পঙ্কজ ও তার বিরোধীদের দ্বন্দ্ব শুরু হয় গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর; তা আরো বেড়েছে ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর থেকে।
Published : 21 Oct 2023, 01:32 AM
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মুখে আওয়ামী লীগের সব পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথের অনুসারী ও তার বিরোধীদের মধ্যে আবার উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি দুটি অনুষ্ঠানে দুই পক্ষের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনা ছড়িয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরেই দলীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা অবস্থায় আছেন মেহেন্দিগঞ্জ-হিজলার দুইবারের সংসদ সদস্য পঙ্কজ। এর মধ্যে সোমবার হিজলায় এক অনুষ্ঠানে প্রতিপক্ষের নেতারা পঙ্কজের বিরুদ্ধে ‘দলীয় বিভক্তি ও নেতাকর্মীদের নির্যাতনের’ অভিযোগ এনে, এই আসনে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহম্মেদকে মনোনয়নের দাবি জানান।
এর দুদিন বাদেই বুধবার পঙ্কজ দেবনাথ মেহেন্দিগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে শাম্মী আহম্মেদের বাবা সাবেক সংসদ সদস্য ও বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মহিউদ্দিন আহম্মেদকে নিয়ে নানা মন্তব্য করেন; যার ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ছড়িয়েছে।
আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, পঙ্কজ ও তার বিরোধীদের দ্বন্দ্ব বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। তবে তা আরো বেড়েছে ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর থেকে।
মেহেন্দিগঞ্জ-হিজলায় পঙ্কজ-বিরোধীরা মূলত জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সমর্থক। দুই উপজেলা কমিটিতে তাদেরই প্রধান্য, পঙ্কজের অনুসারীরা নেই বললেই চলে। বিরোধীদের অভিযোগ, ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত অনেক প্রার্থীই পরাজিত হয়েছেন। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে যারা চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন তাদের অনেকেই পঙ্কজের অনুসারী হিসেবে এলাকায় পরিচিত।
পঙ্কজের অনুসারীদের দাবি, দুই উপজেলায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক রাজনীতিতে তিনি কোণঠাসা হয়ে পড়লেও নেতাকর্মীদের মধ্যে তার প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে হিজলায় মাঠ পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের একটা বড় অংশ পঙ্কজের অনুসারী। তবে নিজ বাড়ি মেহেন্দিগঞ্জে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী জেলা নেতৃত্বের অনুসারী।
এ অবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ও বিরোধ সামনে আসছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা। পঙ্কজ নাথ তার দলীয় আসনের মনোনয়ন ধরে রাখার চেষ্টায় আছেন; অপরদিকে বিরোধীরা পঙ্কজের বাইরে অন্য কাউকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাইছেন।
দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে আগেও সেখানে খুন-খারাবি এবং হামলা-আক্রমণের শিকার হয়েছে দলীয় নেতাকর্মীরা। নির্বাচন সমানে রেখে সেই প্রবণতা আরও বাড়বে কি-না সেই আশঙ্কাও আছে স্থানীয়দের মধ্যে।
বিরোধের নেপথ্যে কী
মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সুভাষ চন্দ্র সরকার সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথের অনুসারী হিসেবে এলাকায় পরিচিত।
শুক্রবার তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পঙ্কজ নাথ কেন্দ্রীয় রাজনীতি করতেন। তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের সু-সম্পর্ক রয়েছে। তার রাজনীতির ধরন, উন্নয়নসহ দল পরিচালনা আলাদা। যা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছাড়া অন্য কেউ মেনে নিতে পারেন না।
“পঙ্কজ আবারও দলীয় মনোনয়ন পেলে জয়ী হবেন। তখন প্রধানমন্ত্রী তাকে যদি বড় কোনো দায়িত্ব দেন, তাহলে জেলার রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ তার হাতে চলে যাবে। এ চিন্তা থেকেই পঙ্কজকে মাইনাস করার মিশন শুরু হয়েছে।
প্রবীণ এ নেতা বলেন, “জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব তাই শাম্মী আহম্মেদকে নিয়ে মাঠে নেমেছেন। শাম্মী মনোনয়ন পেলে হেরে যাবেন। তখন হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার নেতারা নিজেদের মত করে চলতে পারবেন। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের কারণেই তারা পঙ্কজ এমপির বিরুদ্ধে নেমেছেন।”
তবে এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শাম্মী আহম্মেদের ভাই শাহাব উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে তাদের পরিবারের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের পাঁচবারের সভাপতি ছিলেন। পাঁচবারই তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বর্তমান সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এবং সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য তালুকদার মো. ইউনুসের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।
বিরোধের শুরু
মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার আলিমাবাদ ইউনিয়নে জন্ম নেওয়া পঙ্কজ দেবনাথের বর্তমান বাড়ি পৌর এলাকার ২ নম্বর ওয়ার্ডের সোনামুখী গ্রামের উত্তর বাজারে। এখানেই তার বেড়ে উঠা। ছাত্রজীবনেই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তিনি ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। পরে তিনি সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি টানা ১৭ বছর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি পরিবহন ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের মতে, পঙ্কজ প্রথম ‘ধাক্কা খান’ ২০১৯ সালের অক্টোবরে; যখন তাকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে নিষ্ক্রিয় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। তখন সারাদেশে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলছিল; সেসময় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে থাকার পরেও তাকে সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটিতেও রাখা হয়নি।
এর প্রায় দুই বছর পর ২০২১ সালের জুন থেকে সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়। পঙ্কজ-বিরোধীদের বড় অভিযোগ, সেই নির্বাচনে দুই উপজেলাতে জেলা নেতৃত্বের সমর্থকদের অনেকে নৌকার মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামেন। কিন্তু অনেক আওয়ামী লীগ নেতা নৌকার বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়ী হয়ে আসেন। সেসব স্বতন্ত্র প্রার্থীরা স্থানীয় সংসদ সদস্যের সমর্থন পেয়েছেন। এ ঘটনায় জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে পঙ্কজের দূরত্বের সৃষ্টি করে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে কামাল খানকে কোপানোর নির্দেশ দেওয়ার একটি অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বিরোধীদের দাবি, সংসদ সদস্য মেহেন্দীগঞ্জের ওসির সঙ্গে কথোপকথনে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর ওসিকে বদলি করা হয়। এই ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচিও করে।
এরপর একই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি পঙ্কজকে দলীয় সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়। তখন তিনি বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টার পদ হারান। এ দুটি ঘটনা পঙ্কজ-বিরোধীদের পালে হাওয়া দেয়।
বিপরীতে মাঠ পর্যায়ে পঙ্কজ-অনুসারীরা কিছুটা ‘নীরব’ হয়ে যান এবং ‘কোণঠাসা’ হয়ে পড়েন। সেসময় অবশ্য পঙ্কজ নাথ এক প্রতিক্রিয়ায় কারো নাম উল্লেখ না করেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী আমার বিরুদ্ধে উল্টাপাল্টা, মিথ্যা কথা আপাকে (শেখ হাসিনা) বলেছেন।”
এখন আবার পঙ্কজ-অনুসারীরা মাঠে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টায় আছেন। তাদের দাবি, পঙ্কজ অব্যাহতির ব্যাপারে দলীয় সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার চেয়ে কেন্দ্রের কাছে আবেদন করেছিলেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের অক্টোবরে তাকে ক্ষমা করে দেন দলীয় সভাপতি। ফলে এখন তার দলীয় কর্মকাণ্ড চালাতে কোনো বাধা নেই।
বরিশাল-৪ আসনে একটা সময় বিএনপির ঘাঁটিই ছিল। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সেখানে প্রতিটি নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। ১৮ বছর পর আওয়ামী লীগ পঙ্কজ নাথকে প্রার্থী করে আসনটি পুনরুদ্ধার করে।
এর আগে ১৯৯১ সালে এই আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি চার দলীয় জোটের জামায়াত ইসলামীর প্রার্থীকে হারিয়ে জয় পেয়েছিলেন। কিন্তু পরের নির্বাচনে তিনি বিএনপি প্রার্থীর কাছে হেরে যান।
মহিউদ্দিন আহমেদ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শাম্মী আহম্মেদের বাবা। শাম্মীর ভাই সাহাব আহম্মেদ মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। শাম্মী বরিশাল-৪ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি দলীয় সমর্থকদের নিয়ে দুই উপজেলাতেই প্রচার চালাচ্ছেন।
‘বঙ্গবন্ধুর খুনিরা এখন মেহেন্দিগঞ্জে’
বুধবার মেহেন্দিগঞ্জে উলানিয়া সড়কসহ কয়েকটি উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে পঙ্কজ নাথ বলেন, “বঙ্গবন্ধুর সময়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ ক্ষমতা পেয়ে বরিশাল শহরে হিন্দুদের বাড়ি দখল করছেন, পাশের এক খ্রিস্টান নারীকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে তার জমি দখল করছেন।
“ঢাকায় মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে এক বিহারির বাড়ি দখল করছেন। এজন্য বঙ্গবন্ধু তাকে গভর্নর করেননি। এতে মহিউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধু ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন।
পঙ্কজ আরও বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে খুনের পর মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকায় এমপি হোস্টেলে হাঁসের মাংস ও খিচুরি খেয়ে আমোদ-ফূর্তি করছেন। সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে বরিশালে এসেছিলেন। তার লোক কামাল খানসহ (উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপাতি ও পৌর মেয়র কামাল উদ্দিন খান) অন্যরা মেহেন্দিগঞ্জে বঙ্গবন্ধু ছবি ভেঙে উল্লাস করছেন।
“তার তখনকার সহযোগীরাই এখন মেহেন্দিগঞ্জে আওয়ামী লীগ করছেন। এখন পুনরায় তারা একত্রিত হয়েছে আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রবেশ করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে। তবে তাদের এ ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়া হবে”, বলেন পঙ্কজ।
তবে তার এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ টিপু। তিনি পঙ্কজ-বিরোধী এবং শাম্মী আহম্মেদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঝে বিভেদ ও সংঘাত সৃষ্টি করেছেন এমপি পঙ্কজ। তিনি একজন মৃত মানুষকে নিয়ে যা বলেছেন, একজন সংসদ সদস্য হিসেবে এটা উচিত হয়নি। তার বক্তব্য নেতাকর্মীরা ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। এ নিয়ে তারা বিক্ষোভ সমাবেশ করতে চায়। এতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, দলের বদনাম হবে। চেষ্টা করছি, সবাইকে বুঝিয়ে শান্ত করতে।
টিপু সিকদার বলেন, “সংসদ সদস্য নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করিয়েছেন, তাদের হয়রানি করেছেন। তাই কেউ তার পক্ষে নেই।
“আমরা চাই স্বচ্ছ মানুষ। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ স্বচ্ছ মানুষ। তাই প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী তৃতীয়বারের মতো এ পদে রেখেছেন তাকে। তাই আমরা শাম্মী আহমেদকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে চেয়েছি।”
মহিউদ্দিন আহমেদের বড় ছেলে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাব আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমপি পঙ্কজ কী বলছেন না বলছেন তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না। বরিশালের মানুষ জানে মহিউদ্দিন আহমেদ কে? ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের জন্য মহিউদ্দিন আহমেদ কী করেছেন। আওয়ামী লীগের সব কর্মকাণ্ড নগরীর আলেকান্দার বাসায় পরিচালিত হত।”
‘শাম্মীর জন্য সবাই এক’
শাম্মী আহম্মেদ তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন বরিশাল বিএম কলেজে ছাত্রলীগের মাধ্যমে। সেসময় তিনি কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছিলেন। পরে তিনি ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।
২০০১ সালে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পাদক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য হন। ২০১৭ সাল থেকে তিনি ক্ষমতাসীন দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদ সামলাচ্ছেন।
এমপি পঙ্কজ নাথকে আওয়ামী লীগের সব পদ থেকে অব্যাহতি
প্রার্থিতা ফিরে পেলেন সোহেল রানা, টিকে গেলেন পঙ্কজ ও জ্যাকব
এমপি পঙ্কজকে দলীয় পদে অব্যাহতি: যা বলছেন স্থানীয় নেতারা
কেন্দ্রীয় নেতা হলেও মাঠের নির্বাচনী রাজনীতিতে তিনি বিগত দিনে ততটা সক্রিয় ছিলেন না। কিন্তু এখন মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলা দুই উপজেলাতেই তিনি সময় দিচ্ছেন। রাজনীতিবিদ বাবার পরিচিত তাকে মাঠ রাজনীতিতে সুবিধা দিচ্ছে বলেও তার অনুসারীরা জানিয়েছেন।
সোমবার হিজলা উপজেলার এক কর্মীসভায় বরিশাল-৪ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথের পরিবর্তে শাম্মী আহম্মেদকে প্রার্থী করার দাবি তোলেন তার অনুসারীরা। এ সময় সেখানে শাম্মী আহম্মেদও উপস্থিত ছিলেন। যদিও তিনি নিজের এ ব্যাপারে কিছু বলেননি।
সেখানে মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র কামাল আহমেদ খান বলেন, “আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ। শাম্মী আহম্মেদ মনোনয়ন পেলে তাকে বিজয়ী করতে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন। বর্তমান সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথের অত্যাচার থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মুক্তি পাবেন।”
এ সময়ে সেখানে থাকা আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারাও তার পক্ষে সমর্থন দেন এবং পঙ্কজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের অভিযোগ তুলেন।
তবে হিজলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. বেলায়েত হোসেন ঢালী মনে করেন, এই আসনে শাম্মী বা তার অনুসারীদের ভোট নেই। তিনি পঙ্কজকেই ভালো প্রার্থী মনে করেন।
যুক্তি তুলে ধরে প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, উপজেলা নির্বাচনে তিনি বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ টিপু সিকদার ছিলেন দলীয় প্রার্থী। ভোটে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন ২৬ হাজার আর টিপু সিকদার পেয়েছিলেন ১০ হাজার ভোট।
“টিপু সিকদার তো দুইবারের চেয়ারম্যান ছিলেন। সাধারণ মানুষ যদি তাদের সমর্থন করত, তাহলে তো ভোট পেতেন। কিন্তু তাদের পক্ষে সাধারণ মানুষ নেই। মানুষ পঙ্কজের পক্ষে”, বলেন বেলায়েত হোসেন ঢালী।
তিনি বলেন, “দলীয় পদধারীরা না থাকলেও জনপ্রতিনিধি ও জনগণ পঙ্কজের পক্ষে রয়েছেন। হিজলা উপজেলার চেয়ারম্যান, সাধারণ ও সংরক্ষিত ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এমনকি ইউপি সদস্যরাও পঙ্কজ দেবনাথের পক্ষে রয়েছেন।”
মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম ভুলু আগে সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথের অনুসারী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। সম্প্রতি তিনি জেলা নেতৃত্বের অনুসারী হয়েছেন।
তিনি বলছিলেন, “হিজলা, মেহেন্দিগঞ্জ ও কাজিরহাট থানা আওয়ামী লীগ এবং সংগঠনের কোনো কমিটিতে এমপির কোনো অনুসারী নেই। উপজেলা চেয়ারম্যান, সাধারণ ও সংরক্ষিত ভাইস চেয়ারম্যান, পৌর কাউন্সিলর ও ১৬ ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা এমপি পঙ্কজের অনুসারী ছিলেন। এর মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান, আট ইউপি চেয়ারম্যানসহ সিংহভাগ জনপ্রতিনিধি এখন আর পঙ্কজ এমপির পক্ষে নেই।”
দলীয় প্রার্থী হিসেবে শাম্মী আহম্মেদ অনেকটা এগিয়ে রয়েছেন দাবি করে ভুলু বলেন, “আগে তার এতটা পরিচিতি ছিল না। মেহেন্দিগঞ্জে আসতেন। এখন তিনি নিয়মিত আসছেন, দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। এ কারণে তার অনুসারীর সংখ্যাও বাড়ছে।”
নিজের অবস্থান জানাতে গিয়ে এই জনপ্রতিনিধি বলেন, “দল যাকে মনোনয়ন দেবে আমি নেতাকর্মীদের নিয়ে তার পক্ষেই কাজ করব। এখানে পঙ্কজ এমপি, শাম্মী আহম্মেদের বাইরে আরও তিনজন প্রচার চালাচ্ছেন। অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম, শাহ আলম মুরাদ ও মেজর নাসির মনোনয়নের চেষ্টা করছেন।”
বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আফজালুল করিম জানান, তিনি মনোনয়নের জন্য গণসংযোগ করছেন। মানুষের কাছে যাচ্ছেন।
“শাম্মী আহম্মেদ এমপি পঙ্কজ সম্পর্কে কিংবা পঙ্কজ কেন্দ্রীয় নেত্রী শাম্মী সম্পর্কে কখন কী বলেছেন তা নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আমি দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতি আমি করি না।
“আমি বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রচার চালাচ্ছি। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যদি সাধারণ মানুষের কাছে তুলে না ধরা যায়, তাহলে মানুষ কেন ভোট দেবে? ভোটের রাজনীতি, তাই আমি উন্নয়ন তুলে ধরে নিজের নির্বাচনের জন্য সবার সহযোগিতা চাইছি।”
যা বলছেন পঙ্কজ ও শাম্মী
বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন করলে সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ বৃহস্পতিবারও মহিউদ্দিন আহম্মেদ সম্পর্কে তার বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন।
তিনি বলেন, “এখন পুনরায় তারা শাম্মী আহমেদের নেতৃত্বে একত্রিত হয়েছে আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রবেশ করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে। তবে তাদের এ ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়া হবে।”
এতদিন পরে কেন এসব বলছেন– এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “এগুলো সবাই জানে, তাদের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিভিন্নভাবে অত্যাচার করে যাচ্ছে।”
ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করানোর অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য বলেন, “বিদ্রোহী অনেকেই নির্বাচন করেছে, এখানে পাস করেছে এমন লোকজন আমার এখানে এসেছে। তবে যিনি (মেয়র কামাল উদ্দিন খান) অভিযোগ দিয়েছেন, তিনিই তো আওয়ামী লীগের শত্রু, মেহেন্দীগঞ্জ সদরের চার-পাঁচটা ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী দিয়ে নির্বাচিত করেছেন।
“এর বাইরেও প্রার্থী দিয়েছেন কিন্তু কিছু করতে পারেননি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এখন শাম্মীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ।”
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহম্মেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কিছুদিন দিন আগে মেহেন্দিগঞ্জে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, সেখানে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা, আমাকে এমপি হিসেবে দেখতে চেয়েছেন, এই ঘটনার পরে হয়ত উনি (পঙ্কজ) অনেক কিছুই মনে করছেন।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে পঙ্কজ নাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন কি-না জানতে চাইলে শাম্মী আহম্মেদ বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত বিচক্ষণ নেত্রী। উনার কাছে বিচার দিতে হয় না, উনি সব খবরই রাখেন।
মহিউদ্দিন আহমেদ সম্পর্কে পঙ্কজ নাথের বক্তব্যের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে শাম্মী আহমেদ বলেন, “কী আর বলব ভাই, আমার বাবাকে বরিশালের সবাই জানে। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন, ২০ বছর আগে তিনি মারা গেছেন। এখন হঠাৎ করে এ ধরনের মিথ্যাচার শুরু করেছেন, এর জবাব দেওয়ার মত ভাষা আমার জানা নেই। মানুষ কীভাবে এত মিথ্যাচার করতে পারে।”
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কাজী মোবারক হোসেন।)