গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জানান, ভাঙনের মুখে পড়েছে শত শত ঘরবাড়ি।
Published : 25 Jun 2024, 09:22 AM
গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, করতোয়া ও তিস্তার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করছে। এতে আতঙ্কে চরবাসী তাদের ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গাইবান্ধার নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক জানান, সোমবার সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি ২২ সেন্টিমিটার, ঘাঘটের পানি ১৬ সেন্টিমিটার, তিস্তার পানি দুই সেন্টিমিটার এবং করতোয়া নদীর পানি ৩৩ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়েছে। সব নদীর পানি এখন বিপৎসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে জেলার কয়েকটি উপজেলায় নদ-নদীর কমপক্ষে ২৪টি স্থানে ভাঙন শুরু হয়েছে।
এর মধ্যে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের গোয়ালবাড়ি, উত্তর শ্রীপুর ও দত্তেরখামার, হরিপুর ইউনিয়নের কানি চড়িতাবাড়ি, লখিয়ারপাড়া ও চড়িতাবাড়ি এবং বেলকা ইউনিয়নের কিশামত সদর, কাপাসিয়া ইউনিয়নের ভাটি বুড়াইল, উজান বুড়াইল, কালাই সোতারচর ও লালচামার গ্রামে তিস্তার ভাঙন শুরু হয়েছে।
সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের কুন্দেরপাড়া, পাটদিয়া, খামার কামারজানি ও খারজানি, মোল্লারচর ইউনিয়নের সিধাই ও গোপালপুর, গিদারি ইউনিয়নের ডাঙ্গারঘাট এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে।
ফুলছড়ি উপজেলার এরেন্ডাবাড়ি ইউনিয়নের জিগাবাড়ি ও গজারিয়ার, উড়িয়া ইউনিয়নের কাবিলপুরেও নদী ভাঙছে।
সাঘাটা উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের কালুরপাড়া, পাতিলবাড়ি, দীঘলকান্দি ও গাড়ামারা এলাকায় ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন শুরু হয়েছে।
সোমবার কয়েকটি এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে নদী ভাঙনে মানুষের দুর্ভোগের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। কেউ নদী ভাঙনের মুখে থাকা ক্ষেত থেকে পাট কেটে নিচ্ছেন, কেউ গাছ কেটে নিচ্ছেন। অনেকে ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্র অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন।
সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের খারজানি গ্রামের কৃষক তারা মিয়া (৫৫) বলেন, “এ ব্যারক্যার নদী ভাঙনে হামার ঘরের বসতভিটা ও এ্যাক বিগা পাটের ক্ষ্যাত নদীত চলি গ্যাচে। নদী ভাঙনের হাত থাকি হামার ঘরোক বাঁচান।”
বিভিন্ন সময়ে নদী ভাঙনের মুখে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের লখিয়ারপাড়া গ্রামের কৃষক জরিপ শেখ তার বসতবাড়ি ১০ বার সরিয়েছেন।
এখন আবার ভাঙনের মুখে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলছিলেন, স্থায়ীভাবে ভাঙন রোধে কোনো ব্যবস্থা না হওয়ায় প্রতি বছর বন্যা মৌসুমে এই ঘরবাড়ি সরানো কাজ একাধিকবার করতে হয় চরবাসীদের।
একই উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের গোয়ালবাড়ি গ্রামের কৃষক ছফিউল্যা (৫০) বলেন, “হামার ঘরের জমিজমা, বাড়ি-ভিটা সগি আচিলো। নদী ভাঙি হামরা ঘরের এ্যাকন আর কিচুই নাই। মানুষের জাগাত এ্যাকনা ঘর তুলি আচি। তাওবা কোনদিন যানি ভাঙি যায়। তকন কোনটে থাকমো চিনতাত আচি।”
সদর উপজেলার মোল্লারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান বলেন, তিন-চার দিন থেকে তার এলাকায় প্রতিদিন গড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট পরিমাণ এলাকা ভাঙছে। ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জানানো হয়েছে।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাহারুল ইসলাম বলেন, “এ বছর ২০টি বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে শতাধিক বসতবাড়ি। এ কারণে অনেকে তাদের ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন।”
তিনি বলেন, ভাঙন রোধে প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র জিও ব্যাগ ও জিও টিউব না ফেলে স্থায়ীভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
একই উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের গোয়ালবাড়ি গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলামের (৫৫) এক বিঘা পাট ক্ষেত এরই মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
তিনি বলছিলেন, “পানি যত কমছে, তিস্তার ভাঙনও তত প্রকট আকার ধারণ করেছে। এখানে যেসব জায়গায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলানো হয়েছে, সেগুলো নদীতে ভেঙে যাচ্ছে।”
একই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন কাপাসিয়া ইউনিয়নের ভাটির চর গ্রামের মো. আলমগীর হোসেন (৫০)। তারও দুই বিঘা পাট ক্ষেত নদীতে চলে গেছে। বসতবাড়িও হারিয়েছেন।
তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, “নদীতে পানি বাড়া ও কমার সময় তিস্তার চরাঞ্চলের মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। এ সময় চরাঞ্চলের লোকজনকে কমপক্ষে দুই থেকে তিনবার ঘরবাড়ি সরাতে হয়।
“অথচ এই বিষয়গুলো দেখার কেউ নেই। সামান্য ত্রাণ বিতরণ করে সবাই দায় এড়িয়ে যায়। স্থায়ীভাবে নদী ভাঙন রোধের কোনো ব্যবস্থা করা হয় না।”
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ওয়াফিল মণ্ডল বলেন, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী উপজেলার শ্রীপুর, হরিপুর, বেলকা, কাপাসিয়া, তারাপুর ও চন্ডিপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় তিস্তার ভাঙনে এর মধ্যে অর্ধশতাধিক বসত বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
ভাঙনের মুখে পড়েছে শত শত ঘরবাড়ি; ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল বলেন, পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন ঠেকাতে সমীক্ষার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন প্রকল্প তৈরির কাজ চলছে।
এই কাজ বাস্তবায়িত হলে এসব এলাকার ভাঙন রোধ করা সম্ভব হবে বলে পাউবোর এই প্রকৌশলী জানান।