রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগুলো হয়ে ওঠেছে প্রতিবাদ, সাম্য, অসাম্প্রদায়িক, বিপ্লব ও ভ্রাতৃত্ববোধের অভূতপূর্ব নিদর্শন।
Published : 15 Aug 2024, 08:35 PM
যুগে যুগে বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বুকে আন্দোলনে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে গ্রাফিতি-স্লোগান-দেয়াল লিখন। যা ওই আন্দোলনের অস্তিত্বকে বহন করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। বেশ কিছুদিন আগেও দেশের আনাচে-কানাচের দেয়ালগুলো ছিলো কেবলই রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের বন্দনা, তোষামোদ ও প্রচারণায় ভরপুর।
তবে হঠাৎই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন দেয়ালের রূপ-যৌবন। এতকাল আশাহীন মানুষের মতো জীর্ণশীর্ণ, বিবর্ণ, মলিন, প্রাণহীন দেয়ালগুলোও নীরবতা ভঙ্গ করে উচ্চারণ করতে লাগলো ছাত্র সমাজের অব্যক্ত কথামালায়।
এর ব্যতিক্রম নয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরা মানুষের না বলা কথাগুলো, শোষণ-প্রতিবাদের চিত্রগুলো তারা এঁকে দিতে লাগলো ক্যাম্পাসের বিভিন্ন একাডেমিক ভবন থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ ভবনের দেয়াল আর শরীরজুড়ে। এতে সীমানা প্রাচীরগুলো হয়ে ওঠে প্রতিবাদ, সাম্য, অসাম্প্রদায়িক, বিপ্লব ও ভ্রাতৃত্ববোধের অভূতপূর্ব নিদর্শন। পথচারী থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার নজর কাড়ছে এসব মর্মস্পর্শী গ্রাফিতি।
৯ অগাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মোহাম্মদ মঞ্জুর মোর্শেদ, চারুকলা অনুষদের তাসনিয়া মৌমি, ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের রিফাইয়া রাজ্জাক রিফাসহ শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে ‘গ্রাফিতি করবো’ বলে একটা গ্রুপসহ পেইজও খোলা হয় এবং এতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। তারা ১১ থেকে ১৪ অগাস্ট ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গার দেয়ালে গ্রাফিতি অংকন করেন।
এসব গ্রাফিতিতে ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের প্রতিকৃতি ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধার পাশাপাশি উঠে এসেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা, উচ্চারিত হয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রে সমতার বাণী, শোষণের কথা, বাকস্বাধীনতার কথা, মাথা নত না করার প্রত্যয়, বাঙালি ও পাহাড়িদের সমঅধিকার থেকে শুরু করে সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আর প্রতিরোধের অগ্নিময় উক্তি ও সাহসী চিত্রায়ণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাডেমিক ভবনের মূল ফটকের পাশের দেয়ালেই দেখা যায়, বড় করে লেখা হয়েছে ‘আওয়াজ উডা কথা ক’ পাশেই এক তরুণ হাত-আঙ্গুল উঁচু করে চিৎকাররত ভঙ্গিমায় রয়েছে।
র্যাপার হান্নানের ‘আওয়াজ উডা বাংলাদেশ’ এই গানটি আন্দোলনের সময় তরুণদের ব্যাপকভাবে উদ্দীপনা যুগিয়েছিলো। এজন্য অবশ্য তাকে গ্রেপ্তার থেকে শুরু করে রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছিল। হান্নান যখন বলে, ‘আবু সাঈদরে গুল্লি করলি, অর্ডার দিলি কই থেক্কা?/ এইবার রাস্তায় হাজার সাঈদ কইলজা থাকলে ঠেকাগা!’ তখন তা হাজারো তরুণের প্রতিবাদের অংশ হয়ে উঠে।
আবার আরেক গ্রাফিতিতে লেখা হয়েছে ‘আমার হৃদপিণ্ডের আঘাতে বেঁকে যায় স্বৈরাচারীর বেয়নেট’- এ বাক্য দিয়ে যেন এই সময়ের তারুণ্য যে মাথা নোয়াবার নয়, সেই উদ্দীপন শক্তিকেই বুঝিয়েছে।
প্রতিবাদের পাশাপাশি দেয়ালগুলোতে শোষণের চিত্রায়ণও দেখতে পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনের পেছন সংলগ্ন প্রহরীর রুমের দেয়ালে ‘ইন্টারনেট একা একা বন্ধ হয়ে গেছে’ লেখাসহ পাশেই একজন মুজিব কোট পরিধান করা লোককে দেখতে পাওয়া। বুঝতে বাকি থাকে না যে, ১৭ জুলাই থেকে চলমান ইন্টারনেট শাটডাউন করে শিক্ষার্থীদের দমন করার যে ষড়যন্ত্র সরকার করেছিলো এখানে তার কথা বোঝানো হচ্ছে।
একইসঙ্গে এই কাজের অন্যতম সহযোগী তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এর ডানপাশে আরেক গ্রাফিতিতে লক্ষ্য করা যায়, এক বড় ড্রেজারে অনেক সবুজ ঘাস-গাছ জাতীয় কিছু, সঙ্গে একটি বাড়ি; নিচেই অনেক রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এর মাঝে লেখা ‘পাহাড় কেটে উন্নয়ন’।
এ ছাড়া পাহাড়ে বৈষম্যের কথা বলতে গিয়ে গুম হওয়া কল্পনা চাকমার গ্রাফিতিও স্থান পেয়েছে। এক দেয়ালে কল্পনা চাকমার চোখবাঁধা ছবির পাশে লেখা হয়েছে ‘কল্পনা চাকমা কোথায়?’
ছাত্র আন্দোলনের শহীদদের প্রসঙ্গগুলোও বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেয়ালগুলোতে জায়গা পেয়েছে। রাজধানীর মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) শিক্ষার্থী শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনের নির্মম মৃত্যুও গ্রাফিতিতে উঠে এসেছে। যার দেহটি ১৮ জুলাই পুলিশের একটি সাঁজোয়াযানের উপর থেকে টেনে নিচে ফেলা হয়। ইয়ামিন সাঁজোয়াযানের চাকার কাছে সড়কে পড়ে থাকেন। এরপর পুলিশের এক সদস্য সাঁজোয়াযান থেকে নিচে নামেন। এক হাত ধরে তাকে টেনে আরেকটু দূরে সড়কে ফেলে রাখেন।
গ্রাফিতিটিতে দেখা যায়, সাঁজোয়াযানের উপর একটি লাশ এবং তার বুকের ভিতর থেকে উড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে একটা আগুনপাখি। এমন শহীদদের আত্মত্যাগেই যে তরুণদের প্রতিবাদের অগ্নিশিখা আরও বেগবান হয় এ যেন তারই প্রতিফলন। এর পাশাপাশি বাদ যায়নি, রংপুরের আবু সাঈদ; যিনি এই আন্দোলনের প্রথম শহীদ। যদিও গ্রাফিতিতে তাকে রূপকভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে।
এক গ্রাফিতিতে দেখা যায়, একটি মোমবাতির অগ্নিশিখায় কেউ একজন হয়তো বুক পেতে দিচ্ছে। পাশেই আরেকটা মোমবাতির অগ্নিশিখা নিভে গেছে, কিছুটা রক্তের ছাপ সেখানে৷ এর ডানপাশে আবার অনেকগুলো মোমবাতির অগ্নিশিখায় অনেকে বুক পেতে দিচ্ছে। এর উপরে লেখা হয়েছে, ‘আমি নয়তো একজন, আমরা অনেকজন’। আবার আন্দোলনে মুগ্ধের আমৃত্যু পানি বিলিয়ে যাওয়া বিষয়টিও উঠে এসেছে, ‘পানি লাগবে পানি?’।
১ অগাস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা চত্বর সংলগ্ন রাস্তা থেকে সিভিল পোশাক পরিহিত কয়েকজন গোয়েন্দা পুলিশের সদস্য এক শিক্ষার্থীকে শিক্ষকের সামনে চ্যাঙদোলা করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পরে অবশ্য শিক্ষকদের সাহায্যে তাদেরকে উদ্ধার করা হয়। গ্রাফিতির ভাষায় বাদ পড়েনি সেই ঘটনাও।
এ ছাড়া দেয়ালগুলোর লেখনিতে সমতা-অসাম্প্রদায়িক চেতনাও প্রকাশ পেয়েছে। যেমন- একটি দেয়ালে একটি গাছের প্রতিটি পাতায় বিভিন্ন ধর্মের নাম লেখা হয়েছে এবং উপরেই লেখা ‘পাতা ছিঁড়বেন না’। আবার মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সেই বিখ্যাত উক্তিও স্থান পেয়েছে দেয়ালে, ‘শোনো ধর্ম আর দেশ মিলাইতে যেয়ো না, পরে ফুলের নাম কি দিবা ফাতেমা চূঁড়া?’
পাশাপাশি আরেক গ্রাফিতিতে লেখা হয়েছে, ‘সমতল থেকে পাহাড় এবারের মুক্তি সবার।’
গ্রাফিতি করা প্রসঙ্গে ‘গ্রাফিতি করবো’ এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মোহাম্মদ মঞ্জুর মোর্শেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৫ অগাস্ট স্বৈরশাসনের পতনের পর আমিসহ আমার কয়েকজন বন্ধু মিলে ভাবছিলাম সারাদেশেই তো প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে গ্রাফিতি করা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়েও করা যায় কিনা। পরে ৯ অগাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের তাসনিয়া মৌমি, ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের রিফাইয়া রাজ্জাক রিফার সঙ্গে মিলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে ‘গ্রাফিতি করবো’ বলে একটা গ্রুপসহ পেইজও খোলা হয় এবং ব্যাপক সাড়া পাওয়ায় আমরা ১১ তারিখ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গার দেয়ালে সকাল-সন্ধ্যা অবধি গ্রাফিতি কার্যক্রম সম্পন্ন করি। আমাদের দলে এই মুহূর্তে মোট সদস্য প্রায় ৮০ জন।
“পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো সেই অর্থে জানবে না যে, এতো বড় একটা গণঅভ্যুত্থান কিভাবে সফল হয়েছে। এই আন্দোলনে যে, সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছিলো, অনেকে শহীদ হয়েছিলো, স্বৈরশাসকের আচরণ কেমন ছিলো সব মিলিয়ে আমরা একটা বার্তা দিতে চেয়েছি গ্রাফিতির মাধ্যমে। তাছাড়া সমতলে গণতন্ত্র ফিরে আসলেও পাহাড় এখনো যে স্বাধীন হয়নি সেই বিষয়টিও আমরা তুলে ধরতে চেয়েছি।”
আরেক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তাসনিয়া মৌমি বলেন, “বাকস্বাধীনতার অংশ হিসেবে আমরা গ্রাফিতিগুলো করেছি। এ ছাড়া ৫ অগাস্টের যে গণঅভ্যুত্থান সেটা তো একদিনে হয়নি, আমরা গ্রাফিতিগুলোর মাধ্যমে সে ঘটনাপ্রবাহকেই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি সমসাময়িক ইস্যু নিয়েও বার্তা দেওয়া হয়েছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গ্রাফিতি করবো’ এই দলটিতে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ভূমিকা রেখেছে আইন বিভাগের সানজিদা রহমান, নওরিন আক্তার, মাহদী হাসান ফাগুন, আইবিএর মেহেদী হাসান, রোকনুজ্জামান রুমন, আইসিইর মুকিত আলম, ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সিদরাতুল মুনতাহা।