ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলায় লক্ষাধিক ছিন্নমূল ও স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশু রয়েছে।
Published : 14 Sep 2022, 11:52 AM
ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলায় লক্ষাধিক ছিন্নমূল ও স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুকে করোনাভাইরাসের টিকার আওতায় নিয়ে আসাটা বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
সারা দেশে পাঁচ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের কোভিড টিকা শুরুর পর ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর ও নেত্রকোণায় এ কার্যক্রম চলছে। জন্মনিবন্ধন সনদের মাধ্যমে টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়েছে ছিন্নমূল শিশুরা।
ময়মনসিংহ বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের তথ্য অনুযায়ী, বিভাগের চার জেলার ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশু রয়েছে ১৮ লাখ ৫০ হাজার। যাদের লক্ষাধিক স্কুল থেকে ঝরে পড়া ও ছিন্নমূল শিশু। এদের একটা বড় অংশ রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড এবং ফুটপাতে বসবাস করে। এ ছাড়া কিছু শিশু রয়েছে যারা জন্মের পর বিদ্যালয়ে যায়নি।
ময়মনসিংহ বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, “বিভাগের লক্ষাধিক শিশুকে কোভিডের টিকা দেওয়া নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। সেক্ষেত্রে মাইক্রোপ্ল্যান করে প্রত্যেকটি ওয়ার্ডের কমিউনিটি ক্লিনিক, এইচএফডব্লিউএইচএ, আরডি, ইউনিয়ন কাউন্সিল এবং প্রাইমারি স্কুলে টিকা ক্যাম্পেইন করা হবে। তখন ঝরে পড়া শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।”
তবে একে ‘খুব বড় একটা চ্যালেঞ্জ’ বলে মনে করলেও বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের আশা, তারা সফল হবেন।
১১ অগাস্ট পাঁচ থেকে ১১ বছর বয়সী ২ কোটি ২০ লাখ শিশুকে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া শুরু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ২৫ অগাস্ট থেকে সারাদেশেই এ কার্যক্রম শুরু হয়। সরকারের সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনে (surokkha.gov.bd) গিয়ে শিশুদের টিকার নিবন্ধন করতে হয়। কিন্তু যেসব শিশুর এই সুবিধা নেই তাদের নিয়েই চ্যালেঞ্চের মুখে পড়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশন স্টেশনে প্রায় পাঁচ বছর ধরে পরিবার ছাড়া থাকে সাব্বির রহমান (১০)। তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণায়। বাবা-মার বিবাদের মধ্যে পাঁচ বছর আগে পরিবার ছাড়ে সে। তারপর আর বাড়ি ফেরেনি। করোনাভাইরাস বা এর টিকা নিয়ে তার কোনো ধারণা নেই।
টিকার ব্যাপারে জিজ্ঞাস করলে সাব্বির উল্টো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে প্রশ্ন করে, “টিকা দিয়ে কী হয়? কেন এটা দিতে হবে?”
করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে এই টিকা দিতে হয় জানালে সাব্বির না ভেবেই বলে, “আমি এবং আমার বন্ধুরা এমনেতেই ভালো আছি। টিকা দিতে হবে কেউ তো কোনোদিন বলেনি। কোনো মাইকিংও শুনেনি।”
সাব্বিরের মতো রেলওয়ে স্টেশনে থাকে চম্পা নামের আরেক শিশু। সে জানায়, তার বাবা-মা আছে। কিন্তু সে সেখানে থাকে না। রেলস্টেশনেই থাকতে তার ভালো লাগে।
কোভিড টিকার ব্যাপারে এই শিশুর ভাষ্য হচ্ছে, “টিকা দিতে হবে কেন? আমার তো কোনো অসুখ হয়নি। বাবা-মাও তো কিছু বলেনি। আমরা কেউ টিকা নেইনি।”
নগরীর থানার ঘাট বস্তি এলাকার যেসব শিশুর জন্মসনদ আছে তারা করোনাভাইরাসের টিকা পেয়েছে স্কুলে। যারা স্কুলে যায়নি বা জন্মসনদ নেই তারা টিকা বঞ্চিত হয়েছে।
থানার ঘাট বস্তি এলাকার বাসিন্দা আসমা আক্তার বলেন, “আমার মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। স্কুলে টিকা দেওয়ার সময় আমরা বাড়িতে চলে গেছিলাম। তাই টিকা দেওয়া হয়নি। এখন আর দেওয়ার ইচ্ছাও নাই।”
আবু সাঈদ নামে আরেকজন বলেন, “টিকা দিতে গেলে জন্মনিবন্ধন লাগে। এখানে যারা বসবাস করে তাদের অনেকের তা নেই। তাই টিকা দেওয়ারও ইচ্ছা নেই। কেউ যদি আমাদের বলতো কাগজপত্র ছাড়া টিকা দেওয়া যাবে তাহলে পোলাপান নিয়ে টিকা দিতে যাইতাম।”
আব্দুল কাদির নামে আরেকজন বলেন, “আমার ছেলে স্কুলে পড়ে; তাই পাঁচদিন আগেই টিকা কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। যারা এই এলাকায় বসবাস করছে তাদের অনেকে টিকা সম্পর্কে ধারণা নেই। টিকা দেওয়ার বিষয়টি সহজ করে মাইকিংয়ের মাধ্যমে জানালো হলে প্রায় সকল শিশুই টিকা দিতো। এ নিয়ে কোনো প্রচার আমরা শুনিনি।”
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ছয়টি ওয়ার্ডে শিশুদের নিয়ে কাজ করে ‘আলোকিত শিশু প্রকল্প’ নামে একটি স্বেচ্ছসেবী সংগঠন।
সংগঠনের মাঠ কর্মকর্তা বিপাশা মানকিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা প্রায় পাঁচ শতাধিক শিশুকে নিয়ে কাজ করছেন। এর মধ্যে ২১৩ জন শিশু স্কুলে যাচ্ছে না। এদের ১৭৭ জন শিশুর জন্মসনদ নেই। জন্মসনদ না থাকায় তাদেরকে টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনা যাচ্ছে না।
বিষয়টি নিয়ে সিভিল সার্জনের সঙ্গেও যোগাযোগ হয়েছে জানিয়ে বিপাশা মানকিন বলেন, “জন্মসনদের বিষয়টি একটু শিথিল করা হলে হয়তো তাদেরকে টিকার আওতায় আনা যাবে।”
ময়মনসিংহ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শফিকুল হক বলেন, জেলায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী রয়েছে সাত লাখ ৮৪ হাজার ৬৯৬ জন। এর মধ্যে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী আট শতাংশ। অথাৎ ৬২ হাজার ৭৭৬ জন শিশু বিদ্যালয়ে আসছে না।
“সিটি করপোরেশন এলাকায় বিদ্যালয়মুখী শিশুদের কোভিড টিকা কার্যক্রম মোটামুটি সম্পন্ন হয়েছে। তবে ঝড়েপড়াদের বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারব না।”
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইউসুফ আলী বলেন, সিটি করপোরেশনে ৬২ হাজার শিশুর মধ্যে ৫৭ হাজার শিশুকে করোনাভাইরাসের টিকার আওতায় আনা হয়েছে। বাকি ঝড়েপড়া এবং পথশিশুদের টিকার আওতায় আনতে মাইকিং করে প্রচার চালানো হচ্ছে।
“যাদের জন্মনিবন্ধন নেই তাদের খাতায় নাম লিখে টিকা দেওয়া হবে। পরে জন্মনিবন্ধন করলে অনলাইনে টিকা কার্যক্রম সম্পন্ন হবে।”
টিকা নিয়ে বৈষম্য সৃষ্টি হলে কার্যক্রম সফল হবে না বলে মনে করছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘জনউদ্যোগ’-এর ময়মনসিংহের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু।
তিনি বলেন, “সরকার করোনাভাইরাস সুন্দরভাবে মোকাবিলা করায় অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশ ভালো আছে। শিশুদের টিকা কার্যক্রম আমরা দেখছি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে। তবে স্কুলগামী ও ঝরে পড়া এবং পথশিশুদের টিকা কার্যক্রমে যেন বৈষম্যের সৃষ্টি না হয়। তাহলে সরকারের উদ্দেশ্য সফল হবে না।”
আরও পড়ুন :
শিশুদের কোভিড টিকার নিবন্ধন কীভাবে?
শিশুদের কোভিড টিকা: প্রথম দিন পাবে ১৬ জন