জেলা প্রশাসক বলেন, “আগামী দু-একদিন বৃষ্টি না হলে আমরা এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পাব বলে আশা করছি।”
Published : 07 Oct 2024, 09:17 PM
পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টিতে শেরপুরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদী উপজেলায় সৃষ্ট আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
সোমবার বৃষ্টি না হওয়ায় মহারশি, সোমেশ্বরী, ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তবে ঢলের পানি না নামায় অনেক ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাটে পানি জমে আছে।
একই সঙ্গে উজান থেকে ঢলের পানি নামা অব্যাহত থাকায় নতুন করে শেরপুর সদর উপজেলার গাজীরখামার, ধলা, বাজিতখিলা ও পাকুরিয়া ইউনিয়নের আংশিক; নকলা উপজেলার নকলা, উরফা, গণপদ্দী ও গৌরদ্বার ইউনিয়নের আংশিক; নকলা পৌরসভার আংশিক প্লাবিত হয়েছে।
এ বন্যার কারণে রোপা আমন ধান ও সবজিসহ সব ধরনের ফসলের এবং মাছ চাষিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া আঞ্চলিক মহাসড়কসহ গ্রামীণ রাস্তাঘাট ও বাঁধের ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে নকলা উপজেলার গণপদ্দি ইউনিয়নের গজারিয়া গ্রামের মৃত তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক (৬০) রোববার বিকেলে বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে ডুবে মারা গেছেন।
পরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা তার লাশ উদ্ধার করে বলে জানান নকলা থানার ওসি হাবিবুর রহমান।
এ নিয়ে জেলায় বন্যার পানিতে ডুবে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ছয়জনে।
বন্যার পানিতে ডুবে নালিতাবাড়ী উপজেলাতেই পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে এবং সেখানে একজন নারী নিখোঁজ রয়েছে।
অপরদিকে ঝিনাইগাতী উপজেলার সন্ধ্যাকুড়া এলাকায় বন্যার পানিতে ভেসে আসা অজ্ঞাতনামা একজন নৃ-গোষ্ঠীর নারীর গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে তিনি কীভাবে মারা গেছেন সে ব্যাপারে কিছু জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, “বৃষ্টি না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। নকলায় পানি বেড়েছিল তা কমতে শুরু করেছে। এ পর্যন্ত বন্যার পানিতে ডুবে ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে।
“বন্যা কবলিত এলাকায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা পুরোদমে চলছে। জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও বিজিবির পক্ষ থেকে বন্যার্তদের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। আগামী দু-একদিন বৃষ্টি না হলে আমরা এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পাব বলে আশা করছি।”
‘ডল আইয়া সব নিয়া গেছে গা’
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নালিতাবাড়ী উপজেলার গাগলজানি গ্রামের কৃষক অমিজ উদ্দিন বলেন, “বন্যায় আবাদ ক্ষতি অইয়া গেল। গরু-বাছুর নিয়া কষ্টে আছি। আন্দাবারী (রান্না) কইরা খাওন যায় না।”
কৃষক মোতালেব হোসেন বলেন, “ধানের খেত ডুইব্বা গেছে গা। বাড়িঘর ডুইব্বা যাওয়ায় অন্যের বাড়িতে থাকতাছি। অনেক কষ্টে আছি।”
উত্তর নাকশি গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, “ধান লাগাইছিলাম, এক কোমর উঁচা অইয়া গেছিল প্রায়। হরিধানগুলা বন্যা আইয়া পানির তলে গেল গা। এর বাদেও মনে করছিলাম, পানি ঘর-বাড়িত উঠত না। এই চিন্তা-ভাবনা কইরা বাড়িতেই থাকলাম।
“থাহার পর পানি উইট্টা পড়লে গরু-বাছুর নিয়া সড়কও আইয়া পড়ছি। গরু নিয়া সড়কই আছি। খাওয়া যা পাই তাই খাইয়া থাহি। অহন আর কোনো করবার জো নাই।”
উত্তর নাকশি গ্রামের মাজেদা বলেন, “গরর (ঘর) মধ্যে গলা পানি। কোনো কিছু আমি বাঁচাবার পাই নাই। সব ডল আইয়া নিয়া গেছে গা। আমার গরও বর্তমানে একটা রোগী। অসুস্থ অইয়া রইছে। রাউচাউ বন্ধ। রোগীডারে উদ্ধারকারীরা কোনোভাবে উদ্ধার কইরা আইনা থুইয়া গেছে।
“অহন বাড়িত যাইয়া দেহি বেড়াটেরা সব ছিডইন্না-মিডাইন্না। ঘরের মধ্য দিয়া পানির ঢল যাইতেই আছে। আমার আর কোনো উপায় নাই। অহন রাস্তার পাশে একজনের খালি ঘরও আশ্রয় নিছি। খাওয়া-দাওয়া নাই। শুকনা জিনিসই খাইতাছি।”
গাগলাজানি গ্রামের কৃষক আব্দুল মতিন বলেন, “বন্যায় আমার যে ক্ষতি অইছে তা বলার বাইরে। মনে করইন, এক মণ পেঁয়াজ লাগাইছিলাম। দশ কাডা খেত বেগুন লাগাইছিলাম। চাইড্ডা বেগুনের চারা করছিলাম উজানের খেতে লাগানোর জন্য। এইল্লা সব অহন এক বুক পানির নিচে। অহন আমার মুখ দিয়া কতাই আইতাছে না, কী কমু আর।”
শেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক হুমায়ুন কবির বলেন, জেলায় রোপা আমন আবাদ হয়েছে ৯৩ হাজার ৭০৮ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় ৩২ হাজার ১১৮ হেক্টর জমির রোপা আমন ধান সম্পূর্ণ নিমজ্জিত এবং ১৪ হাজার ৬৭২ হেক্টর জমির রোপা আমন আংশিকভাবে নিমজ্জিত হয়েছে।
জেলায় ২ হাজার ৬৩ হেক্টর জমির সবজি আবাদের মধ্যে বন্যার পানিতে সম্পূর্ণ ৩৯৬ হেক্টর এবং ৬৬৩ হেক্টর আংশিকভাবে নিমজ্জিত হয়েছে।
জেলায় আদা চাষ হয়েছে ৬ লাখ ৯৩ হাজার ৬১৮টি বস্তায়। বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে ৪ লাখ ৬৯ হাজার ১৯৪টি বস্তা।
বন্যায় মোট ১ লাখ ৭২ হাজার ৬৩০ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি সরে যাওয়ার পর চূড়ান্ত ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা যাবে বলে জানান কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।
‘তিন কোটি টাহার মাছ চইলা গেছে’
মাছচাষি হাজী আব্দুল জব্বার বলেন, “আমার গাগলাজানি আর নাকশিতে ৫০ একর পুকুরে মাছ চাষ আছিল। ওই প্রজেক্টে আড়াই থেকে তিন কোটি টাহার মাছ আছিল মিনিমাম। এহন কিছু নাই। সব মাছ চইলা গেছে বন্যায়। আমি একবারে নিঃস্ব হয়ে গেছি।”
হাজী আব্দুল জব্বারের মত জেলার শত শত মাছ চাষি বন্যার কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রণব কুমার কর্মকার বলেন, পাহাড়ি ঢলে ও বাঁধ ভেঙে জেলার ছয় হাজার ৫৬টি পুকুর ভেসে গেছে। এতে সব মাছ বের হয়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মাছ চাষিরা। প্রায় ৫৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান সোমবার সকালে বলেন, “ভোগাই নদীর পানি কমে নালিতাবাড়ী পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৫৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং নাকুঁগাও পয়েন্টে ৭৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
চেল্লাখালী নদীর পানি কমে বিপৎসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়লেও তা বিপৎসীমার ৫৩৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।