“আমাদের মধ্যে দীর্ঘ ও বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক রয়েছে এবং সংস্কারের যে ধারা দেখা যাচ্ছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট,” বলেন যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য দূত।
Published : 10 Apr 2025, 12:06 AM
চায়না ও ইন্ডিয়া মার্টের মত সফল উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় এবার সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘বাংলাদেশ মার্ট’ চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে ডিপি ওয়ার্ল্ড।
প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, এই মার্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের কাঠ, মার্বেল ও কৃষিজ পণ্যসহ দেশি পণ্য বিশ্ববাজারে তুলে ধরতে চায় তারা।
বাংলাদেশের বন্দর ও লজিস্টিক অবকাঠামোয় কৌশলগত বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করতে ডিপি ওয়ার্ল্ডের গ্রুপ চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা-সিইও সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েম বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
পরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বৈঠকের বিষয়টি জানায়।
এদিন যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য দূত রোজি উইন্টারটন, হোলসিম গ্রুপের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলের প্রধান মার্টিন ক্রিগনার, স্পেনের শীর্ষস্থানীয় পোশাক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিটেক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অস্কার গার্সিয়া ম্যাসেইরাসও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বলে জানায় তার কার্যালয়।
ডিপি ওয়ার্ল্ডের বিনিয়োগ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা
ডিপি ওয়ার্ল্ড দুবাইভিত্তিক একটি বৈশ্বিক লজিস্টিক প্রতিষ্ঠান, যা বন্দর উন্নয়ন, সামুদ্রিক সেবা, আধুনিক লজিস্টিক ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তিনির্ভর বাণিজ্য সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত।
সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েম বৈঠকের ধারাবাহিকতায় এবারকার আলোচনায় চট্টগ্রামের নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনালে ডিপি ওয়ার্ল্ডের বিনিয়োগ সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
প্রস্তাবিত এই বিনিয়োগের লক্ষ্য হচ্ছে—চট্টগ্রাম বন্দরের জট কমানো, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস এবং দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরের দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানো।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এটি সম্ভাবনার দেশ। বাংলাদেশে আসুন, আমরা একসঙ্গে এগিয়ে যাই।”
ডিপি ওয়ার্ল্ডের প্রধান সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েম বলেন, “এই অংশীদারিত্বের জন্য আমরা উদগ্রীব। আপনাদের সমৃদ্ধিই আমাদের সমৃদ্ধি। চট্টগ্রাম থেকে দুবাই হয়ে আফ্রিকা পর্যন্ত—এটা আমাদের সম্মিলিত স্বপ্ন।”
প্রধান উপদেষ্টা ডিপি ওয়ার্ল্ডকে মৎস্য, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ ও হালাল মাংস রপ্তানিসহ অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতে কাজ করার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের কর্মশক্তিকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে যৌথভাবে কাজ করার ওপর জোর দেন।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আমাদের দায়িত্ব হল, আমাদের কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং আমরা তা নিশ্চিত করবো।”
জবাবে ডিপি ওয়ার্ল্ড প্রধান বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি দক্ষ কর্মীদের জন্য ভিসা সহজীকরণ এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে কাজ করছে।
বৈঠকে উপস্থিত আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, “সাধারণ বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা সমস্যা সমাধানে আমরা কাজ করছি এবং আশাবাদী, দ্রুতই একটি সমাধান আসবে।”
বৈঠকে জানানো হয়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুটি কোম্পানি সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০০ কর্মী নিয়োগ করেছে।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বিষয়ক সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে যুক্তরাজ্যকে সহায়তার আহ্বান
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য দূত ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটনের সঙ্গে বৈঠকে উভয় পক্ষ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গভীর করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যকে আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমাদের বর্তমানে নার্সের সংকট রয়েছে। তবে নার্সিং শুধু জাতীয় সমস্যা নয়—এটি একটি বৈশ্বিক প্রয়োজন। আমরা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্য আরও নার্স প্রশিক্ষণ দিতে চাই।”
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্য কার্যক্রম প্রায় অকার্যকর। এখানে যুক্তরাজ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আরেকটি সম্ভাবনাময় খাত হলো ওষুধশিল্প। আমরা অনুরোধ করছি, পেটেন্ট সুরক্ষা তুলে নেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিন, যাতে প্রতিটি দেশ সাশ্রয়ীভাবে সামাজিক ব্যবসা মডেলে টিকা উৎপাদন করতে পারে।”
উইন্টারটন বলেন, “আমাদের মধ্যে দীর্ঘ ও বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক রয়েছে এবং সংস্কারের যে ধারা দেখা যাচ্ছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট।”
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “এটি আমাদের জন্য একটি রূপান্তরমূলক সময়। আমরা প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন এবং অগ্রাধিকার পুননির্ধারণে মনোনিবেশ করছি।”
উভয় পক্ষ শিক্ষা, টেক্সটাইল শিল্প, প্রতিরক্ষা এবং বিমান চলাচলসহ কৌশলগত সহযোগিতার আরও বিস্তৃত ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করেন।
উভয় নেতা এই খাতে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি বিনিময় এবং দীর্ঘমেয়াদী অংশীদারিত্বে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
উইন্টারটন বর্তমান সংস্কার এজেন্ডার প্রতি যুক্তরাজ্য সরকারের সমর্থন জানান। তিনি সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজের সঙ্গেও বৈঠক করেন।
পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “যদি রাজনৈতিক দলগুলো স্বল্প সংস্কার প্রক্রিয়ায় একমত হয়, তবে ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে পারে। তবে যদি বৃহত্তর সংস্কার পথ বেছে নেওয়া হয়, তাহলে নির্বাচন জুনে অনুষ্ঠিত হতে পারে।”
বৈঠকে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে থাকার প্রতিশ্রুতি হোলসিম গ্রুপের
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে হোলসিম গ্রুপের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলের প্রধান মার্টিন ক্রিয়েগনার সাক্ষাৎ করেছেন।
বৈঠকে দেশের সিমেন্ট শিল্পের পরিবেশগত প্রভাব এবং বাংলাদেশের বাজারে হোলসিমের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়।
বিশ্ববিখ্যাত সিমেন্ট ও নির্মাণ সামগ্রী প্রস্তুতকারক হোলসিম গ্রুপ হলো লাফার্জ-হোলসিম বাংলাদেশের মূল কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি সুনামগঞ্জের ছাতকে দেশের একমাত্র একীভূত সিমেন্ট কারখানা পরিচালনা করছে এবং দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে।
ক্রিয়েগনার বাংলাদেশের বাজারে দীর্ঘমেয়াদে থাকার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদনের জন্য সরকার যেভাবে আমাদের সহায়তা করে চলেছে, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।”
বাংলাদেশে হোলসিমের সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল চৌধুরী গত এক বছরে সিমেন্ট শিল্পের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আগামী মাসগুলোতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে তিনি আশাবাদী।
মুহাম্মদ ইউনূস ছাতকের লাফার্জ কারখানায় অপুনঃচক্রায়িত প্লাস্টিক (নন-রিসাইকেবল) ব্যবহারের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে জানতে চান। হোলসিম আশ্বস্ত করে যে এই জ্বালানির ব্যবহার কার্বন নির্গমন ঘটাবে না।
প্রধান উপদেষ্টা দেশে হোলসিমের আরও বিনিয়োগকে স্বাগত জানান এবং সরকারের ব্যবসাবান্ধব ও বিদেশি বিনিয়োগবান্ধব অবস্থানের বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেন।
বৈঠকে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, প্রধান উপদেষ্টার মূখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
সম্পর্ক জোরদার করতে চায় ইন্ডিটেক্স
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে স্পেনের পোশাক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিটেক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অস্কার গার্সিয়া ম্যাসেইরাসের বৈঠকে বৈশ্বিক বাণিজ্যের পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশ-স্পেন সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার এবং বাংলাদেশে ইন্ডিটেক্সের করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে ‘অত্যন্ত অনুপ্রেরণাদায়ক’ হিসেবে বর্ণনা করেন ইন্ডিটেক্সের প্রধান নির্বাহী।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। আমরা এই সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে চাই। সোর্সিংয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ অত্যন্ত ব্যবসাবান্ধব।’
ম্যাসেইরাস ঘোষণা দেন, চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত একটি নতুন চুক্তির মাধ্যমে ইন্ডিটেক্স বাংলাদেশের পোশাক কারখানার অন্তত ৫০ জন নারী কর্মীর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করবে।
এছাড়াও, ইন্ডিটেক্স ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্প্যানিশ ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে ‘ইন্ডিটেক্স চেয়ার’ প্রতিষ্ঠা করেছে বলেও তুলে ধরেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতার উদ্যোগের প্রশংসা করেন। তিনি স্পেনে কাটানো সময় এবং স্পেনের সাবেক রানী সোফিয়ার সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্কের কথা স্মরণ করেন।
বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা খাতে আরও বেশি বিনিয়োগের আহ্বান জানান মুহাম্মদ ইউনূস।
বৈঠকে উপস্থিত ইন্ডিটেক্স কর্মকর্তারা বলেন, শিগগিরই প্রতিষ্ঠানটি সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এয়ার-কার্গো পরিবহন শুরু করবে।