পরিবেশ অধিদপ্তর ও সওজ কুমিল্লা কর্তৃপক্ষ বলছে, কাজ বন্ধ করে জায়গাটি ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে। নাহলে আইনি ব্যবস্থা।
Published : 07 Oct 2023, 09:04 AM
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলায় নিয়ম বহির্ভূতভাবে সড়ক ও জনপথ বিভাগের জলাশয় রাতের আঁধারে ভরাট করে এলপিজি ফিলিং স্টেশন নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে এক প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে।
সওজ ও পরিবেশ অধিদপ্তর জায়গা ছেড়ে দেওয়ার জন্য কয়েকবার নোটিশ পাঠালেও তাতে কর্ণপাত করেননি ওই ব্যক্তি। প্রভাবশালী হওয়ায় স্থানীয়রা তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।
চাপের মুখে দিনের বেলায় কাজ বন্ধ রাখলেও এখন রাতের আঁধারে ট্রাক দিয়ে বালু ফেলে প্রায় ৫০ শতক জায়গা ভরাট করা হচ্ছে বলে জনপ্রতিনিধি জানিয়েছেন। এ নিয়ে স্থানীয় মানুষ ও পরিবেশবাদীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
সরজমিনে গিয়ে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সদর দক্ষিণ উপজেলার পশ্চিম জোড়কানন ইউনিয়নের ভাটপাড়া শুয়াগাজি বাজার ঘেঁষা এলাকায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে এই ফিলিং স্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে। সেখানে প্রস্তাবিত ফিলিং স্টেশনের মধ্যে একটি সাইনবোর্ডও লাগানো হয়েছে। এতে লেখা আছে- প্রস্তাবিত মধু এলপিজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন।
সাইনবোর্ডের সামনের পুরো জায়গাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের। মহাসড়কের পাশের এই জলাশয়টি ভরাট করার কাজ চলছে।
‘মধু এলপিজি ফিলিং স্টেশন ও কনভার্শন’ এর মালিক উপজেলার চৌয়ারা এলাকার রায়পুর গ্রামের রুহুল আমিনের ছেলে মোতাহের হোসেন। যদিও তিনি সিটি করপোরেশন এলাকাতেই থাকেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সওজ বিভাগ, কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীতি চাকমা বলেন, “সওজের জায়গা দখলকারী মোতাহের হোসেনকে এরই মধ্যে উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নিজ থেকে সরে না গেলে শিগগিরই তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে আমরা মামলা করে দেব। কোনো দখলকারীকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মোতাহের হোসেনদের পুরো পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তার আরেকটি ফিলিং স্টেশন রয়েছে। মোতাহের এলাকায় বিএনপির ‘ডোনার’ হিসেবে পরিচিত। তবে তিনি বিএনপির কোনো পদ-পদবীতে নেই।”
তবে দখলের অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে এক সপ্তাহ ধরে চেষ্টা করেও মোতাহের হোসেনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে বারবার কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। বুধবার দুপুরে কথা বলতে চেয়ে তার কাছে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
সবশেষ বৃহস্পতিবার কয়েকবার কল করার পর মোতাহের হোসেন সেটি রিসিভ করলেও সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে এবং প্রশ্ন শুনে কলটি কেটে দেন। এরপর আবারও বেশ কয়েকবার চেষ্টা করা হলে তিনি আর কল রিসিভ করেননি।
স্থানীয়ভাবে পরিচিত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার চার ব্যক্তি জানান, ভাটপাড়া এলাকায় মহাসড়কের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে সওজের বড় আয়তনের সম্পত্তি রয়েছে। মোতাহের হোসেন যেখানে ভরাট কাজ চালাচ্ছেন তার পাশে তার ১০ শতক জমি রয়েছে। সাইনবোর্ডটি তিনি নিজের জায়গায় লাগিয়ে পাশের সওজের জলাশয় ভরাট করছেন।
বিষয়টি জানার পর সওজ কর্মকর্তারা গিয়ে প্রশাসনের সহায়তায় সেখানে কাজ বন্ধ করে দেন। এবং জায়গা ছেড়ে দেওয়ার জন্য মোতাহার হোসেনকে নোটিশ দেন। তারপর দিনের বেলায় কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু প্রায়ই রাতেই এক-দুই ট্রাক করে বালু ফেলছেন তিনি।
তাছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর জলাশয় ভরাটের অভিযোগ পাওয়ার পর পরিদর্শন করে ঘটনার সত্যতা পায় এবং মোতাহের হোসেনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠায়।
এলাকার বাসিন্দা মোজাম্মেল হক বলেন, “মোতাহার জোর করে সড়কের জায়গা দখল করে ফিলিং স্টেশন করতে চায়। তিনি মহাসড়কের পাশের কয়েকটি গাছও কেটে ফেলছেন। এভাবে গাছ কেটে ফেলা পরিবেশের ক্ষতির কারণ। সওজ ও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে তাকে নোটিশ করলেও এসবের কোনো তোয়াক্কাই করছেন না তিনি।”
উপজেলার আরেকটি ফিলিং স্টেশনের মালিক বলেন, নতুন করে ফিলিং স্টেশন স্থাপন করতে হলে কমপক্ষে নিজস্ব ২৬ শতক সম্পত্তি থাকতে হয়। কিন্তু এখানে মোতাহের হোসেনের আছে মাত্র ১০ শতক।
“প্রভাবশালী মোতাহের কোনো দপ্তর থেকে অনুমুতি বা ছাড়পত্র না পেয়ে জলাশয় ভরাটের কাজ শুরু করেন। তার মূল উদ্দেশ্য হল সওজের কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি দখল করা।”
পশ্চিম জোড়কানন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জাফর আহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেন, “যিনি (মোতাহের) ফিলিং স্টেশন করতে চান এখানে তার জমি আছে মাত্র ১০ শতক। বাকি সম্পত্তি সড়ক বিভাগের। সড়ক বিভাগের ৫০ শতকের বেশি জলাশয় দখল করতে এরই মধ্যে বালু ফেলে ভরাটের প্রায় কাজ করে ফেলেছেন তিনি।”
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর, কুমিল্লার সহকারী পরিচালক রুনায়েত আমিন রেজা বলেন, “আমরা বিষয়টি জানার পর ওই ব্যক্তিকে জলাশয় ভরাট বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছি। এ ছাড়া তাকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এরপরও তিনি জলাশয় ভরাটের চেষ্টা করলে আমরা পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা জেলার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম বলেন, “সরকারিভাবে জলাশয় ভরাট করাই নিষেধ। তারপর ওই ব্যক্তি সরকারি জায়গা দখল করে ফিলিং স্টেশন বানাচ্ছেন; যা আইন ও নিয়ম বহির্ভূত।
“এরই মধ্যে অনেক জায়গায় জলাশয় ভরাট করে ফেলেছে ভূমিখেকোরা। সরকার চেষ্টা করেও সেই জায়গাগুলো উদ্ধার করতে পারছে না। এতে পরিবেশের উপর দিন দিন বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এসব জায়গা উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে”, যোগ করেন বাপা নেতা।