“স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে পুরো এক মাসের জন্য জুম ঘরে থাকব। ধান কাটা শেষে মাড়াই করে তবেই ঘরে ফিরব। নদীপথে নৌকায় করে নিয়ে যাব,” বলেন এক জুমিয়া।
Published : 12 Oct 2023, 02:03 AM
বান্দরবানের লিক্রি মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এক এলাকা; যেখানে সাঙ্গু নদীর উজানে জুম ক্ষেতে ধান কাটছিল কোয়াইছক্ষ্যং পাড়ার একদল ম্রো পরিবার। একদম খাড়া পাহাড়ে পরিবারের চার সদস্য নিবিড়ভাবে ধান কাটছেন। থুরুংয়ে (ঝুড়ি) ভরে গেলে নিচে এসে জুম ঘরে স্তুপ করে রাখা হচ্ছে কাটা ধান।
রেংতন ম্রো নামে দলের এক সদস্য জানান, স্বামী-স্ত্রীসহ পরিবারে চার সদস্য মিলে দুই সপ্তাহ ধরে ধান কাটছেন। ধান কাটার জন্য তার ছোট ভাই ও বোনকেও নিয়ে আসা হয়েছে। মোট ৯ হাঁড়ি ধান লাগানো হয়েছে। লোকবল কম হওয়ায় সময় বেশি লাগছে।
কয়েক দিন পর কয়েকজন প্রতিবেশী ধান কাটার কাজে সহযোগিতা করার কথা। শেষ মুহূর্তে সবাই যে যার জুমের কাজে ব্যস্ত। জুমের মারফা (শসা জাতীয়) মোটামুটি ধরেছে। কিন্তু মরিচ একেবারেই ভালো হয়নি বলে জানান রেংতেন ম্রো।
শুধু লিক্রি নয়, পুরো বান্দরবানের প্রত্যন্ত পাহাড়জুড়েই এখন জুমের ফসল তুলতে ব্যস্ত জুম চাষিরা; যারা জুমিয়া হিসেবেই পরিচিত পাহাড়ে।
এসময় বান্দরবানের একটু গহীনে গেলেই চোখে পড়বে দুর্গম সেসব পাহাড়ের পর পাহাড়জুড়ে সকালের সোনারোদের সঙ্গে খেলা করছে জুম ক্ষেতের পাকা ধান; যেন সবুজের গায়ে সোনালি রঙের আলপনা আঁকা হয়েছে।
লোকালয় থেকে অনেক দূরের সেই পাহাড়গুলোতে পুরোদমে জুমের ফসল কাটাও চলছে। জুম চাষিদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে নবান্নের হাসি। ফসল ঘরে তোলার পর কেউ কেউ মেতে উঠেছেন নবান্ন উৎসবেও।
দুর্গম সেই পাহাড়ে সরেজমিন ঘুরে সম্প্রতি দেখা গেছে, নদী তীরবর্তী এলাকায় টানা বৃষ্টির কারণে কিছু কিছু জুম ক্ষেতের ক্ষতিও হয়েছে। বিশেষ করে যারা শুধু জুম চাষের ফসলের উপর নির্ভরশীল, তাদেকে সারাবছরের খোরাকির সংকট নিয়ে চিন্তিত হতে দেখা গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলার সাত উপজেলায় চলতি অর্থবছরে সাত হাজার ৯৩৩ হেক্টর জায়গায় জুম চাষ হয়েছে। এতে সম্ভাব্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ধান ১৮ হাজার ৮৭ টন এবং চাল ১২ হাজার ৫৮ টন।
অধিদপ্তরের উপ পরিচালক এম এম শাহ নেওয়াজ বলেন, “এ বছর শুরুতে বৃষ্টিপাত কম হয়েছে আবার শেষের দিকে অতিবৃষ্টির কারণে পাহাড়ে কিছু জায়গায় জুমের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে।
“আবার অগাস্টে ভারি বৃষ্টির কারণে জুমের ধানের পাশাপাশি মারফা, ভুট্টা, মরিচ, তুলা, ঢেঁড়স, বেগুন, বরবটি, তিল- যেগুলোকে ‘সাথী ফসল’ বলা হয় সেগুলো নষ্ট হয়েছে”, বলেন কৃষি কর্মকর্তা।
দিন দিন কমছে জুম চাষ
পাহাড়ি জমিতে জঙ্গল কেটে আগুন পোড়ানোর পর চাষ করাকে জুম বলা হয়। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে জঙ্গল কেটে শুকানোর পর পোড়ানো হয়। এরপর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে জুমের মাটিতে ছোট ছোট গর্ত করে ধানের সঙ্গে নানা ফসলের বীজ বপন করা হয়।
তিন-চার মাস ধরে এ ফসলের পরিচর্যা করা হয়। ধান ভাদ্র মাসে পেকে ওঠে। এসময় অন্যান্য ফসলও তোলা হয়। এ কারণে জুম চাষকে অনেকে ‘বহু মিশ্রন’ ফসলের চাষও বলে থাকেন।
জুমের ফসল যেন হাতি বা অন্য কোনো প্রাণি নষ্ট করতে না পারে এজন্য জুম ক্ষেতের মধ্যে টঙ ঘর করে পাহারা দেন জুমিয়ারা। ভাদ্র-আশ্বিন মাস থেকেই জুমের ফসল কাটা শুরু হয়ে যায়। তখন অনেক জুমিয়া পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে টঙ ঘরে থাকেন। এখান থেকে পাওয়া ধান দিয়েই সারা বছর চলে নৃগোষ্ঠী অনেক পরিবারের।
জুম চাষিরা জানিয়েছেন, একই জায়গায় বারবার জুমচাষ করা যায় না। এক জায়গায় একবার চাষ করার পর অন্তত পাঁচ বছর সময় বিরতি দিতে হয়। যাতে জঙ্গলাকীর্ণ ও লতাগুল্ম বেড়ে মাটির উর্বরতা তৈরি হয়। এখন পাহাড়ে জুমচাষের জমি কমে আসায় একই জায়গায় অল্প সময়ের ব্যবধানে চাষের কারণে জুম ধান আগের মত পাওয়া যায় না।
এক সময় শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পাহাড়ে ভালো জুম চাষ হত। আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূলে থাকলে সারাবছরের ‘খোরাকি’ ধান পাওয়া যেত। কিন্তু বনজঙ্গল কমে যাওয়ায় এবং লোকসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে জুম চাষযোগ্য জমি না থাকায় আগের মত ধান পাওয়া যায় না। কম সময়ের ব্যবধানে একই জায়গায় বারবার চাষ হওয়ায় মাটির উর্বরতাও কমে গেছে। একমাত্র দুর্গম এলাকা ছাড়া বড় জুম ক্ষেতও আর দেখা মেলে না।
এবার পাহাড়ের তিন জেলার মধ্যে খাগড়াছড়িতে জুমের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তন, মাটির উর্বরতা হ্রাস, একই জমিতে পুনঃপুন চাষ এবং ফসলের উন্নত জাত ব্যবহার না করাকে এ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও জুমিয়ারা।
অবশ্য সনাতন পদ্ধতির জুম চাষ ছেড়ে অনেক নৃগোষ্ঠী পরিবার আধুনিক পদ্ধতিতে উচ্চফলনশীল ফসল চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। ফলে পাহাড়ে দিন দিন জুমিয়া পরিবারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আবার অনেক স্থানে পাহাড়ের পর পাহাড় বাণিজ্যিক ফলদ বাগানও গড়ে উঠেছে। ফলে জুম চাষের জমি কমে যাচ্ছে।
কেউ খুশি, কারও দুঃশ্চিন্তা
সম্প্রতি থানচি উপজেলার রেমাক্রী ইউনিয়নের দুর্গম এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে এখনও বিশাল এলাকাজুড়ে জুম চাষ করা হচ্ছে। একরের পর একর জুম ক্ষেতের ধান দেখা মেলে পাহাড়ের ঢালে ঢালে। পাকা ধান কেটে নেওয়ার পর এখন জুম ঘরে মাড়াইয়ের কাজও চলছে সমানতালে। আবার অনেক জায়গায় ধান দেরিতে লাগানোর কারণে মধ্য আশ্বিনেও পুরোপুরি পাকেনি।
মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা লিক্রি পাড়ার অদূরে সাঙ্গু নদীর তীরের পাশে একটি জুম ক্ষেতে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল জুম ক্ষেতে চারজন নারী-পুরুষ ধান কাটছেন। কাটা ধান থুরুংয়ে (ঝুড়ি) করে জুম ঘরে স্তুপ করছেন রাইংথোয়াই ম্রো।
লিক্রি পাড়ার এ বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পরিবারের চার সদস্য নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে জুম ধান কাটা হচ্ছে। এ বছর ১২ হাঁড়ি (১ হাঁড়ি ১০ কেজি চাল) ধান হতে পারে এমন পরিমাণ চাষ করা হয়েছে। কিছু অংশ নদীর তীরে হওয়ায় দুই হাঁড়ির মতো ধান এবারের ভারি বৃষ্টিতে ভেসে যায়।
এ কারণে প্রায় ২ হাঁড়ির মতো ধান কম পাবেন বলে মনে করছেন রাইংথোয়াই। তার আরও কিছু ধান গাছ জ্যেষ্ঠের কড়া রোদে নষ্ট হয়েছে। সবচেয়ে বেশি নষ্ট হয়েছে তিল। বৃষ্টিতে নষ্ট না হলে এবারে ৭০ হাঁড়ির মত তিল পেতেন তিনি। এখন এক হাঁড়ি তিল পাবেন না। এক হাঁড়ি তিল ১২০০ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানান তিনি।
রাইংথোয়াই বলেন, “তারপরও সবকিছু মিলে ৮০০ হাঁড়ির মতো ধান পাওয়া যাবে। এতে পাঁচজনের সংসারে তিন বছর খোরাকি ধান ঘরে উঠবে। তবে জুম ক্ষেতে সাথী ফসল হিসেবে পরিচিত মরিচ, ভুট্টা, মারফা ও মিষ্টি কুমড়া একবার কড়া রোদে এবং আরেকবার সম্প্রতি ভারি বৃষ্টির কারণে একেবারে নষ্ট হয়েছে। কোনো রকমে খাওয়ার মতো কিছু পাওয়া যাবে।”
মিয়ানমার সীমান্তবর্তী আরেক এলাকা কোয়াইক্ষ্যং পাড়ার মাঝামাঝি সাঙ্গু নদীর তীরবর্তী পাশাপাশি আরও দুটি বড় জুম ক্ষেত রয়েছে। জুম ক্ষেত হলেও এগুলো পাহাড়ের ঢালু জায়গায় নয়, একেবারে সমতল ভূমিতে। জুমের ধান পুরোপুরি পেকেছে। ধানও বেশ পুষ্ট হয়েছে, সোনালি রঙ ধারণ করেছে।
একটি জুমের মালিক পারাও ম্রো বলেন, “এ বছর ধান ভালো হয়েছে। পুরোপুরি পেকেছে। জুমের ধান পাকলে এক ধরনের গন্ধ বের হয়। চারদিকে এখন পাকা জুম ধানের ম-ম গন্ধ। অল্প কাটা শুরু করেছি।
“স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে পুরো এক মাসের জন্য জুম ঘরে থাকব। ধান কাটা শেষে মাড়াই করে তবেই ঘরে ফিরব। নদীপথে নৌকায় করে নিয়ে যাব। তবে ধান মাড়াই করে স্তুপ করার জন্য জুম ঘর তৈরি এখনও শেষ হয়নি।”
জমি কমেছে, যেতে হচ্ছে বহুদূরে
তবে নদীর তীরবর্তী অনেকের জুম ক্ষেত ভারি বৃষ্টির কারণে ক্ষতি হয়েছে। একেবারেই তলিয়ে গেছে কারও কারও জুম ক্ষেত। তাদের কেউ কেউ খাবার সংকট নিয়ে চিন্তিত। বছর খোরাকি তো দূরের কথা। মাস দুয়েক খাবারের ধানও পাওয়া যাবে না বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
বড়মদক পাড়ার বাসিন্দা বাসিংঅং মারমা বলেন, এলাকায় আগের মতো জুম চাষের জমি নেই। বড়মদক থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে আড়াই ঘণ্টার মতো উজানের দিকে যেতে হয়। আসা-যাওয়া পর্যন্ত দেড় হাজার টাকার তেলের খরচ হয়।
“সেখানে ১০ হাঁড়ির ধান জুমচাষ করেছি। এবারের ভারি বৃষ্টিতে সব নষ্ট হয়েছে। বৃষ্টিতে এভাবে ক্ষতি না হলে দুই বছর খোরাকি ধান পাওয়া যেত। এখন কোনোরকমে দুই মাসের ধান পাওয়া যায় কি-না সন্দেহ। বাকি সময় ধারদেনা করে চলতে হবে।”
বড়মদক পাড়ার আরেক বাসিন্দা মেঅং মারমা ও ছোটমদক পাড়ার বাসিন্দা অজয় ত্রিপুরা জানান, তারা প্রত্যেকে পাড়া থেকে পাঁচ-ছয় ঘণ্টায় নৌকায় করে আসতে হয় এমন দূরে এসে জুমচাষ করেছেন। অগাস্ট মাসে ভারি বৃষ্টির কারণে পুরোপুরি ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় ইউপি মেম্বার-চেয়ারম্যানদের জানানো হয়েছে। তাদের অভিযোগ, কারও কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। পুরো এক বছর খাবার সংকটে ভুগতে হবে।
এ ব্যাপারে রেমাক্রী ইউপি চেয়ারম্যান মুইশৈথুই মারমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অগাস্ট মাসে ভারি বৃষ্টি ও বন্যার সময় সরকারিভাবে ২০০ জনের ক্ষতিগ্রস্ত জুম চাষির তালিকা করা হয়েছিল। সে সময় বড়মদক পর্যন্ত গিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজের হাতে অর্থ ও খাবার বিতরণ করেছিল
“কিন্তু সীমান্তবর্তী কিছু লোকজন এত দুর্গম ও গহীন জঙ্গলে বসবাস করে সেসময় প্রাকৃতিক বৈরি পরিস্থিতির মধ্যে যোগাযোগ করা যায়নি। তারপরও বাদপড়া ক্ষতিগ্রস্ত জুম চাষির ব্যাপারে খবর নেওয়া হচ্ছে”, যোগ করেন তিনি।
ফসলের মঙ্গল কামনায় নবান্ন উৎসব
জুমের ফসল উঠার পর সেই ফসল দিয়ে অনেক জুমিয়া পরিবার নবান্ন উৎসব করেন। মূলত পরের বছর যাতে জুমের ধান ও অন্যান্য ফসল আরও ভালো হয় এ মঙ্গল কামনায়। তবে এলাকা ও ধর্মীয় রীতিভেদে এই নবান্ন উৎসবে ভিন্নতাও থাকে বলে জানান থানচি উপজেলার বয়ং হেডম্যান পাড়ার বাসিন্দা রেংহাই ম্রো।
এতে পরিবারের সদস্য ছাড়াও প্রতিবেশী ও স্বজনরা যোগ দেন, আনন্দে মেতে উঠেন। এটি অবশ্য সবাই একদিনে করেন না; প্রত্যেক পরিবার নিজেদের সুবিধামত সময়ে করেন।
রেংহাই ম্রো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডকটমকে বলেন, ঘরে জুম ফসল তোলার পর প্রত্যেক জুমে নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। আগে থেকে দিন নির্ধারণ করার পর পাড়ার মুরব্বি এবং অন্যান্য জমু চাষিদের আমন্ত্রণ দিয়ে রাখেন জুমের মালিক।
নবান্ন উৎসব পালন করা হয় জুম ক্ষেতের ওই টঙ ঘরেই। কিন্তু অনেক সময় জুমের ব্যস্ততা থাকে বলে সবাই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারেন না। তখন হয়ত পরিবারের কেউ গিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করেন।
যে কোনো জুমে ভুট্টা ও মারফা বেশি পাওয়া যায়। মারফা কাঁচাও খাওয়া যায়। উৎসবের সময় ভুট্টা সিদ্ধ করে খাওয়ানো হয় সবাইকে। এরপর নবান্ন উৎসবে জুমের ভাত রান্না করা হয় জানিয়ে রেংহাই ম্রো বলেন, তরকারি হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে থাকবে মুরগি ও শুকরের মাংস। আনন্দের সঙ্গেই সবাই ভাগাভাগি করে খায় বলে জানান রেংহাই।