা পুলিশ সুপার (ভারপ্রাপ্ত) আমীর খসরুও এ ব্যাপারে কার্যকরি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন।
আইভী এবং সেলিম-শামীমকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে সাধারণত এক মঞ্চে দেখা যায় না। কিন্তু এই ইস্যুতে এক মঞ্চ থেকে তাদের ঐক্যবদ্ধ ঘোষণা ইতিবাচক প্রভাব রাখবে বলে বৈঠকে আসা অনেকেই আশা প্রকাশ করেন।
দুপুর ১২টায় শুরু হওয়া এই বৈঠক চলে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত। এতে সভাপতিত্ব করেন নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি আরিফ আলম দিপু এবং সঞ্চালনা করেন ক্লাবের কার্যকরী সদস্য আফজাল হোসেন পন্টি।
এ সময় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চন্দন শীল, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর, সদর উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকের শুরুতে শহরের যানজট ও ফুটপাতের হকার সমস্যা নিয়ে নির্মিত একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শিত হয়। পরে এ নিয়ে আলোচনা করেন উপস্থিত জনপ্রতিনিধি ও সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, “৪০০ বছরের পুরনো আমাদের নারায়ণগঞ্জ শহর। কোলকাতা শহরের আগে বন্দর নগরী দিয়ে এ শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল। ব্রিটিশরা এখানে এসেছেন; পাটসহ বিভিন্ন ব্যবসা ছিল। তখন এটা ছিল পজেটিভ নারায়ণগঞ্জ। আমরা সেই পজেটিভ নারায়ণগঞ্জ চাই।
“শামীম ভাই অনেকদিন পরে হলেও একমত হয়েছেন যে, ফুটপাত হকারমুক্ত করতে হবে, যানজট নিরসন করতে হবে। এ থেকে পজেটিভ দিক আর হতে পারে না।”
সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে মেয়র বলেন, “অবৈধ স্ট্যান্ডগুলো বন্ধ এবং রুট পারমিট ছাড়া যেন সড়কে কোনো বাস চলতে না পারে সে ব্যাপারে প্রশাসনকেই উদ্যোগ নিতে হবে। ট্রাকের নগরী হিসেবে নারায়ণগঞ্জকে আমরা চাই না। আপনারা সরকারি কর্মকর্তা, আপনারা দলাদলি দেখবেন না, আপনাদের নিয়ম অনুযায়ী কাজ করবেন।”
এ সময় শামীম ওসমানকে উদ্দেশ করে সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, “ভাই, আপনি যদি ঘোষণা দেন তাহলেই হবে। পুলিশকে আপনি বাধ্য করবেন। আপনি সংসদ সদস্য। আপনাদের কথায় পুলিশ, প্রশাসন চলে। মেয়রের কথা তারা শোনেন না। এসপি-ডিসি আমারে পাত্তাই দেন না। তাদের অনুরোধ করে আমার নিতে হয়।”
২০১৮ সালে হকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে মেয়র আইভীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। তবে হকারমুক্ত ফুটপাতের বিষয়টি এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
এ প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, “৬০০ হকারকে পুনর্বাসন সিটি করপোরেশন করেছে। তারা দোকানগুলো বিক্রি করে দিয়ে আবারও ফুটপাতে চলে এসেছে। সড়ক ও ফুটপাতের মালিক নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন।
“কিন্তু অন্যরা খবরদারি করে হকার বসিয়ে টাকা তোলেন, এখানে প্রশাসনেরও কিছু লোক রয়েছেন। ২০১৮ সালে এ হকার ইস্যুতে যে ভুল বোঝাবুঝি আমার আর শামীম ভাইয়ের মধ্যে হয়েছে তাতে অনেকেই সুবিধা নিয়েছেন। সে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হোক। আজ আমরা একমত হয়েছি। এই শহর সুন্দর নগরী হোক”, বলেন আইভী।
সিটি মেয়রের বক্তব্যের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান ও শামীম ওসমান। তারা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে তাগিদ দেন।
এ সময় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বলেন, “আমরা ভালো কাজগুলো একসঙ্গে করব। শুধু একটি সড়ক হকারমুক্ত করলে হবে না, করলে সবগুলো সড়কই হকারমুক্ত করতে হবে। কোনো যানবাহন রুট পারমিট ছাড়া চলতে পারবে না। এইটার ব্যবস্থা বিআরটিএ নেবে। আমার পক্ষ থেকে কোনো প্রকার বাধা থাকবে না, সবার ক্ষেত্রেও যেন তাই হয়।”
বিআরটিএ প্রয়োজনের অতিরিক্ত গাড়ির অনুমতি দিতে পারবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আর সেক্ষেত্রে আমাদের নারায়ণগঞ্জের পরিবহন ব্যবসায়ীদের আগে মূল্যায়ন করা উচিত। অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করে নির্দিষ্ট স্থানে স্ট্যান্ড দিতে হবে। আর অবৈধ স্ট্যান্ডে কেউ না কেউ টাকা উঠাবেন। সেই ব্যাপারেও খোঁজ নিতে হবে। আর যানজট কমাতে ট্রেন লাইন চাষাঢ়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।”
আদমজী ইপিজেডের কারখানাগুলো ছুটি হলে সেখানে প্রতিদিন যানজট দেখা দেয় উল্লেখ করে এই সংসদ সদস্য বলেন, “এই স্থানে একটা ফুটওভার ব্রিজ করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। আমি আর আইভী একটা কাগজে সই করে পাঠালেও এটা সমাধান হয়ে যাবে।”
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান বলেন, “নারায়ণগঞ্জে সমস্যার শেষ নেই। আজকে আমরা উঠে গেলাম আর সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমনটা না। রাস্তার দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের হাতে। ফুটপাত কার হাতে? এটা কি মাসলম্যানদের হাতে? এই দখলকারীরা কারা? এদের চিহ্নিত করতে হবে। আমরা একত্রিত থাকলে একটা ফুটপাতও দখলে থাকবে না।
“এখানে কোনো রাজনীতি থাকবে না। রাজনীতি একটাই, নারায়ণগঞ্জের মানুষকে শান্তিতে চলাচল করতে দিতে হবে। আমরা মেয়রকে অবশ্যই সহযোগিতা করব। আগামী এক বছরের মধ্যে আমরা নারায়ণগঞ্জে কোনো সমস্যা রাখব না। আমার মেয়র আইভীকে নিয়ে আমার ছোটভাই শামীম ওসমানকে নিয়ে আমরা এটা করব”, যোগ করেন সেলিম ওসমান।
মেয়র ও দুই সংসদ সদস্যের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক বলেন, “শহরকে যানজটমুক্ত করার ব্যাপারে রোববার থেকে কাজ শুরু হয়ে যাবে। প্রত্যেকে পজেটিভ নারায়ণগঞ্জ চাচ্ছেন। আপনাদের কথায় আমি সাহস পাচ্ছি। আমি এরকম একটি ঐক্যমত চাচ্ছিলাম।”
তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, “নারায়ণগঞ্জে রুট পারমিট ছাড়া কোনো গাড়ি চলবে না। সড়কের পরিমাপ অনুযায়ী সড়কে যানবাহন চলবে। এ নিয়ে আমরা কাজ করছি। ৫ মাসে সাড়ে ৪৫০ যানবাহনে জরিমানা করা হয়েছে। রোববার থেকে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট সড়কে থাকবে। অবৈধ স্ট্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিযান চালাব। কোনো অবৈধ স্ট্যান্ড থাকবে না।”
বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে জেলা পুলিশ সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বলে জানান পুলিশ সুপার (ভারপ্রাপ্ত) আমীর খসরু। তিনি বলেন, “নারায়ণগঞ্জের জনপ্রতিনিধিরা ঐক্যমতের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত দেবেন আমরা সেটি দ্রুত বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ সহায়তা করব।”