জোড় ইজতেমা পালন করা নিয়ে বিরোধে জের ধরে সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষ।
Published : 18 Dec 2024, 04:07 PM
টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমা ময়দান দখলকে কেন্দ্র করে মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদের অনুসারিদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দুই পক্ষই একে অপরকে দায়ী করছে।
সাদপন্থীদের দাবি, কামারপাড়া থেকে স্লুইচ গেইট পর্যন্ত সড়কে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় রাত সাড়ে তিনটার দিকে জোবায়েরপন্থিরা তাদের দিকে ‘ইট পাটকেল, জলন্ত মশাল’ নিয়ে হামলা করে।
অন্যদিকে জুবায়েরপন্থিরা দাবি করছেন, ইজতেমার মাঠে অবস্থানকালে রাত সাড়ে তিনটায় ‘ছুরি, ক্ষুর, হাতুড়ি, ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে তাদের ওপর হামলা চালান সাদপন্থিরা।
তাবলীগ জামাতের এই দুটি পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত তিনজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
বুধবার সকালে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার মো. নাজমুল করিম খান বলেন, মঙ্গলবার রাত ৩টার দিকে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত তিনজন মারা গেছেন।
গত ২৯ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে ৫ দিনের জোড় ইজতেমা পালন করেন কাকরাইল মারকাজের মাওলানা জুবায়ের অনুসারীরা। এরপর ইজতেমা মাঠে ২০ ডিসেম্বর থেকে ৫ দিনের জোড় ইজতেমা পালনের ঘোষণা দেন দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীরা।
তবে সাদের অনুসারীদের জোড় ইজতেমা করতে না দেওয়ার দাবিতে ১৩ ডিসেম্বর টঙ্গী-কালীগঞ্জ আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছিল মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা।
জোড় ইজতেমার জন্য মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার মধ্যরাতে মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদের অনুসারিরা সংঘর্ষে জড়ায়।
সাদ অনুসারী মুফতি মু’আয বিন নূর ইজতেমা মাঠ থেকে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “তাবলিগের এক পক্ষ সারা বছর এ মাঠটি ব্যবহার করে। তারা এবার যখন এ মাঠটিতে পাঁচদিনের জোড় (জমায়েত) করলেন তখন আমরা সেখানে জোড় (জমায়েত) করার অনুমতি চাই।
“সরকার দুই পক্ষকে নিয়ে গত ৪ নভেম্বর বসার চেষ্টা করলেও আমরা এসেছি, কিন্তু তারা আসেনি। সরকার আমাদের দিয়াবাড়ি মাঠে জমায়েতের অনুমতি দিলেও সেটি পরিদর্শন করে, দেখলাম মাত্র ত্রিশ হাজার মানুষ সেখানে সংকুলান হবে। সেখানে কোন ইউটিলিসিট ফ্যাসিলিটি নেই। আমাদের ৪ থেকে ৫ লাখ মানুষ সেখানে সংকুলান হবে না। আজ ১৮ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় উপদেষ্টারা আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছেন। সেজন্য মাঠ প্রস্তুত করতে সরকারে অনুমতি নিয়ে আমাদের সাথীরা ঢাকায় এসেছেন।”
তিনি দাবি করেন, বিভিন্ন স্থানে সাদপন্থিরা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। রাত সাড়ে ৩টার দিকে কামারপাড়া থেকে স্লুইচ গেইট পর্যন্ত সড়কে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় জুবায়েরপন্থিরা তাদের ওপর ইটপাটকেল ও জলন্ত মশাল নিক্ষেপ করে আক্রমণ শুরু করে। সেখান থেকেই ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে জুবায়েরপন্থিদের ধাওয়া দিয়ে সাদপন্থিরা মাঠে প্রবেশ করে।
জুবায়েরপন্থিদের নেতা মুফতি আমানুল হক কাকরাইল মসজিদ থেকে সংবাদমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, “ইজতেমার মাঠে অবস্থানকালে রাত সাড়ে ৩টায় ‘ছুরি, ক্ষুর, হাতুড়ি, ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে তাদের ওপর হামলা চালান সাদপন্থিরা।”
জুবায়েরপন্থিদের আরেক নেতা মামুনুল হক বলেন, “আমাদের তিনজন ভাই শাহাদাত বরণ করেছেন। তাদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। একপক্ষীয়ভাবে হামলা হয়েছে। আমরা এমন তথ্য পাচ্ছি, পেশাদার খুনীদেরসহ এ অভিযান পরিচালনা হয়েছে। এটি দুই পক্ষের সংঘর্ষ বলে সংবাদ প্রচার হচ্ছে কিন্তু এটি একপক্ষীয় হামলা ও আক্রমণ।”
গাজীপুর মহানগরের টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি হাবিব ইস্কান্দার বলেন, মঙ্গলবার ইজতেমা ময়দানে অবস্থান করছিলেন মাওলানা জুবায়ের আহমদের অনুসারিরা। পরে মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারিরা তুরাগ নদীর পশ্চিম তীর থেকে কামারপাড়া ব্রিজসহ বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে ইজতেমা ময়দানে প্রবেশ করতে থাকেন। এ সময় মাঠের ভেতর থেকে জুবায়ের অনুসারীরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে। জবাবে সাদের অনুসারীরাও পাল্টা হামলা চালায়। একপর্যায়ে সাদপন্থিরা মাঠে প্রবেশ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। খবর পেয়ে পুলিশ, সেনাসদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষে তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। বুধবার সকালে নিজের ভেরিফাইয়েড ফেইসবুক পেইজে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, “সাদপন্থী সমর্থিত ‘সচেতন ছাত্র সমাজের’ দেয়া প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি এবং সকাল দশটার মধ্যে মাওলানা সাদ সাহেবের ভিসার জন্য বাসভবন ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণার কারণে আমরা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে সাদপন্থিদের সাথে আলোচনার জন্য টঙ্গী যাই।
“সেখানে আলোচনা শেষে তারা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন এবং মাওলানা সাদ সাহেবের ভিসা জটিলতা নিরসনে পুনরায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে তারা টঙ্গী ময়দানে জোড়ের শর্ত দেন এবং ২৫ তারিখ মাঠ ছাড়ার প্রতিশ্রুতি দেন। টঙ্গীতে এই তিনটি বিষয়ে আলোচনা হয়।”
হাসনাত লেখেন, “আলোচনায় আমরা এটাও স্পষ্ট করি এগুলো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। এ বিষয়ে কাকরাইলে মাওলানা জুবায়ের সাহেব এবং ওলামায়ে কেরামের সাথে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সে পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে হবে। এই উদ্দেশে রাত ২টায় কাকরাইলে আলোচনার জন্য যাই। সেখানে মাওলানা মাহফুজুল হক ও মাওলানা মামুনুল হকসহ অন্যান্য আলেমরা উপস্থিত ছিলেন।”
স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, “সেখানে পৌঁছানোর পর সাদপন্থীদের একজন মুফতি সাহেবের একটি পোস্ট আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়, যেখানে খণ্ডিত ভিডিও প্রচার করে বলা হয়েছে আমরা নাকি তাদের জোড় করার অনুমতি দিয়েছি। এটি আমাদের সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ বিপরীত। কাকরাইলে আলোচনাকালীন সেখানে আলেমদের উপস্থিতিতে আমরা তাদেরকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছি যে, আমরা কোনো কর্তৃপক্ষ নই।
“আমরা আলোচনা করে কাকরাইল থেকে টঙ্গী গিয়ে কথা বলব এবং এরপর পারস্পরিক মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। আলোচনার মাঝেও সাদপন্থী ঐ মুফতি সাহেবকে ফোন দিয়ে বলেছি, আপনারা যদি সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার আগে ইজতেমার ময়দানে প্রবেশ করেন, তাহলে আমাদের সাথে আপনাদের সম্পর্ক থাকবে না। আমরা কাকরাইলে আলেমদের উপস্থিতিতে সাদপন্থীদের আরও বলেছি, কোনোভাবেই আপনারা ময়দানে প্রবেশ করবেন না এবং আমাদের নিয়ে যে ভিডিও প্রচার করেছেন, তা মুছে ফেলবেন।”
“কিন্তু এর আগেই এই নির্মম ঘটনা ঘটেছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।” লেখেন হাসনাত আবদুল্লাহ।
সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে শান্ত ও ধৈর্য ধারণ করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে তিনি লেখেন, “কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা না করে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য আহ্বান করছি। তাবলীগ একটি দ্বীনি ও ধর্মীয় ইস্যু। ফলে আমরা মনে করি, তাবলীগসহ ধর্মীয় সকল বিষয়াদি উলামায়ে কেরামের মাধ্যমেই সুরাহা ও মীমাংসিত হবে। তবে সমগ্র বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা রক্ষার দায়ভার আমাদের প্রত্যেকটি নাগরিকের। দেশের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে শান্তিপূর্ণ সমাধান ও অবস্থানের জন্য আমরা সবাই আন্তরিকভাবে কাজ করে যাবো।”