যদিও একটি স্বস্তির ঈদযাত্রা উপহার দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে সড়ক বিভাগসহ হাইওয়ে পুলিশ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন।
Published : 21 Mar 2025, 09:50 AM
আসন্ন রোজার ঈদের যাত্রায় ব্যস্ততম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে অন্তত ১২টি স্থানে যানজটের শঙ্কা রয়েছে।
মহাসড়কের এ অংশে ১০৪ কিলোমিটারের দাউদকান্দি মেঘনা-গোমতী সেতুর টোলপ্লাজা থেকে চৌদ্দগ্রামে আমজাদের বাজার পর্যন্ত অংশে বাইপাস, চৌমুহনী, বাজার ও বাস স্টপেজগুলোতে ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষদের ভোগান্তিতে ফেলতে পারে।
যদিও এসব স্থানকে বিবেচনায় রেখেই একটি স্বস্তির ঈদযাত্রা উপহার দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে সড়ক বিভাগসহ হাইওয়ে পুলিশ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন।
হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা রিজিয়নের এসপি মো. খায়রুল আলম বলেন, “ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যে ১২টি পয়েন্ট ভোগান্তির ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলোতে আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আশা করি, কোনো যানজটের ভোগান্তি হবে না।”
এ মহাসড়কে চলাচল করা গণপরিবহনের চালক, যাত্রী ও স্থানীয়রা বলছেন, সারা বছর ধরে মহাসড়কে অবৈধ থ্রি হুইলার, উল্টোপথে যান চলাচল, অবৈধ পার্কিং ও অবাধে যাত্রী ওঠা-নামা, যত্রতত্র রাস্তা পারাপার, সড়কে অবৈধ স্থাপনা, টোল প্লাজায় ধীরগতি ও দুর্ঘটনার কারণে যানজট তৈরি হয়।
আর বছরে দুটি ঈদকে ঘিরে মহাসড়কের ঘরমুখো মানুষ ও যানবাহনের চাপ বেড়ে যাওয়ায় যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। এতে মানুষের ভোগান্তির সীমা থাকে না।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ, চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের জেলা নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর ছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেট অঞ্চলের যোগাযোগ এই মহাসড়ক থেকেই ভাগ হয়ে থাকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২৫ হাজার যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল করে।
ঈদে ঘরমুখো মানুষের চাপে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল দ্বিগুণ হয়ে যায়।
মহাসড়কের দাউদকান্দি উপজেলার অংশে যানজটের আশঙ্কা রয়েছে চারটি পয়েন্টে।
এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গৌরীপুর বাজার ও মেঘনা গোমতী সেতুর টোল প্লাজা। যানবাহনের চাপ বাড়লে ঈদের আগে ও পরে এই দুই জায়গায় যানজট চরম আকার ধারণ করে।
ঢাকা-কুমিল্লা পথে চলাচলকারী এশিয়া লাইন পরিবহনের বাস চালক আলিমুল হক বলেন, “ঈদের আগে টোল প্লাজায় যানজট থাকবে নিশ্চিত। কিন্তু এই যানজট যদি বেশি দীর্ঘ হয়ে যায় তখন গাড়িগুলো সব এলোমেলো বা উল্টাপথ ব্যবহার করতে গেলেই আরো ঝামেলা বাঁধবে। তখন পুলিশ চাইলেও এক জায়গা থেকে নড়াচড়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর গৌরীপুর এলাকায় পথচারীরা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করলেই যানজট শুরু হয়ে যায়।
“ঈদের সময় একটা গাড়ি কোনো কারণে থেমে গেলে এক মিনিটে তার পেছনে ১০টা গাড়ি থেমে যায়।”
দাউদকান্দির পর মহাসড়কের চান্দিনা উপজেলার মাধাইয়া ও চান্দিনা বাজার-বাগুড় পয়েন্ট যানজট প্রবণ এলাকা।
মহাসড়কের এ অংশ থেকে দেবিদ্বার উপজেলাগামী মানুষের চান্দিনা বাজার থেকে পথচারীদের অবাধ রাস্তা পারাপারের কারণে যানবাহনের ধীরগতি দেখা দেয়।
এ ছাড়া এই দুই পয়েন্টে প্রচুর লোকাল বাস, প্রাইভেট কার ও অটোরিকশার চলাচল, অবৈধ পার্কিং, যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা যানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
একই কারণে ইলিয়টগঞ্জ ও শহীদনগর এলাকায়ও দূরপাল্লার যানবাহনের ধীরগতি হয়।
মহাসড়কের বুড়িচং এলাকার নিমসার বাজার ঈদে ঘরমুখো মানুষের জন্য আতঙ্কের কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
মহাসড়কের উপর দেশের বৃহত্তম এই কাঁচাবাজারে সাধারণ সময়েও যানবাহনের জঞ্জাল লেগে থাকে। ঈদে যানবাহনের চাপ বাড়লে এই জায়গায় যানজট চরম ভোগান্তির কারণ হতে পরে।
বিশেষ করে, রাতের বেলায় এই বাজারে আসা বিভিন্ন শাকসবজির ট্রাক লোড-আনলোড করার সময় স্বাভাবিক যান চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
নিমসার এলাকার বাসিন্দা জাকির হোসেন বলেন, “রাতে বিভিন্ন জেলা থেকে ট্রাকে ট্রাকে সবজি আসে। এগুলো ঠিকঠাক মত পার্কিং না করলেই সড়কে জটলা তৈরি হয়। তাই পুলিশ ও বাজার কমিটিকে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে হবে যেন ট্রাকগুলো সড়কের উপর না দাঁড়ায়।”
ময়নামতি হাইওয়ে থানার ওসি ইকবাল বাহার মজুমদার বলেন, “নিমসার এলাকাকে যানজটমুক্ত রাখতে মহাসড়ক অবৈধ দোকানপাটমুক্ত রাখতে হবে। ঈদের আগে আমরা এ বিষয়ে জোর দিচ্ছি। ঈদের জন্য নিমসারে পুলিশের নিয়মিত সদস্যরা ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করবেন।”
মহাসড়কের ময়নামতি সেনানিবাস এলাকায়ও যানবাহনের ধীর গতি তৈরি হয়।
মহাসড়কের এই অংশ দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে সিলেটমুখি যানবাহন বাইপাস হওয়ায় এবং যত্রতত্র থ্রি হুইলার-লোকাল মাইক্রো বাস ও বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করানোর কারণে যানবাহনে ধীরগতি তৈরি হলে যানজটের সৃষ্টি হয়।
এ ছাড়া ঈদযাত্রায় মহাসড়কের সদর দক্ষিণ উপজেলার পদুয়ারবাজার এলাকায় যানবাহনের ধীরগতি ও যানজট দেখা দেয়।
পদুয়ারবাজার থেকে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুরগামী যানবাহন কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে প্রবেশ করে। এখানেই রেলওয়ে ওভারপাস এবং নির্মাণাধীন ইউলুপের কাজ চলমান থাকায় ঈদ যাত্রায় পদুয়ার বাজারে যানজট সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
এ ছাড়া একই উপজেলার সুয়াগাজী বাজার এলাকা নিয়েও যানজটের আশঙ্কা করছে যাত্রী ও চালকরা। কারণ, এই সুয়াগাজী বাজারের কাঁচা বাজার অংশটি মহাসড়ক লাগোয়া।
যে কারণে যানবাহনের স্বাভাবিক গতিতে ব্যাঘাত ঘটলে এই জায়গায় যানজটের আশঙ্কা রয়েছে।
নোয়াখালী পথে চলা উপকূল পরিহবনের চালক আমির হোসেন বলেন, “ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ক্রস করে আমাকে কুমিল্লা থেকে নোয়াখালী পথে ঢুকতে হয়। ঈদের সময় গাড়ির চাপ থাকে বেশি, ক্রসিংয়ের সময় যে দিকেই গাড়ি থামে সেদিকেই যানজট লাগে। ইউলুপ না হওয়া পর্যন্ত সমস্যা থাকবেই। ঈদে পুলিশ থাকলে কিছুটা হলেও উপকার পাওয়া যাবে।”
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নিয়মিত চলাচলকারী ব্যাংক কর্মকর্তা ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, “কিছু কিছু জায়গায় মহাসড়কের পাশে সংস্কার বা মেরামত কাজ চলছে। পদুয়ার বাজরে ইউলুপ নির্মাণের কাজ চলছে। ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সড়কের পাশে লুপ নির্মাণ চলছে। এসব নির্মাণ কাজের জন্য যেন আবার যানজট না সৃষ্টি হয় তা খেয়াল রাখতে হবে।”
এদিকে, চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজার ও চৌদ্দগ্রাম বাজার এলাকাতেও ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রায় যানজটের আশঙ্কা রয়েছে।
এ দুটি স্থানেই সড়কের উপর অটোরিকশা স্ট্যান্ড, রাস্তার পাশের দোকানপাট এবং যাত্রী ওঠা-নামার কারণে এ অংশে যানজট তৈরি হওয়ার ভোগান্তির শঙ্কা রয়েছে।
তবে ঈদযাত্রায় যানজট নিরসনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ‘কোনো ছাড় দেওয়া হবে না’ বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন কুমিল্লার ডিসি মো. আমিরুল কায়ছার। ঈদ উপলক্ষে সড়ক মনিটরিং বিষয়ে রোববার জেলা সড়ক নিরাপত্তা কমিটির সভায় এ হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
ঈদযাত্রায় যেন কুমিল্লা জেলার কোনো সড়কে ভোগান্তি সৃষ্টি না হয় সে জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেষ্ট থাকার আহ্বান জানান ডিসি আমিরুল কায়সার।
তিনি বলেন, “এবারের ঈদযাত্রায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, কুমিল্লা-সিলেট ও কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে যেন কোনো ধরনের ভোগান্তি তৈরি না হয় সেজন্য প্রতি উপজেলায় সড়ক নিরাপত্তা ও পর্যবেক্ষণ টিম তৈরি করার সুপারিশ করা হয়েছে।
“এ সমন্বিত টিমে একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সদস্য, হাইওয়ে পুলিশ সদস্য, সড়ক ও জনপথ বিভাগের নিযুক্ত সদস্য, বাস মালিক শ্রমিক সমিতির সদস্য, বাজার মালিক সমিতির সদস্য ও পরিচয়পত্রধারী একাধিক স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন।”
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চান্দিনা ও সুয়াগাজী এলাকায় রেকার, মেডিকেল টিম ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে দুইটি কুইক রেসপন্স টিম থাকবে বলেও জানান ডিসি।
হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা রিজিয়নের এসপি মো. খায়রুল আলম বলেন, হাইওয়ে পুলিশ, জেলা পুলিশ, প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবকদের সমন্বিত টিম থাকলে মহাসড়কে কোনো ভোগান্তি তৈরি হবে না।
এসপি বলেন, “আমরা অতিরিক্ত ২৫০ জন পুলিশ সদস্য পেয়েছি। তাদের সঙ্গে নিয়ে থানার নিয়মিত পুলিশ সদস্যরা ঈদে মহাসড়কে যান চলাচল ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রচেষ্টা চালাবেন।”
জেলার এসপি নাজির আহমেদ খান বলেন, “ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও লাইসেন্সবিহীন চালক যানজট ও দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। যানজটপ্রবণ এলাকায় পুলিশের অতিরিক্ত নজরদারি থাকবে। মহাসড়কে ডাকাতি ও ছিনতাই রোধেও কাজ করবে পুলিশ।”
জেলা প্রশাসনের সড়ক নিরাপত্তা কমিটির সভায় কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের কংশনগর ও কুমিল্লা-নোয়াখালী মহাসড়কের বাগমারা এলাকায় বিশেষ নজরদারির সিদ্ধান্ত হয়।
সভা থেকে মহাসড়ক সংলগ্ন বাজারগুলোর অবৈধ স্থাপনা অপসারণের জন্য বাজার কমিটির নেতাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
ঈদযাত্রায় ভোগান্তি এড়ানোর জন্য কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের কোম্পানিগঞ্জ এলাকায় সেতুর সংস্কার কাজ পেছানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পদুয়ারবাজার ইউলুপ ও ময়নামতি সেনানিবাস এলাকায় লুপ নির্মাণ কাজের জন্য সড়ক প্রতিবন্ধকতা তৈরি না হয় সেজন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন স্থানীয়রা।
যদিও কুমিল্লা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার গোলাম মোস্তফা বলছেন, যেসব নির্মাণ কাজ চলছে, সেগুলো দ্রুত শেষ করার সময় ঘনিয়ে আসায় কাজ বন্ধ রাখার সুযোগ নেই।
তাছাড়া সড়ক মেরামত ও সংস্কার কাজ চললেও ঈদযাত্রায় কোনো প্রকার সমস্যা হবে না বলে মনে করছেন তিনি।
আরো পড়ুন:
মহাসড়ক যানজটমুক্ত রাখতে কুমিল্লায় শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ